আরবের দিনলিপি (পর্ব-৩)

আরবের দিনলিপি (পর্ব-৩)

কাউসার মাহমুদ একজন কবি, লেখক ও কারুকার্যশীল অনুবাদক। সৌদি আরব প্রবাসী। নানা রকম অভিজ্ঞতায় গুজরানো সময়গুলোকে ‘আরবের দিনলিপি নামে’ অক্ষরবৃত্তে তুলে ধরেছেন পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকমে’র পাঠকদের জন্য। সেই ধারাবাহিকতার আজ ৩য় পর্ব।

আরবের দিনলিপি (পর্ব-৩)

একই অনিয়ম অব্যাহত। দিনলিপিতে কোনোরূপেই ধারাবাহিক হতে পারছি না। গতকাল রাতে লিখব ভাবলাম, সে লেখা লিখছি আজ দুপুরে। মূলত ফিলিস্তিনের ভূমিতে জন্ম নেয়া আরবি সাহিত্যের অমিত সম্ভাবনায় এক লেখক শহীদ গাসসান কানাফানির একটা সাক্ষাৎকার অনুবাদ করে শেষ করলাম গতকাল। প্রায় পাঁচ হাজার শব্দের এক আশ্চর্য কথোপকথন।সাক্ষাৎকারটি شؤون فلسطينية এর ছত্রিশতম সংখ্যায় জুলাই ১৯৭৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। তারপর رمان الثقافية সাময়িকী ২০২২ সালে পুনরায় এটি ছাপলে Samidoun, Palestinian prisoner solidarity network ওয়েবজিনে ইংরেজি ট্রান্সলেশনে প্রকাশ পায়। কানাফানিকে নিয়ে ইতঃপূর্বে যদিও অল্পবিস্তর পড়াশোনা ছিল । তাঁর সামগ্রিক লেখাপত্রও খুঁজে দেখা হয়েছে। কিন্তু বহুদিন পর আচমকা তাঁর এই ইন্টারভিউটি পেলে, সত্যিই আপ্লূত হই।

মূলত এমন দীর্ঘ সাক্ষাৎকারগুলো সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। এতে একজন লেখকের বিশ্বাস, তৎকালীন জীবন ও ইতিহাসের খুব পরিস্কার একটি চিত্র পাওয়া যায়। উপন্যাস ও গল্পের চেয়ে সাক্ষাৎকারে যে চিত্রগুলো অধিকতর পরিচ্ছন্ন হয়ে ফুটে ওঠে। সুতরাং যা ভেবেছি তাই। মানে সাক্ষাৎকারেও কানাফানি তাঁর সংগ্রাম ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছেন। প্রতিটি প্রশ্নোত্তরে এমন দৃঢ়তা, এমন প্রতিজ্ঞা ও আশাবাদ—যা পড়তেই আশ্চর্য এক বিশ্বাসের জন্ম হয় নিজের ভেতর। সেইসাথে গ্রাস করে গোপন একটা হাহাকারও। ভাবি, একজন লেখক কতেটা রাজনীতিসচেতন ছিলেন! কী নির্ভীক ছিল তাঁর কলম। সাকুল্যে অল্প ক’বছর মাত্র লেখার জীবন। অথচ কী বৈচিত্র্য তাতে। তাঁর গল্প, উপন্যাস, নিবন্ধ—প্রতিটি লেখাই যেন বিপ্লব। প্রথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। আবার সম্পাদনা করেছেন জর্জ হাবাশ প্রতিষ্ঠিত palestine popular front’র তুমুল আলোচিত পত্রিকা ‘আল হাদাফ।’ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাথমিকভাবে যে পত্রিকার প্রভাব অতি গুরুত্বপূর্ণ।

বস্তুতপক্ষে, লেখকদের এমনই হতে হয়। ফলে একজন লেখকের যাত্রা কী? তাঁর দায়বদ্ধতা, দেশ ও সমাজের প্রতি তাঁর নিবেদনসহ—ইত্যকার বিষয়ে আজকাল মনে প্রশ্ন জাগছে খুব। এতকাল শিল্পচর্চার নামে শুধুই একমুখী যে ভাবনা আমার ছিল, জীবন ও প্রকৃতিকে ঘিরে যে কোমলতা প্রদর্শনে মনোযোগী হয়েছিলাম—সে ভাবনায় ছেদ পড়েছে। এখন বিশ্বাস করি, কোনও ভাষার লেখক যদি সে ভাষার জনমতকে বুঝতে না পারে। তাঁদের সঙ্কটগুলো বৈশ্বিকভাবে তুলে ধরতে না পারে। তাহলে সে লেখক প্রকৃতার্থে একটি গণ্ডিতেই আবদ্ধ। সুতরাং রচনায় আমাদের উপলব্ধিকে আরও তীক্ষ্ম করতে হবে। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি এবং কোনও মতাদর্শের তোয়াক্কা না করে সত্যের কথা বলতে হবে।

কী আশ্চর্য ব্যাপার! এই লেখা যখন লিখছি, কয়েকঘন্টা পূর্বেই আজ আবার ফিলিস্তিন ইসরায়েলের যুদ্ধ সংবাদ পেলাম। যখনই এই সংবাদ শুনি আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠে। ভাবি এর শেষ কোথায়? এই প্রহসনের শেষ কবে। একটা দেশ তার নিজ ভূমিতেই অধিকৃত? বিগত সত্তর বছর ধরে একটা জাতি যেভাবে টিকে আছে, ইতিহাস কি এর মূল্য দেবে না? আমার পূর্ণ বিশ্বাস, অবশ্যই দেবে। ফিলিস্তিন আযাদ হবে।কিন্ত তা হবে একটা বিস্তৃত রক্তের নদী পেরিয়ে। কারণ, মিত্রতা। মানে ইসরায়েল যেভাবে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন পায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিলিস্তিন তার সিকিভাগও দেখে না। সমর্থন বলতে অবশ্যই সামরিক সাহায্য। নইলে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ তো নিত্যই ফিলিস্তিনের সমর্থনে মিছিল করছে। একতাবদ্ধ হয়ে ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে মানববন্ধন করছে৷ কিন্তু আদতে এর মূল্য কী? কেবলই ভালোবাসা দিয়ে কি যুদ্ধ জয় সম্ভব? হানাদার ইয়াহুদিদের তাড়ানো সম্ভব? নিশ্চয় না। ফলে অবশ্যাম্ভাবীরূপে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে একত্রিত হতে হবে। ফিলিস্তিনের প্রতি মিত্রতার হাত নির্দ্বিধায় বাড়িয়ে দিতে হবে। তাই এবারের যুদ্ধের সূচনা যদিও হামাসের পক্ষ থেকে। যদিও হামাস ইসরায়েলের ওপর এযাবৎকালের সেরা আক্রমণের একটি করেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমি এতে উদ্বিগ্নই। কেননা এরপর ইসরায়েল যা করবে, তা অকল্পনীয়। সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ও কূটনৈতিক সাহায্য এ মুহূর্তে আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে আবশ্যকতা তাদের জন্য সৌভাগ্যের। আনন্দ ও ইতিহাস রচনার।

৯/১০/২৩

(চলবে..)

লেখক: কবি, গদ্যশিল্পী ও অনুবাদক

এই ধারাবাহিকের পূর্বের লেখাগুলো পড়ুন:

১. আরবের দিনলিপি (পর্ব-১)
২. আরবের দিনলিপি (পর্ব-২)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *