- কাউসার মাহমুদ
ঢলে পড়া অপরাহ্ন। গরম এক কাপ চা নিয়ে ছাদে এলাম। চায়ে ‘নাঅনা’ পাতা দেয়া। তাতে উঞ্চ জলের মিশ্রণে বিশেষ এক স্বাদও অনুভূত হচ্ছে, যেমন পুদিনা পাতা দিলে হয়। এখানে লম্বা ছাদের ওপর চারটি রুম। ঢাকা শহরে যেটিকে সাবলেট বলে। আপাতত এখানেই আমাদের বসবাস। চার রুমে ভারতীয়, বাঙালি, ইয়ামেনিসহ মোট চৌদ্দজন মানুষের আবাস। সত্ত্বেও পূর্ব-পশ্চিম কোণে ইয়ামেনিরা দুটি ‘খিমা’ (তাবু) নির্মাণ করেছে। একটিতে থাকে আহমাদ আবু সালেহ। অন্যটিতে মুহাম্মদ আল-বান্নাহ। আহমাদেরটি চারপাশে কার্পেট আবৃত হওয়ায় সম্পূর্ণ অন্ধকার।
খুব মন দিয়ে যদি এ খিমার উপকরণগুলো দেখি, তাতে আছে, কামরার ফেলে দেয়া পুরনো ফরাশ। তারপর ওপরে কয়েকটি কাঠ পেতে, পুরু কাপড়, কার্পেট ফেলে, তার ওপর আবার কয়েকটি পাথর ও একটি ভাঙা চেয়ার। মোটকথা যা-কিছুই আমাদের পরিত্যক্ত, তারই জায়গা হয় ওই তাঁবুর ছাদে। যেন প্রবল বাতাসে কাপড় ও কার্পেটগুলো উড়ে না যায়। রাতে হিম বাতাসের উপদ্রব ভেতরে প্রবেশ না করে। তেমনি এর অন্দরে যা-কিছু অবিন্যস্ত ছড়িয়ে আছে সেগুলো হল : কতিপয় পুরনো পোশাক, কয়েকটি আধোয়া দীর্ঘ জোব্বা, কৌটাভর্তি তামাক, কিছু বৈদ্যুতিক তার, কয়েক জোড়া পা-মোজা, জাঙিয়া এবং পা ও মাথার কাছে রাখা কয়েকটি মোলায়েম তাকিয়া। ইতোপূর্বে বেশ কিছুদিন দুপুরে আহারের পর ওখানেই বিশ্রাম নিয়েছি। কিন্তু কিছুদিন হলো আহমাদ নেশাদ্রব্য গ্রহণ শুরু করেছে। ফলে ওর-ও মানা এবং আমারও অনীহায় ওর তাঁবুটি পরিত্যাগ করেছি।
এরপর থেকে বান্নার জরাজীর্ণ এই স্থানটিই আমার আশ্রয়। আশ্রয় বলতে অবসরে নিরালা থাকার আনন্দময় কেন্দ্র। এ তাঁবুর যুতসই কোনো বর্ণনা দেয়া যেতে পারে বলে মনে হয় না।
এরপর থেকে বান্নার জরাজীর্ণ এই স্থানটিই আমার আশ্রয়। আশ্রয় বলতে অবসরে নিরালা থাকার আনন্দময় কেন্দ্র। এ তাঁবুর যুতসই কোনো বর্ণনা দেয়া যেতে পারে বলে মনে হয় না। কেননা ছাদের প্রান্তঘেঁষা সোজা দুটি কাঠের কঞ্চি দিয়ে কার্ণিশের উদ্বৃত্ত রডের সঙ্গে সংযোগ দেয়া হয়েছে। তারপর তাতে দৈর্ঘ-প্রস্থে মোটামুটি বিস্তৃত একটা কম্বল সেঁটে ওটাকেই ছাদ হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। যেন কোনোরূপ আকাশটা দেখা না যায়। যেন সূর্য ও দিবসের আলো চোখে না পড়ে। এছাড়া দেয়ালের উত্তর-পূর্ব কোণ ব্যতিরেকে দু’পাশই উন্মুক্ত। ফলে হাওয়া এসে গায়ে লাগে।
দুপুরে রোদের সমস্ত তেজ পায়ের কাছে এসে হুটোপুটি করে। আপাতত এই হলো আমার গোপন আশ্রয় দু’টির সংক্ষেপ বর্ণনা। যেখানে একান্ত সময় কাটাতে আসি। যেখানে নিরুপদ্রব ক’টি মুহুর্ত কাটানোর অভিপ্রায়ে নিঃশব্দে এসে বসি। এতে করে খুব করে যে বিষয়টি অনুভূত হচ্ছে, তা এইরূপ অগোছালো নির্জন বিছানা কিংবা তাবুর প্রতি নিঃসঙ্গ পুরুষদের প্রেম। যেন অমোঘ এক আকর্ষণ বাঁধা আছে তাতে।
এসব স্থানগুলো অতীন্দ্রিয় এক টানে জড়িয়ে রাখে তাঁদের। ফলে কামরার পরিপাটি বিছানা নিস্পৃহ লাগে। গোছানো জায়গা, মানুষ এমনকি সুবিন্যস্ত পরিবেশ তাঁদের যতটা আকৃষ্ট করে, তার অধিক টান থাকে একটি নিশ্চুপ জায়গার প্রতি। যেখানে গৃহসজ্জার কোনো আসবাব নেই। সুশৃঙ্খলভাবে স্থাপিত কোনো অপূর্ব বস্ত নেই। এমনকি প্রয়োজনে যেসব জিনিস লাগে, সেসবেরও নূন্যতম বালাই নেই। বরং কোনোকিছু ঠিকঠাক না থাকা, একটা অপর্যাপ্ততা, একটা বিশ্রী বায়বীয়তাই এসব পুরুষদের আমোদিত করে। জগতের হৈহল্লা থেকে কিছুক্ষণ আলাদা রাখে।
আসলে অসংখ্যবার এমন মনস্তাত্ত্বিক কথাবার্তা ভেবেছি। এজাতীয় নীরব সঙ্কুচিত অবিন্যস্ত স্থানের প্রতি আপন প্রেম দেখে, প্রথম দিকে নিজের অভিরুচি নিয়েও শঙ্কিত হয়েছি৷ তারপর ক্রমেক্রমে এই দ্বিধা দূর হয়েছে। বুঝতে পেরেছি ভাবুক মানুষদের বেঁচে থাকার এ-ও এক পথ। কীভাবে নিস্তব্ধতার নির্যাস আহরণ করে সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত করা যায়—তারই অনুশীলন হয় এতে। ফলে এ অভিন্ন হতে পারে, কিন্তু অদ্ভুত নয়। এমন বোধ অভিনব হতে পারে, তবে জনবিচ্ছিন্ন নয়। কেননা এই নিয়ে যখন ভেবেছি, তখন বহু শিল্পীর জীবনই ঘেঁটে দেখেছি। তাঁদের লেখাপত্রে এজাতীয় নিঃসঙ্গ পুরুষদের যাপনের চিত্র খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও হৃদয়কে আসক্ত করতে পারিনি ।
তা-ই আমিও একদিন পথহারা পথিকের মত হঠাৎ আলোর দিশাও পেয়েছি। সমুদ্রের ধারে পড়ে থাকা কিমতি প্রবালের মত একটি গল্পে সেসব নিঃসঙ্গ পুরুষের একটা আদিগন্ত চিত্রই সন্নিবেশিত দেখেছি
পাঁজর খামচে ধরলে যেমন অনুভূত হয়, সেভাবে খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থই হয়েছি সাধারণত। কিন্তু সমস্ত গল্পই যেহেতু লেখা হয়েছে। যেহেতু সকল কথাই বলা হয়েছে। তা-ই আমিও একদিন পথহারা পথিকের মত হঠাৎ আলোর দিশাও পেয়েছি। সমুদ্রের ধারে পড়ে থাকা কিমতি প্রবালের মত একটি গল্পে সেসব নিঃসঙ্গ পুরুষের একটা আদিগন্ত চিত্রই সন্নিবেশিত দেখেছি। এজাতীয় পুরুষের মনোভাব কী? কেমন ছন্নছাড়া হয়ে তারা আরাধনা করে তারই এক বর্ণনা আছে এতে। মহান মান্টোর ঐতিহাসিক خالی بوتلیں خالی ڈبے গল্পে। এটি পড়ার পর সেই যে এসব জরাজীর্ণ সজ্জাহীন নির্জন জায়গার প্রেমে পড়লাম, তা আর বিদূরিত হয়নি। এ এমন গল্প, এমন আখ্যান—মান্টো যাতে সম্পূর্ণ লাগামহীন। কসাই যেভাবে একটা তরতাজা ছাগকে লোহার আঙটায় ঝুলিয়ে সম্পূর্ণ চামড়া ছিলে নেয়, এতে মান্টোও সে ভূমিকায়।
একজন নিঃসঙ্গ পুরুষের মনস্তত্ত্ব ও জীবনকে বিশ্লেষণ করতে করতে মান্টো যা করেছেন, তা পূর্ণ একটা ছায়াছবি। যে ছবির সম্মুখে বসলে কখনো কখনো নিজের জীবনটাও ফুটে ওঠে। নিজের শেষ পরিণতি সম্বন্ধে এতটুকু সন্দিহান না হয়ে, কেবলই ধূসর মহাসড়কে চলে যাওয়া যেতে পারে। তাতে হয়তো আক্ষেপ, হয়তো প্রেম নিয়ে—উভচর পাখির মতো যেকোনোভাবেই বিচরণ করা হতে পারে।
তবে এখানে বসতেই আজকাল যে বিষয়টি সবচেয়ে প্রবলভাবে নাড়া দেয়, তা একটি উপন্যাস রচনার ইচ্ছে। হিসেব করে দেখলাম আমার মৌলিক কাজের চেয়ে অনুদিত কর্মই বেশি। অথচ সর্বদা মৌলিকেই নিমগ্ন হতে চেয়েছি। এই হেতু ইদানিং মৌলিকেই ব্রত হতে চাইছি। কিন্তু হায়! এতোটা পথ পেরুনোর পর, লেখালেখির একযুগ পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন একটি গল্প লিখতে বড্ড ভয় করে। কোনো উপন্যাস হাত দেব ভাবলে আতঙ্কে হৃদপিণ্ড শুকিয়ে যায়।
ভাবি, একটা মৌলিক গল্প, একটা মৌলিক উপন্যাস যে নিমগ্নতার দাবি রাখে, তা কি আছে আমার? সেসবে যে ধৈর্য যে জ্ঞান যে অধ্যবসায় যে কল্পনা যে ভাষার গতিময়তা অনিবার্য, তা কি এখনও রপ্ত হয়েছে? কেননা কেবল আত্মশ্লাঘা ছাড়া কিছুই তো অর্জন হয়নি আমার! ফলে এমন এক ভয় সর্বদাই তাড়িত করছে আমায়।
অথচ সেই কত বছর আগে, শুরুতেই আমি উপন্যাসে হাত দিয়েছিলাম। কিংশুক নামে একটা উপন্যাস বহুদিন ওপার বাংলার বাখোয়াজি ওয়েবজিনে ধারাবাহিক ছেপেওছিল। তারপর সময়ের আবর্তে কৈশোরিক সে উত্তেজনায় ভাটা পড়ে। বয়সের দিক থেকে সাবালক হওয়ার সাথেসাথে পড়াশোনায়ও সাবালকত্ব অর্জনের প্রচেষ্টা করেছি। তাতে করে স্বাভাবিকভাবেই ওসব রচনার প্রতি অনীহা জাগে।
আমাদের মত মধ্যম পর্যায়ের মেধাবীদের সৃষ্টির দুয়ার কেবল পরিশ্রমেই খুলতে পারে। কেবল চর্চাই আমাদের ধারালো ছুরির মত শাণিত করতে পারে
বুঝতে পারি, দীর্ঘ এক যাত্রা পাড়ি না দিয়ে মহৎ কোনোকিছুই সৃষ্টি সম্ভবপর নয়। আমাদের মত মধ্যম পর্যায়ের মেধাবীদের সৃষ্টির দুয়ার কেবল পরিশ্রমেই খুলতে পারে। কেবল চর্চাই আমাদের ধারালো ছুরির মত শাণিত করতে পারে। নতুবা পদেপদে বিভ্রান্তি ঘিরে ধরবে। বোধবুদ্ধি ও বিদ্যার অপরিপক্কতা রচনায়ও প্রতিফলিত হতে পারে। অতএব একটা মহত্তর মৌলিক সৃষ্টির জন্য আমার এই যে ভয়, এই যে অপেক্ষা—নিশ্চয় কোনোভাবেই তা অহেতুক নয়। আমি বরং এই নির্জনে বসে বসে আরও ভাবতে চাই। আরও নিগূঢ়ভাবে আমার সৃষ্টির সাথে মিশে যেতে চাই। এমন ঢলে পড়া অপরাহ্নের মত আমার সমস্ত রচনায় দৃঢ়তার সাথে বিছিয়ে থাকতে চাই।
ক্রমশ..
২৯ ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার।
লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক