আরবের দিনলিপি (পর্ব-৪)

আরবের দিনলিপি (পর্ব-৪)

কাউসার মাহমুদ একজন কবি, লেখক ও কারুকার্যশীল অনুবাদক। সৌদি আরব প্রবাসী। নানা রকম অভিজ্ঞতায় গুজরানো সময়গুলোকে ‘আরবের দিনলিপি নামে’ অক্ষরবৃত্তে তুলে ধরেছেন পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকমে পাঠকদের জন্য। সেই ধারাবাহিকতার আজ ৪র্থ পর্ব।

দুটি বিশেষ ঘটনা ঘটেছে আজ। দুটিই পরস্পর সম্পর্কিত। প্রথমত ভোর থেকে حامد احمد طاهر এর من وصايا الرسول صلي الله عليه وسلم পড়ছি। শিশুকিশোরদের জন্য চমৎকার একটি বই। তদুপরি নবীজীর বাণী তো জীবনের সর্বত্রই অনুকরণীয়। তাই যারা আরবি পারে, বয়সের তারতম্য এড়িয়ে এ পুস্তক সবার জন্যই উপকারী। সুখপাঠ্য এবং আকর্ষণীয়। বস্তত মাঝে মাঝে অত্যন্ত ভারি লেখাপত্র ছেড়ে এমন সব বই পড়া দরকার। যা পড়লে বিমলানন্দে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। আচরণ ও যাপনে পরিবর্তন আসে। যে পরিবর্তন হবে রাসূলের বিধৃত পথে। যা মানলে নিশ্চিত নিজেকে উন্নীত করা যাবে মনস্বীদের কাতারে। চিন্তা ও মননে আসবে প্রফুল্লতা। কর্ম ও জ্ঞানে বাড়বে সুস্থীর গাম্ভীর্যতা। সুতরাং পরিমিত বর্ণনা-কৌশল আর নির্মল রচনাশৈলীতে বইটি বড় উপাদেয়। আরবি ভাষার প্রতি উৎসুক যে কেউ বইটি নেড়েচেড়ে দেখতে পারেন।

এখন বলি দ্বিতীয় ঘটনার কথা। তা উপরোক্ত বইটির প্রথম পরিচ্ছদই হল حسن الخلق বা সদাচার বিষয়ে। যেখানে অপূর্ব কায়দায়, ছোটো ছোটো বাক্যে সদাচারের গল্প বলা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে আয়াত ও হাদীস। যা পাঠ করে স্বভাবতই পুলকিত হয়েছি। দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করেছি আর মনোমালিন্য নয়। কারও সঙ্গে অসদাচার নয়। কটু কথা পরিত্যাজ্য। সমস্ত রূঢ়তা পরিত্যাগ করে, সদা সহাস্যমুখে থাকা।

কিন্তু হায়! এই যখন আমার মনোবাঞ্ছা, তখন কর্মস্থল থেকে উপরে গিয়ে দেখি অদ্ভুত এক কাণ্ড। দুটো টয়লেটের একটি তালাবন্ধ। মূলত যেখানে থাকি, সেখানে পনেরোজন মানুষের জন্য মাত্র দুটো বাথরুম। এতকাল ধরে সবকিছু ঠিকই চলছিল। সকলেই বড় আনন্দে জীবন অতিবাহিত করছিল। মাত্র দুটো স্নানাগার। তবু কোনোদিন কারও মাঝে বিবাদ তো দূর কি বাত, তীর্যক কথারও আদানপ্রদান হয়নি। শুনেছি বিগত বিশ বছর ধরে এ ধারাতেই চলছিল এখানে। কিন্তু হায়, যবে থেকে নতুন ছ’টি বিহারি শ্রমিক এল, তবে থেকে ঝঞ্ঝাট শুরু হল। এই প্রথম তালা পড়ল একটা বাথরুমের দরজায়। মূলত কোম্পানির শ্রমিক হওয়ায়, নিজেদের সবকিছু আলাদা করে নিতে চাইছে ওরা। যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। একদণ্ড বসে ব্যাপারটি নিয়ে ভাবলে, নিজেরাই লজ্জায় অধোমুখী হবে । কী বিচ্ছিরি কাণ্ড! ভাবতেই কেমন অস্বস্তি লাগছে আমার। এতকাল শুনেছি, মানুষ জমিজিরাত নিয়ে ঝগড়া করে। কিন্তু শৌচাগার নিয়ে কি কেউ বিতণ্ডা করতে পারে? তাও আবার পরদেশে। যেখানে প্রায় সবকিছুই সীমিত ! সকলের জন্যই যা ভবন-মালিক কর্তৃক বরাদ্দ।

অথচ, এ তো দেখছি রীতিমত জবরদস্তি। তা-ও নিজেদের বরাদ্দকৃত শৌচাগারখানা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে হত। কিন্তু না! দখলকৃতটিতে তালা ঝুলিয়েছে যদিও। অন্যদিকে যেহেতু সাতজন , তার ওপর কারও কখন আচমকা চাপলে, বারবার তালা খোলার যন্ত্রণা নেবে কে? তাই একটাতে তালা ঝুলেই থাকে, আর হরদম ফাঁকাটিতে ওরা যেতেই থাকে। একবার ভাবুন তো, কীরকম কাণ্ড এদের!

ফলে সমস্ত দিন ধরে এ কথাই ভাবছি আজ। প্রত্যুষে যে সদাচারের পাঠ নিয়েছি, এঁদের এমন কাণ্ডে কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত? রূঢ়ভাষী হব কি? বিবাদে জড়াব? না-কি কোমল স্বরে সামাজিকতার বিষয়গুলো বোঝাব! উচিত যাই হোক, ব্রত নিয়েছি স্থির থাকব। কেননা যুক্তি যেখানে অর্থহীন, মূঢ়তাই সেখানে শ্রেয়। অধিকন্তু ওদের স্বদেশী ভিন্ন রাজ্যের বহু লোকের কাছেই শুনেছি, ‘এক বিহারি ছো বিমারি।’ তথা একখান বিহারি একশো উপদ্রব সৃষ্টিতে পারদর্শী। ফলে যাবতীয় সংঘাত এড়াতে আপতত নীরবতাই মেনে নিলাম। তথাস্ত বলে ওদের এই অহেতুক ক্রিয়াকর্ম সহ্য করে গেলাম। ওরা যতোটা ক্রূর হবে, বিপরীতে আমি হব ততোটাই কোমলচিত্ত। এতে দুটো লাভ দেখছি। এক, ওরা বুদ্ধিমান হলে শুধরে যাবে। দ্বিতীয়ত, আমার আত্মসংযম বৃদ্ধি পাবে। অহমিকা দূর হবে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে এজাতীয় পদক্ষেপ নিয়ে খাঁটি মানুষে রূপান্তিত হওয়া যাবে। সাথে ওদের জন্য থাকবে অকাতর প্রার্থনা। যেন প্রতিনিয়তই বলবো : প্রভু ওদের মঙ্গল করুন। ওদের সুবুদ্ধি দান করুন।

১০/১০/২৩

(চলবে…)

লেখক: কবি, গদ্যশিল্পী ও অনুবাদক

এই ধারাবাহিকের পূর্বের লেখাগুলো পড়ুন:

১. আরবের দিনলিপি (পর্ব-১)

২. আরবের দিনলিপি (পর্ব-২)

৩. আরবের দিনলিপি (পর্ব-৩)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *