আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ১৭

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ১৭

  • কাউসার মাহমুদ

সময় এমন এক ছুরি, বিরূপ পরিস্থিতিতে যা আপনাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। একটি পাথরখণ্ডের মত স্থবির থাকলেও, যন্ত্রণায় যন্ত্রণায় নিঃশেষ করে দেবে। বিশ্বাস করুন! এখন আর এসব লিখতে ভালো লাগে না। আমার ‘নির্জনতা ও অন্যান্য’ গ্রন্থে’ জীবনের এই করুণ দশা নিয়ে বহু কথাই উল্লেখ করেছি। নানা ঢঙে নানা আঙ্গিকে এর বর্ণনা দিয়েছি। মায়া এঞ্জেলো কোথাও বলেছিলেন, There is no greater agony than bearing an untold story inside you মানে সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে আপনার ভেতরে বলতে না পারা গল্পটাকে সহ্য করা। সেসব না বলতে পারা গল্পগুলো একদা আমি বলেছিলাম ঠিকই। হয়ত ছোট ছোট কথায়। হয়ত আয়তনে অতি অল্প বর্ণনায়। তারপর ভেবেছিলাম, একদিন দুঃখের দিন শেষ হবে। নিয়ত বলে বেড়ানো এসব যাতনার কথাগুলো মানুষের শুনতেও খারাপ লাগে নিশ্চয়ই। নইলে একজন লেখকের কাছে যে বৈচিত্র্যময় রচনার আশা সবার থাকে—আমি তাতে ব্যর্থই হয়েছি বোধহয়।

সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে আপনার ভেতরে বলতে না পারা গল্পটাকে সহ্য করা

তাই বহুদিন ধরে সৃজনের নতুন একটি ভাষা খুঁজছি। অভিনব এক পথের তালাশ করছি। যেখানে আমার পূর্বোক্ত রচনার সেসব কথারা থাকবে না। সেই জরা, সেই ক্লান্তি, সেই সঙ্কট, সেই ব্যর্থতা, সেই অস্বস্তি, সেই হতাশা, সেই ভয় এবং সেই আতঙ্ক-সমাচ্ছন্ন ভাবটি রবে না। বরং সবুজ ঘাসের মত উত্থিত, প্রাণপূর্ণ অঙ্কুরের মত প্রদীপ্ত গল্পরা খেলা করবে তাতে। আশা জোগাবে। জীবনের কোথাও না কোথাও কিছু আলো কিছু আনন্দ পুনরুদ্ভূত হবে।

কিন্তু হায়! রাহুগ্রস্তের মত কী সব অন্ধকার বিপদ্দশা যে গ্রাস করে রেখেছে আমায়! কী সব জাগতিক সঙ্কটগুলো যে জড়িয়ে রেখেছে! কেন যেন তা থেকে পরিত্রাণই পাচ্ছি না। এ কী আমার অদৃষ্টেরই লিখন না-কি দৈবচয়ন—তারও কিনারা করতে পারি না। ভাবি, এ কোন বৃত্তে ঘুরছি? কোনোক্রমে একটি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন এক সঙ্কট এসে হাজির। যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছে সে। আমাকে আলিঙ্গনের জন্যই দুহাত জড়ো করে মাল্যবতীর মত দাঁড়িয়ে আছে।

এই যেমন এখনও তেমন এক অবর্ণনীয় সমস্যায় জড়িয়ে আছি। কী করে কোথা থেকে কীভাবে যে এই অত্যন্ত সমস্যাটি আমার মত দুর্বলচিত্তের মানুষের ওপর এসে আপতিত হল—তার ভার গ্রহণ করতে বড় হিমসিম খাচ্ছি। এতদিন ধরে যে চাকুরিটি করছি, প্রত্যহ যা থেকে আরেকটু সহজ কাজে যাওয়ার বাসনা করেছি—বিগত ক’দিন ধরে সে বিষয়টিই একদম গুলিয়ে আছে।

কোনোরূপ অশনিসংকেত ছাড়াই বর্তমান দোকানি এমন এক কাণ্ড করে বসেছে যে, অনায়াসে কোথাও যাওয়ার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে এমতাবস্থায় অন্য কোথাও নতুন কোনো চাকুরিতে যাব, তা পারছি না। এখানে বছরে বছরে আট হাজার রিয়াল সরকারি খাজনা দিয়ে থাকব, সে সামর্থও নেই। ওদিকে হঠাৎ যে দেশে ফিরব—সে সাহস তো নেই-ই। কেননা জীবনের এসব পরিস্থিতিগুলো এমনই নিষ্ঠুর, এমনই কাঁটাযুক্ত—তাতে সময় ও সুযোগ দুই-ই আপনার জন্য বেরুনোর দরজাটি বন্ধ করবে। যেন তরবারির মসৃণ ধারের ওপর দাঁড়াতে হবে আপনার। তাতে কোনো পার্শ্বেই যেতে পারবেন না হেতু, সোজা দ্বিখণ্ডিত হয়ে মৃত্যুকূপে পড়বেন।

যতই বলি না কেন, দুঃসময় মানুষকে শক্তিশালী করে, আদতে অধিকাংশ সময় এটি কেবল বাণীবন্দনা হিসেবেই থেকে যায়।

অতএব যতই বলি না কেন, দুঃসময় মানুষকে শক্তিশালী করে। আদতে অধিকাংশ সময় এটি কেবল বাণীবন্দনা হিসেবেই থেকে যায়। কেননা, যারা এই সময়টি অতিক্রম করতে যায়, তাদের বহুজনেরই পথিমধ্যে মৃত্যু ঘটে। কেউ ভূগর্ভে হারায়। কেউ কেউ সে পথ মাড়িয়ে আসলেও, পিছুটান তাকে আরও অধঃপতিত করে ফেলে। সবদিক বিবেচনা করে বর্তমান আমিও সে পথেই আছি। জানি না কোথায় এর ইতি ঘটবে। কোথায় এ উভয়সঙ্কটের নিষ্পত্তি হবে। তবে যদ্দিন না এর একটা বিহিত হয়, অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ হিসেবে আমার অবস্থাটি বড় বিশ্রীই যাবে। মানসকি অবসাদ প্রায়শই যেখানে জড়িয়ে রাখে, সেখানে আচমকা এ আঘাত কোথায় নিয়ে যে দাঁড় করাবে আমায়, জানি না। তাই আজকাল হঠাৎ এসবে আশ্চর্য হওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছি। তাতে প্রাথমিক আচরণটি হয় হতবুদ্ধিতা। তারপর কিয়ৎকাল আপন অদৃষ্টের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। আবারও নতুন ব্যর্থতার খোঁজে অনিশ্চিত  ভবিষ্যতের অভিমুখী হই। জানি এভাবেই ব্যর্থ হতে হতে একদিন সমস্ত ব্যর্থতাকে জয় করে ফেলব আমি।

মূলত এ ভাবনাটিই মাঝেমাঝে শক্তি জোগায়। কিছুটা শ্রান্তি আনে মনে। নইলে যে বিমূর্ত এক ভয় সর্বদা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ বিভ্রান্ত করে রাখে—তাতে উন্মাদ হওয়া ছাড়া উপায় কী? কিন্তু এত সহজেই যে নিজেকে বিধ্বস্ত হতে দেব না—সে বিশ্বাসও হৃদয়ে ধারণ করি। যে যুদ্ধে নেমেছি, যে ঝড়ের বিরুদ্ধে এতদিন টিকে আছি, তাকে পরাজিত না করে মরব না নিশ্চয়। ফলে নিজের সঙ্গেই নিজের যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। সমস্ত দিন যে হতাশা যে দুঃখবোধ আক্রান্ত করে রাখে, তাকে পরাজিত করতে প্রস্তুত রাখি নিজেরই কয়েক মুহুর্তের সে প্রবোধ। সেই বোধটুকু কখনও আধোঘুমে কখনও আধোজাগরণে সঞ্চার হয়। কখনও ঠায় বসে থেকে থেকে আকাশের দিকে তাকালে হৃদয়ে আবির্ভূত হয়।

মোটকথা, অবস্থাটি এমন যে, আমার ভাবনারা যদি আমাকে আক্রান্ত করে, তাহলে আমারই হৃদয় আবার সে ভাবনাদের অপসারিত করে। এ এক অদ্ভুত হৃদয় আমার। প্রায়শই ভাবি, আমার মত অন্যদের মনেও কি এই বিচিত্র ভাবনার উদয় হয়? তাঁরাও কি এমন অসহ্য যন্ত্রণার মাঝে বেঁচে থেকে একদিন সেসবকে পরাজিত করার স্বপ্ন দেখে?তাঁরাও কি একদিন হৃদয়ের প্রাচুর্যের কথা ভাবে? প্রমত্ত গঙ্গার মত অশান্ত হৃদয়টা একদিন সমস্ত বিক্ষুব্ধতা থেকে শান্ত হবে—সেই বিশ্বাস রাখে? যেন এইখানে এসে কল্পনারা আরও রূপময়তায় মিশে যায়। সারাটাক্ষন সমৃদ্ধ একটা জীবন হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। বুঝি হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি। দু কদম এগুলেই ধরতে পারি। সেসময়টুকু বড় বর্ণিল লাগে। একটি ঘোরের ভেতর হারাতে ইচ্ছে করে। সেই ঘোর যেন জাদুর এক দিঘি। তাতে ডুব দিলে, কিছুকাল আনমনে বসে থাকলে জীবনের লক্ষ্যগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়। পুনর্বার সবকিছু শুরু করার প্রেরণা জাগে। এতে করে সুগভীরভাবে যে বিষয়টি আত্মস্থ করেছি, ধ্যানমগ্ন ঋষির মত যে আশ্চর্য শক্তিটি আত্মস্থ করেছি—তা আপন হৃদয়ের কথা শোনা। অর্থাৎ, বিপন্ন মুহুর্তগুলোয় কোলাহল কোনোদিনই আমায় সরল পথটি দেখাবে না। মানুষেরা এক আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দেবে না। ফলে এসময় আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী আমার আপন হৃদয়।

ক্রমশ..

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *