আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ২৫

আরবের দিনলিপি ।। পর্ব- ২৫

বহুদিন পর পর যখনই এই লেখাটি লিখতে বসি, তখন অজান্তেই অনেক কিছু বদলে যায় মনে হয়। অনেক ঘটনা ঘটে। আমার বিচিত্র যাপন আর অস্থির মনোভাব মিলেমিশে একটা পরিপূর্ণ গল্পই হয়ে যায় বটে। কখনো কখনো সেই গল্পের হাত-পা, মাথা কিছুই থাকে না। থাকে না নির্দিষ্ট কোনো সূচনা বা সমাপ্তি। তবু সেসবই বড় আপন লাগে। গালে হাত রেখে কি’বা দৃঢ়চিত্তে বলতে পারি, সময় হন্তারক নই আমি। এই তীব্র বেঁচে থাকার ভেতর যেটুকু মুহুর্ত পাই, হৃদয়টাকে পলিমাটির অনুরূপ আর্দ্র করে সৃষ্টিশীলতার কোনো না কোনো বীজ ঠিকই বুনে দিতে চাই। ফলে আমার যা-কিছু আক্ষেপ হঠাৎ অগ্নিচূর্ণের মত ছলকে ছলকে উঠে, আমার নিবিড় আরাধনা ও শিল্পকর্মই তা বোশেখের ঝড় পরবর্তী কোমল প্রকৃতির মত প্রশমিত করে। বিগত বেশকিছু দিন ধরে মনের এই অবস্থা নানাভাবে বিকীর্ণ হয়েছে। পূর্বের তুলনায় কিছু স্থিরতা এসেছে। এই দূরদেশে সেই গাড়ি দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে হঠাৎ আমার যে ভয়ানক অবস্থা হয়েছিল, আর্থিক যে ভীষণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম, ক্রমশই তার কিছুকিছু কাটিয়ে উঠেছি।

এগুলো যখন ভাবি, তখন সবকিছু কেমন দৈব মনে হয়। আমার রবের প্রতি আমার বিশ্বাস বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। সুদৃঢ় পাহাড়ের মত অনড় অবিচল হয়ে তা মনেপ্রাণে স্থায়ী হয়। যে প্রেম, যে ভালোবাসা তার প্রতি জাগে, সঙ্কট ও সমাধানের সেই মুহুর্তগুলোয় তা যেন আরো প্রবলভাবে সঞ্চারিত হয় ৷ প্রকৃত সত্যিটি বুঝি তখনই সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করি যে, একমাত্র তিনি, একমাত্র তিনিই আপন। তিনিই আমার দুর্দশাকে সুখের আনন্দে রূপান্তর করেন। আমার মন্দ সময়গুলো সুস্থির তিনি ছাড়া আর কেই-বা করতে পারেন? আমি যে সময় ও অর্থের অপচায়কারী নই, তিনিই তো জানেন। বিপদাপন্ন হয়ে বারবার যে তাকে ডাকি, তিনিও যে দাসের সেই ডাকে সাড়া দেন, বিগত ক’টা দিন সেসবের ভাবনাতেই তো দিনমান পড়ে আছি। ভোরের তীব্র কিরণ যেভাবে রাতের সমস্ত আঁধারকে দ্রবীভূত করে দেয়, তেমনি তাঁর দয়ার দৃষ্টিও যেন আমার সঙ্কটগুলো ক্রমশ মুছে দিচ্ছে। ভীষণভাবে একটা কথাই মনে পড়ছে যে, অতিসত্বর আমার প্রভু আমাকে পার্থিব সঙ্কট থেকে মুক্তি দেবেন।

প্রকৃত সত্যিটি বুঝি তখনই সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করি যে, একমাত্র তিনি, একমাত্র তিনিই আপন। তিনিই আমার দুর্দশাকে সুখের আনন্দে রূপান্তর করেন।

নইলে এই প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, দুর্ঘটনার পর আর্থিক দেনাসহ যে ভীষণ মনোবেদনায় জর্জরিত হয়ে ছিলাম, হঠাৎ মুহাম্মদ আলি সাবেত কেন এতগুলো অর্থ উপহার দিয়ে আমায় সাহায্য করবেন? কেনইবা সৌদি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি দাওয়াহ প্রকল্পে সুদীর্ঘ ছয় মাসের একটি সম্মানজনক কাজে আমার নাম প্রস্তাবিত হবে? যেখান থেকে মাসিক একটা মাসোহারাও ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেনইবা আমার বন্ধু রাজীব ভাই বারবার আমার জন্য উপযুক্ত একটা কাজ জোগাড়ের চেষ্টা করছেন বলে আমাকে আশ্বাস দিচ্ছেন। এ সবকিছুই কি মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে আমার প্রতি তাঁর দয়া নয়। তাঁর এই কথারই বাস্তবতা নয় যে, ‘ইন্না মা’আল উছরি ইয়ূছরা/ নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’

এই তিনটি স্বস্তিকর ঘটনার প্রথমটি ঘটে রোজার শেষ দিকে। আমার কাছে যেটি التعويض من الله বা ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদানের’ই সুস্পষ্ট ব্যখা বলে মনে হয়। তখন ঈদের কয়েকটা দিন বাকি আছে মাত্র। হঠাৎ এক রাত আমার কর্মস্থলে মুহাম্মদ বিন সাবিত আসে। এই সে সাবিত—পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেন যার জন্য আমার প্রার্থনা অব্যাহত থাকবে। যে ক’জন সৌদি মানুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হয়েছে, সাবিত তাদের একজনই। সেদিনের সেই অতগুলো টাকার আর্থিক উপহারই নয়, ইতোপূর্বেও নানাভাবে সে সহযোগিতা করেছে আমায়। যথেষ্ট পড়ুয়া যুবক। বহু বিষয় সম্বন্ধেই জ্ঞান রাখে। সৌদিদের অপচয় ও আজকালকার আচরণের তীব্র সমালোচনা করে। তা সেদিন এসে একটি কথাও বলার সুযোগ না দিয়ে, আমার হাতের মুঠোয় অতগুলো টাকা গুঁজে দেয় সে। প্রথমত বিষয়টি আমাকে হতবুদ্ধ করে, তারপর বাকরুদ্ধ। তদুপরি নিজেকে কিছুটা স্থীর করে বহুভাবে সে অর্থ আমি তাকে ফিরিয়ে দিতে চাই। কিন্তু না! কোনোভাবেই সে নেবে না। আমাকে বলে, ‘দেখো! সামান্য দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে আর্থিক যে ক্ষতির সম্মুখীন তুমি হয়েছ, একজন বন্ধু হিসেবে সেই কঠিন অবস্থাটি কাটিয়ে উঠতে আমি কি তোমায় এই সাহায্যটুকু করতে পারি না?’

‘দেখো! সামান্য দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে আর্থিক যে ক্ষতির সম্মুখীন তুমি হয়েছ, একজন বন্ধু হিসেবে সেই কঠিন অবস্থাটি কাটিয়ে উঠতে আমি কি তোমায় এই সাহায্যটুকু করতে পারি না?’

-বন্ধু মুহাম্মদ বিন সাবিত

জবাবে আমি আর তার প্রতুত্তর করি না। আনন্দে আমার দু’চোখে জল এসে যায়। ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটু বসতে বলতেই, আরেকদিন আসবে বলে চলে যায়। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আমার মানফালুতির ‘সাইয়্যাদ’ (জেলে) গল্পটির কথা মনে পড়ে। সম্প্রতি যে অপূর্ব গল্পটি পড়তে পড়তে অনুবাদ করে ফেলেছি আমি। বিশ্বাস করি, যেকোনো পাঠকেরই গল্পটি ভালো লাগবে। বিশেষত,যারা জীবন নিয়ে নানা অজুহাত তৈয়ার করে। না পাওয়া, অতৃপ্তি ও অতিরঞ্জিত কামনা যাদের হৃদয়কে আবৃত করে রেখেছে, এই গল্প তাদের চক্ষু উন্মোচন করে দেবে। আহা! গল্পে মাঝির কী প্রজ্ঞাপনূর্ণ সরল জীবনের উপলব্ধি। সেই উপলব্ধি ও পূণ্যময় কথাগুলির মালাটি যেন আমার বন্ধু সাবিতই পরিধান করে আছে তার জীবনে। তাই বুঝি সেদিন ওর চলে যাওয়ার সাথেসাথে গল্পের সেই জেলের কথাই মনে পড়ল। জেলেটি যেভাবে গল্পে তার মাছের গ্রাহকককে আশীর্বাদ করেছে, আমার হৃদয় থেকেও সেই অনুরূপ প্রার্থনা বেরিয়েছে সেদিন। যেন সেই প্রার্থনার শব্দগুলো এখনো আমার কানে উচ্চকিত হচ্ছে। এখনও আমার হৃদয় মথিত করে বেরুচ্ছে যে, ‘আল্লাহ আপনার ওপর অনুগ্রহ করুন, যেভাবে আপনি আমাকে অনু্গ্রহ করেছেন। এবং তিনি আপনাকে হৃদয়ের সুখ দান করুন, যেভাবে আপনার অর্থকে আপনার সুখের উৎস করেছেন।’

সেই সাথে মহান আল-বুহতারির কবিতার এ চরণ ক’টিও স্মৃতিতে ভেসে ওঠল। যেন সাবিতের জন্যই আমার দু ঠোঁট আমার অজান্তেই পাঠ করছে। কাম সাদিকীন আররাফতুহু বি-সদিকীন সা'রা আহযা মিনাস সাদিকীল আতিকী ওয়া-রাফিকীন রাফাকতহু ফি-তরিকীন সা'রা বা'অদাদ্ তরিকী খাইরা রাফিকীন।

—আল বুহতারি
(কত বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়েছি তারে
পুরনো বন্ধুর চেয়েও যে সম্মানি হয়ে উঠল পরে
আর সে এক বন্ধু—যাকে করেছিলাম পথের সহচরী
চলতে চলতে পথের পরে, সে-ই উঠল হয়ে শ্রেষ্ঠ সঙ্গী।)

২৪ মার্চ রোববার, ২০২৪

লেখককবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *