আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ১৯

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ১৯

  • কাউসার মাহমুদ

যখন সেই ক্ষনটি আসে। যখন একটা রচনার চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে। যখন বহু বিনিদ্র রাত উপবাস করে একটা পুস্তক তৈরি হয়। তা যে কী সুখের, কী অসীম আনন্দ যে বিদ্যুৎের মত প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হয়, লেখক মাত্রই তা জানেন। শিল্পী মাত্রই সে আনন্দের রসাস্বাদ করতে পারেন। আজ তেমনি তৃপ্তি বোধ করছি। তেমনই সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছি। শরীরের ওপর, মনের প্রতি যে দুর্বার পীড়ন পরিচালিত হয়—আজ তা ক্ষণিকের জন্য হলেও নস্যি লাগছে। মনে হচ্ছে, আমার কাজই তো এই। এই অনটন, সঙ্কট, ক্লেশ, রোগ-শোক, ক্লান্তির ভেতর দিয়েই তো আমার সাধনা। শিল্পের চর্চা করে যাওয়া। যেন আঘাতের বদলে প্রতিঘাত। প্রতাপী বায়ুর বিরুদ্ধে ঝড়। আঁধারের বিপরীতে আলো। দুঃখের বিরুদ্ধে সুখ। নিদ্রার বিরুদ্ধে জাগরণ।

এসব বিচিত্র অবস্থাকে পরাজিত করে যখন একেকটা লেখা সম্পন্ন করি, তখন এমনই পুলকিত হই৷ এমনই আত্মহারা হয়ে যাই। কোথাও কাউকে ঘটা করে না বলে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে পুলক অনুভব করি। আজ সেই দিন। যেদিন তিনটি বইয়ের কাজ শেষ করে দুটি প্রকাশনীকে হস্তান্তর করলাম। মূলত এই কাজগুলোর সূচনা হয়েছিল প্রায় বছর দুই আগে। কিন্তু নানাবিধ জাগতিক চাপে তা আর শেষই হচ্ছিল না। প্রায়শই অতি সামান্য কাজের পর দীর্ঘদিন বিরতি যেত। কিন্তু যেভাবেই হোক, শেষতক এর একটা বিহিত হলো। মনে হল সত্যিই কিছু কাজ করলাম বটে। কেননা, যে তিনটি বইয়ের কাজ করেছি সবকটি’ই অনুবাদ। দুটি উর্দু ভাষার। এ দুটি গল্পের। আরেকটি দুনিয়ার বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ কবিদের দশটি সাক্ষাৎকার। ভাবছি, তিনটি বই-ই মানুষের কাজে আসবে। আমাদের জ্ঞানের জগতে নতুন কিছু সংযুক্ত করবে।

উর্দু ভাষায় ইতঃপূর্বে বেশ কিছু কাজ আমি করেছি ঠিক। তবে এ দুটি বই একসাথে আনতে পেরে সত্যিই খুশি হয়েছি। কেননা, একই সময়ে দু’জন শক্তিমান লেখক, লেখিকার গল্পের বুননটা কেমন ছিল, তাই আঁচ করা যাবে এতে। ভাবছেন, তাঁরা কারা। তাঁরা মহান সাদত হাসান মান্টো ও মহামতি ইসমত চুগতাই। একসঙ্গে তাঁদের পাঠ করার ফলে সবচে জরুরি যে অভিজ্ঞতাটি আমার হয়েছে, তা তাঁদের বর্ণনার ঢঙ। প্রকাশের ভঙি। গদ্যের চাল। চিন্তার পরাক্রান্ত বহতা। সেইসাথে একসঙ্গে একটি ভাষার প্রধান দুই লেখকের তুলনামূলক রচনা পাঠ। যারা আধুনিক সাহিত্যে সে ভাষাটিকে পরিপুষ্ট হতে সাহায্য করেছেন। দুজনই এমন সব রচনা সৃষ্টি করেছেন—উর্দু সাহিত্যে নারীবাদ, যৌনতা ও সমাজের অচ্ছুৎ যাবতীয় বিষয়াবলিকে যা পাদপ্রদীপের আলোয় গণমানুষের সম্মুখে এনে দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু এই কর্মে তাঁদের প্রত্যেকের ভাষিক বর্ণনাভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণই ভিন্ন। ফলে গভীর পাঠের মাধ্যমে প্রধানত যে বিষয়টি আমি উপলব্ধি করেছি, নিশ্চয় তা ভাষার গতি।

কেননা মান্টো যেখানে সাধারণ পরিচিত শব্দের মাধ্যমে তীর্যকভাবে গল্পটি বলে যান, চুগতাই সেখানে ব্যতিক্রম। মান্টোর গদ্য পড়লে কদাচিৎ অভিধান খুলতে হয়। বিপরীতে চুগতাই বোধহয় হয় কোনোরূপ সহজতার তোয়াক্কাই করেননি। বরং তাঁর রচনায় বিশাল ভারতের বহু অঞ্চলেরই মিশ্র শব্দাবলির প্রয়োগ ঘটে। মান্টোর গল্পে গদ্যের সাথে খুব একটা বোঝাপড়া করতে হয় না। তাঁর প্রতিটি গল্পই এমন নিগূঢ় সত্যাসত্য তীব্রতায় শেষ হয়, যা পাঠককে বিবিধ কায়দায় স্তব্ধ  করে রাখে৷ মনস্তাত্ত্বিকভাবে বধ করে ছাড়ে। অন্যদিকে চুগতাইর শৈলিটিই এমন যে, উর্দু ভাষায় মোটামুটি জানপেহচান না থাকলে—তা দুরূহই ঠেকবে। ফলে তা আস্বাদের বদলে ওটা বুঝতেই কসরত করতে হবে।

সে যাহোক, মোটকথা একটা ভাষার এমন মহান দুজন লেখকের ‘নির্বাচিত গল্পে’র অনুবাদ করতে পেরে সত্যিই আপ্লুত হয়েছি। এ ভাষার প্রতি বাঙালি সাহিত্যিক মহলে যে বিপুল আগ্রহ লক্ষ্য করছি, তাতে আমার ক্ষুদ্র এ প্রয়াস যে বিফলে যাবে না, সে বিশ্বাসও করেছি। তদুপরি মান্টো আর চুগতাই যে দুর্বোধ্য ঐতিহাসিক দুটি চরিত্র, সাহিত্যের পাঠকমাত্রই সে কথা জানেন। সেই শুরু সময় থেকে আমৃত্যু তাঁদের যে প্রেমপূর্ণ একটি গুপ্ত সম্পর্ক ছিল, শিল্পী সমাজে সে চর্চা বহুকালই অব্যাহত ছিল। উভয়ের কেউ যদিও কোনোদিনই এ কথা স্বীকার করেনি। তেমনি এমন স্পষ্টভাবে অস্বীকারও করেনি যাতে মানুষের সন্দেহগুলো দূরীভূত হতে পারে।

এক্ষেত্রে আমার যা মনে হয় তা হল: আসলে প্রেমের না বরং তাদের উভয়ের মাঝে অভূতপূর্ব এক বন্ধুত্বই ছিল। যেমন সম্পর্ক ছিল এলিয়ট আর এজরা পাউন্ডের। তাঁদের জগতটা যদি হয় বিংশ শতকের দুর্বার কবিতার, তাহলে মান্টো আর চুগতাই ছিলেন উর্দু গদ্যের পরাক্রমশালী বীরবিক্রম। তাই তাঁদের ভাবনা ও লেখার জগতটা ছিল প্রায় একই। ফলে তাঁরা যেন দূর থেকে মানুষের সেইসব কথাগুলো শুনতেন আর নিজেরা খুব হাসতেন। কেননা, দু’জনই ছিলেন পরস্পরের গুণমুগ্ধ। তাই মান্টো যেমন তাঁর ‘গাঞ্জে ফেরেশতে’ গ্রন্থে ‘ইসমত চুগতাই’ শিরোনামে স্বতন্ত্র গদ্য লিখেছেন। তেমনি চুগতাইও মান্টোকে নিয়ে লিখেছেন, তার সৃষ্টি সম্বন্ধে বলেছেনও বহু।

কাজেই, বিচ্ছিন্নভাবে এদ্দিন যারা মহান এ দুই লেখককে পাঠ করেছেন, আমার এই বই দুটি তাঁদের তৃষিত হৃদয়ের তরে কিছু অমৃত হবে বলেই বিশ্বাস করি। বিশেষত মান্টোর নিষিদ্ধ যে পাঁচটি গল্প আছে, তারই অনুবাদ একসাথে আছে এতে। আছে চুগতাইয়ের সবচেয়ে সমালোচিত ও দুরূহ গল্পগুলোর বেশ ক’টি।

এবার ‘তাহাদের কথা’ শিরোনামে দশ কবির সাক্ষাৎকার শিরোনামের বইটি সম্বন্ধে কিছু বলি। এ গ্রন্থের প্রতিটি শব্দই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি বাক্যেই পাঠকের জন্য কিছু না কিছু নিহিত আছে। যেন দীর্ঘ এক পাঠযাত্রারই ফসল আমার। বলছি না আমি খুব পড়ুয়া। আর এটা প্রকৃতপক্ষেই। তবে দিনের পর দিন ঘাঁটাঘাঁটি করে কবিদের জীবনের প্রতি আমার যে মোহ জাগ্রত হয়েছে, তারই ফসল এই বই। সর্বদাই বিশ্বাস করি, একজন লেখককে সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় তার আত্মজীবনী ও সাক্ষাৎকারে। ফলে যখনই কোনো কবি লেখকের আত্মজীবনী ও সাক্ষাৎকার পেয়েছি, তা না পড়ে ছাড়িনি। সেই হেতু বিগত দুই বছর যখনই সময় পেয়েছি, প্রিয় কবিদের সাক্ষাৎকারগুলো অনুবাদে ব্রত হয়েছি।

প্রাথমিকভাবে যা কবিতার প্রতি প্রেম থেকেই ছিল। কিন্তু একটা সময় পর সেই প্রেম কবিতাপ্রেমী সকল মানুষের কাছেই ছড়িয়ে দেবার বাসনা জেগেছিল। তা থেকেই মূলত এটিকে পুস্তকাকারে প্রকাশের প্রয়াস। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি  এবং আশা রাখি এই গ্রন্থটি কবিতা লিখতে আসা আমার মত বহু নবীনকেই সাহায্য করবে। তাঁদের চিন্তার জগত ও ভবিষ্যৎ কবিতার পথকে মসৃণ করবে। এর মাঝে ফ্রস্ট, দারবিশ, আদুনিস, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, আহমাদ ফারাজ, জন এলিয়ার মত কবিদের জীবনের আখ্যান রয়েছে। কী রোমাঞ্চকর কবিতার জীবন যে তাঁরা যাপন করেছেন—তারই গল্প আছে। একজন কবির জীবন যে বস্তুতই আশ্চর্যময় সেসব কথা আছে এখানে। ফলে এই বই কেবলই একটি অনুবাদকর্ম নয়। বরং তরুণদের জন্য কবিতার জগত বুননের অপূর্ব এক পাথেয়। যেখানে ছড়িয়ে আছে মুক্তোর মত কথামালা। অসীম সাহস ও দীর্ঘ এক যাত্রার ফয়সালা।

৯ জানুয়ারি, ২০২৪

ক্রমশ..

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *