আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ১৮

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ১৮

  • কাউসার মাহমুদ

মন্থর ট্রেনের মত দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছে। প্রতিটি ভোর যেন ক্লান্তিকর দীর্ঘ ভ্রমনের দুশ্চিন্তার সাথে শুরু হয়। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করে না কোনো কোনোদিন। তবু পা দু’টি টেনে দাঁড়াতে হয়। প্রাতঃকৃত্য সমাপন করে বছরের পর বছর ধরে একই কাজের দিকে ছুটতে হয়। ফলে আজকাল প্রায়শই একঘেয়েমি পেয়ে বসেছে। যেন বৈচিত্র্যহীন অপ্রিয় এক জায়গায় আছি। সেখানে কেবল শরীরটাই সক্রিয় থাকে।

এছাড়া হৃদয়টা বড় হাঁসফাঁস করে। নূতন পথের সন্ধানে যেতে চায়। কিছু কোমল আন্তরিক প্রাণের সঙ্গ কামনা করে। কিন্তু কোথায় সে পথ? কোথায় সে প্রাণ? যেদিকেই চাই, শুধু নিস্পৃহ মনোভাব খেলা করে। কী সব অদ্ভুৎ চিন্তারা এসে ইন্দ্রিয়গুলো অবশ করে দেয়।

যেন কিছুই ভালো লাগবে না আমার। কিছুতেই মন বসবে না। কেবল একটা সমুদ্রের কথা মনে করে হৃদয়টা তোলপাড় হয়ে যাবে। মনে হবে এসময় সমুদ্রপাড়ে যেতে পারলে ভালো লাগত। কিছুকাল নিশ্চল ঝিনুকের মত ফেনিল তটের ওপর ডুবে থাকলে বেশ লাগত। যখন আমার বুকের ওপর ধেয়ে আসবে ঘন জলস্রোত। দুর্ভাবনাদের তাড়িয়ে আকাশের নীলের দিকে তাকিয়ে থাকব আমি। রাত্রি হবে। বায়ুর প্রবাহ বাড়বে। দূর সমুদ্রের বুকে একটি লণ্ঠনের মতই কোনো জাহাজ অন্ধকার ফেড়ে চলবে। মোহগ্রস্তের মত সেই দৃশ্য দেখব আর ভাবব ফরাসি কবি আঁরি মিশো’র কবিতা ‘সমুদ্র।’

যা আমি জানি, যা আমার, তা হল এক অনির্দিষ্ট সমুদ্র/একুশ বছর বয়সে আমি পালিয়ে এসেছিলাম শহরের জীবন থেকে/ হয়েছিলাম নাবিক। জাহাজে কাজ থাকত। আমি অবাক হতাম। আমি ভেবেছিলাম, জাহাজে লোকে কেবল সমুদ্র দেখে। অনন্তকাল সমুদ্র দেখে।/জাহাজগুলোকে নিরস্ত্র করা হল। শুরু হল সমুদ্রের মানুষদের বেকার দশা।/ আমি পেছন ফিরে চলে গেলাম, কিছু বললাম না, আমার ভেতরে সমুদ্র, আমার চারদিকে চিরন্তন সমুদ্র। / কোন সমুদ্র? সে কথা আমি স্পষ্ট করে বলতে পারব না। (অনু : সুদেষ্ঞা চক্রবর্তী)

তবে স্বপ্ন আছে। ভ্রমের অনুরূপ কিছু বাসনা আছে। সেসবের কথা ভেবে হাঁটি। দিনভর কাজ করি।

তেমনি আমিও তো পেছনেরই লোক। কত কী অতিক্রম করে এলাম। কত স্মৃতি, কত যান, কত পোতাশ্রয় পেড়িয়ে এই ঘাটে এসে থামলাম। যেখানে আনন্দ নেই। স্বাধীনতা নেই। উৎসব নেই। একটা দিন নির্জন খুশীতে যে কাটবে, সে সুযোগ নেই। তবে স্বপ্ন আছে। ভ্রমের অনুরূপ কিছু বাসনা আছে। সেসবের কথা ভেবে হাঁটি। দিনভর কাজ করি। আর এমন বিষন্ন মলিন দিনে আগত ভবিষ্যতের কথা ভাবি। সেই সুনীল সময়ের কথা কল্পনা করি—যেখানে দিনগুলো রঙিন হবে। কেবলই বেঁচে থাকার জন্য নয়, বরং জীবনটাকে উপভোগ করতে পারব। সেই উপভোগ যেমন শুধু অর্থেই নয়, তেমনি এরূপ কষ্ট ও তিক্ত শ্রমেও নয়।

পরাধীনতা এবং অন্যের প্রভুত্বেও নয়। ফলে আমি চাই স্বাধীন একটা জীবন। সকল তমসার পরে চন্দ্রালোকিত উজ্জ্বল আকাশের মত একটা জীবৎকাল। কারণ, এখনও যে কত কাজ অবশিষ্ট আমার। এখনও যে কতকিছু রচনার বাকি। মাঝেমাঝে এ ব্যথাই হৃদয়টা ভার করে দেয়। এই শোকটিই সবচেয়ে বেশি আহত করে।

যখন কয়েকটা দিন চলে যায়, অথচ একটুও পড়তে পারি না। এক পাতা লেখার ফুরসত মেলে না। তখন নিজের ভেতরই গোঙানির শব্দ পাই। সেই শব্দরা ধ্বনিত হতে হতে নিঃশব্দ হয়ে যায়। তাদের অবয়ব থাকে না। পৃথিবীর কোনো মানুষের পক্ষে আমার সে যন্ত্রণা আঁচ করা সম্ভবও না। কেবল আমি জানি সেই বিষাক্ত সময়ের কথা। যেন ব্যথাতুর উটের মত চিৎকার করি শুধু। অশ্রুহীন কান্নার কাছে আনত হই। অনায়ত্ত ভাগ্যের দিকে দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকি। যেখানে দাড়িয়ে থাকে আস্ত একটা ছায়াময় দুপুর। সে ছায়ায় যাব? ওখানে দাঁড়াব? হাত ধরে কেউ নিয়ে যাবে? বিকেলের দিকে? আবছায়া নিভৃতে? কিংবা মৃগমদ সুগন্ধি খুলে চিবুকের কাছে এসে বলবে, ‘এই নাও, ধরো।’

যেন আশ্চর্য ছন্দপতন হয়ে গেল মনে হয় জীবনে। আসলে পতন আর কী? খুব একটা ছন্দ যে  ছিল, তা তো না। তদুপরি যেটুকু ছিল, যে নিয়মে দিনগুলো কাটছিল—তাতে বেশ রদবদলই হয়েছে। যেটা বাহ্যত প্রকট না হলেও, আমি তার ব্যত্যয়টি ঠিকই আঁচ করছি। পূর্বে নৈমিত্তিক যে বোঝাপোড়া ছিল, সেসব পাল্টেছে। কাজকর্ম, উপার্জন, বয়স, পড়াশোনা ও পরিবার নিয়ে বহু চিন্তাই করছি আজকাল। যেন জগতের জটিলতাগুলো খুব সুকৌশলে আমায় আদৃত করতে চাইছে।

তাই বোধকরি মানুষ যদি তার বিশ্বাসে অটল থাকে, তাহলে সে যা চায় তা তার অর্জন হবেই।

এক্ষেত্রে অধিক দ্বিধাগ্রস্ত হই তখন, যখন প্রয়োজনগুলো মেটাতে পারি না। যখন অর্থের জন্য দুশ্চিন্তা হয়। যখন বন্ধুদের মোটা অঙ্কের উপার্জন দেখে বিস্মিত হই। যখন বাস্তবিক এক পিছুটানের ফলে সম্মুখে অগ্রসর হতে ভয় পাই। ভয় পাই ঝুঁকি নিতে। মূলত মধ্যবিত্ত সংসারে বেড়ে উঠা ছেলেদের এই এক অনন্ত ভয়। খুব কমই যা থেকে বেরুতে পারে তারা। যাদের অল্পই মাড়িয়ে যেতে পারে তা। ভয়টি এই, ‘যদি কিছু হয়ে যায়। যদি না পারি। যদি হেরে যাই। যদি ফেরা না হয়।’ এই ‘যদি’ই তাদের সর্বাংশে গিলে ফেলে। তাই যদ্দিন না এই ‘যদি’কে পরাভূত করা যাবে, তদ্দিন ভয়ের তলেই থাকতে হবে৷ তদ্দিন পরাস্ত হতেই হবে। কারণ এ জগৎসংসার প্রধানত কুরুক্ষেত্রই। এখানে যুদ্ধই বেঁচে থাকার অবলম্বন। সেই যুদ্ধ কেবল যে মল্লযুদ্ধ তা নয়৷  সেই যুদ্ধ যে কাউকে ভূ-শায়ী করার চেষ্টা তাও নয়। বরং যুদ্ধটি নিজের সঙ্গে। কিছু অর্জনের বিশ্বাস ও মনের সঙ্গে। তাই বোধকরি মানুষ যদি তার বিশ্বাসে অটল থাকে, তাহলে সে যা চায় তা তার অর্জন হবেই। সাময়িক তার মনটা আহত হলেও, একদিন তাতে আনন্দের ডঙ্কা বাজবেই।

এই যেমন আশ্চর্য কাণ্ডটি দেখুন। এই কথাগুলো যে লিখছি, তাও যেন নিজেকে ভেবেই। যেন আমার হৃদয়টা বলছে, বহুকাল পর যখন আমার দিন পাল্টাবে, যখন সমস্ত সঙ্কট দূর হয়ে একটা স্বাভাবিক বেঁচে থাকা পাব, তখন এই রচনার দিকে তাকিয়ে স্মৃতিকাতর হব। একটা অতীত— চিত্রকর্মের মত আমার ডায়রির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকবে। তা দেখে হাসব, কাঁদব—যা ইচ্ছে করব। হয়ত সে সময়ের কথা মনে করে বহুদূর মেঠোপথে হেঁটে যাব। এই বিদেশবিভুঁই ছেড়ে আমার সবুজ শান্ত গ্রামে।

(২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩)

ক্রমশ..

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *