আরবের দিনলিপি – ১১

আরবের দিনলিপি – ১১

  • কাউসার মাহমুদ

গতরাতে তিন ঘণ্টার অবসর পেলাম। এমন যখনই ঘটে, আনন্দে হংসীছানার মত হৃদয়টা নাচতে থাকে। কী ছেড়ে কী করি— লিখব, পড়ব না পুরনো লেখাগুলো সম্পাদনা করব—তারই এক দ্বিধা কাজ করে মনে। এই যুদ্ধে গত কাল ‘পাঠ’ই বিজয়ী হল। ভেবেছি হাতে রাখা শিশু সাহিত্যিক  ইয়াকুব শারুনির হ্রস্বকায় বইটি শেষ করেই লিখতে বসব। কিন্তু তা আর হল কই! যখনই রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’ পড়তে বসলাম, প্রবল এক মোহাচ্ছন্নতা গ্রাস করে নিল। এর বিস্তারিত  বিবরণ পরে বলছি। বরং শিশুসাহিত্য প্রসঙ্গে  দুটি কথা এখানে বলি।

বিষয়টি হল, গত কয়দিনে পরপর দুজন আরব শিশুসাহিত্যিকের তিনটি বই পড়লাম। তাঁরা আহমাদ নাজীব আর ইয়াকুব শারুনি। এই পাঠ-যাত্রায় তাঁদের লেখনীর সারল্যের বিষয়টি চোখে ধরা দিল। অর্থাৎ, শিশুদের জন্য যা-কিছু লেখা হয়, তাতে সহজতাই প্রধান। অধিকন্তু এও মনে করি এই কর্মটি বড় কঠিন। বহু লেখকই শিশুদের জন্য লেখেন, তবে সবচেয়ে উপাদেয় তাঁরাই, যাঁদের গল্পটি সহজ। ভাষাটি মেদুর। চরিত্রগুলো নিটোল। এসবে শারুনির তুলনায় নাজীবকে শক্তিমান মনে হল। মনে হল নাজীবের বলার ধরনটি প্রাবল্যবর্জিত। ব্যবহৃত শব্দরা পরিচিত। স্বল্প পাঠের শিশুরাও যা চেনে। ঠিক যেন শিশুসাহিত্যের আলেকজান্ডার কামেল কিলানীর কাছাকাছি। কিংবা কোথাও তাঁর চেয়েও একটু অকপট। সহজপাচ্য।

এরপর এল সেই ক্ষণ। যখন আলস্য চেপে ধরল। বাইরে ক্ষীণ বৃষ্টির শব্দ ধ্বনির মত বাজতে লাগল। কামরার সামনে বিদ্যুতের উজ্জ্বল কৃত্রিম আলোর নীচে দুরন্ত বর্ষণের মত যা চোখে ধরা দেয়। মনে হয় উপর থেকে ভূমিতে প্রবলবেগে কিছু ধেয়ে আসছে। কিছু নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। একটু দূরেই আঁধারে যা সম্পূর্ণ দৃশ্যহীন। ফলে এমন শীতল অবসরে দেহমনে যে অবস্থাটি গ্রাস করল, তা আর কোথাও স্থির হয়ে বসতে দিল না। আহারাদি সেরে সোজা বিছানায় গেলাম। লেখাপত্র মুলতবি করে সেই যে ছিন্নপত্র নিয়ে কাত হয়ে শুলাম, তার ইতি ঘটল মধ্যরাতে। ঘড়ি দেখে সচকিত হই। রাত্রি বারোটা পেরিয়েছে। অথচ, দীর্ঘ এই সময় কী এক বেঘোর সন্তোষে যে তলিয়ে ছিলাম—তার কোনও তুলনা হয় না। পাঠের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠা কিংবা গল্পের চাল শেখার জন্য একজন বাংলাভাষী লেখকের সর্বদাই রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরতে হয়। এই প্রত্যাবর্তনটি বিভিন্ন পর্যায়ে হতে পারে। কেউ যাত্রার মধ্যিখানে ফেরে। কেউ শেষে। কেউ নিরবিচ্ছিন্ন তাঁকে পাঠ করে যায়। আজ নিজের ব্যাপারেও এমন এক বোধ উপলব্ধি হল। মনে হল বিগত পাঁচ ছ’ বছর  একটিবারও তাঁর লেখাপত্র বিশেষভাবে পড়া হয়নি। কিন্তু নিশীথের এই নিস্তব্ধতায় আজ যখন ‘ছিন্নপত্র’ পড়ছি, আনন্দময় বেদনাবোধে আক্রান্ত হচ্ছি। এর তুলনাটি তেমন, যেমন আবেগের  আতিশয্যে মানুষের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। কেননা একজন তরুণ লেখক হিসেবে যে বিবেচনা আজকাল জাগ্রত হয়েছে। যে চিন্তায় তাড়িত হই। যে বোধে আক্রান্ত হয়ে পড়ে থাকি। যে রুচিতে শিল্পের বিভিন্ন দিক বিচার করি। যে দৃষ্টিভঙ্গিতে আর্টের এই জগতটাকে পর্যবেক্ষণ করি, আজ থেকে একশো ছত্রিশ বছর আগে আমার সে ভাবগুলোই রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন। হিসেব করে দেখি এ তো আকস্মিক মিলে গেল। যখন আমার বয়স সাতাশ। যখন আমিও অনুরূপ ভাবনায় তাড়িত হচ্ছি। তখন রঠা যেন আমার কথাই লিখলেন ২৭ জুলাই ১৮৮৭’র এক পত্রে। রঠা  বলছেন, ‘হঠাৎ একদিন বৈশাখের প্রভাতে নববর্ষের নূতন পত্র পুষ্প আলোক ও সমীরণের মধ্যে জেগে উঠে যখন শুনলুম আমার বয়স সাতাশ তখন আমার মনে এই সকল কথার উদয় হল। আসল কথা— যতদিন আপনি কোন লোককে বা বস্তুকে সম্পূর্ণ না জানেন ততদিন কল্পনা ও কৌতুহল মিশিয়ে তার প্রতি একপ্রকার বিশেষ আসক্তি থাকে। পঁচিশ বৎসর পর্যন্ত কোন লোককে সম্পূর্ণ জানা যায় না— তার যে কি হবে কি হতে পারে কিছুই বলা যায় না, তার যতটুকু সম্ভূত তারচেয়ে সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু সাতাশ বৎসরে মানুষকে একরকম ঠাহর করা যায়—বোঝা যায় তার যা হবার তা একরকম হয়েচে—এখন থেকে প্রায় একইরকম বরাবরই চলবে—এ লোকের জীবনে হঠাৎ আশ্চর্য হবার আর কোন কারণ রইল না। এই সময়ে তার চারদিক থেকে কতগুলো লোক ঝরে যায়, কতগুলো লোক স্থায়ী হয়—এই সময়ে যারা রইল তারাই রইল। কিন্তু আর নুতন প্রেমের আশা রইল না, নুতন বিরহের আশঙ্কাও গেল। অতএব এ রকম মন্দ নয়। জীবনের আরামজনক স্থায়ীত্ব লাভ করা গেল।আপনাকেও বোঝা গেল এবং অন্যদেরও বোঝা গেল। ভাবনা গেল।’

যারা ভালোবাসি বলে শীতের রাত্রিগুলোয় আগুনের পাশে ডেকে নিত, যারা একটু সঙ্গ’র জন্য আকুল হয়ে থাকত—আমার এই পরবাস তাঁদের সকলকেই তো বিচ্ছিন্ন করেছে

ভেবে দেখি আমারও তো একই দশা হয়েছে। সমাচ্ছন্ন রজনীর মত নিজেকেও তো নিভৃত মনে হয়। চার-পাঁচ বছর আগে যারা প্রাণের বন্ধু ছিল, তাঁরা আজ কোথায় কোথায় ঝরে গেছে। কেবল বন্ধুরা কেন, বহু আত্মীয়ই আজকাল অনাত্মীয় হয়েছে। যারা ভালোবাসি বলে শীতের রাত্রিগুলোয় আগুনের পাশে ডেকে নিত, যারা একটু সঙ্গ’র জন্য আকুল হয়ে থাকত—আমার এই পরবাস তাঁদের সকলকেই তো বিচ্ছিন্ন করেছে। অনেকে ভুলেও গেছে নিশ্চয়ই। এ নিয়ে কিছুদিন আগেও হৃদয়ে ব্যথার উচাটন হত। কিন্তু কুঁড়ি-পঁচিশের চৌকাঠ পেরিয়ে ত্রিশের অভিমুখে সেই বোধ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। অল্পতে আহত হওয়ার ব্যাধি কেটেছে। বন্ধুহীনতা এখন আর হাহাকার তৈরি করে না। অতিকথনের বদলে কিছুকাল একাকী থাকতেই ভালো লাগে। অভিমান পরিত্যাগ করেছি। কুঁড়ির কোঠায় বিশেষ বস্তু ও প্রাণের প্রতি যে মুগ্ধতা হত, তা এখন নেই বললেই চলে। কারও প্রতি বিশেষ আকর্ষণ নেই। কখনও যদিও তার উদ্রেক হয়—তবে সাময়িক। বস্তুগত জীবনের প্রতি তো নেই-ই। ফলে বৌদ্ধের নির্বাণ লাভের কথা বলব না, বরং পুরুষ হিসেবে যা-কিছু যতটুকু প্রয়োজন এর বাইরে কোনও লিপ্সাই কাজ করে না। কেবল পথে যাঁরা আসা-যাওয়া করে তাঁদের দেখি। আর দেখি নিজের অনাবৃত একটি জীবন।

এমন অনাবৃত, যেমন উদাম থাকে নদী। কতকিছু তাতে ভেসে যায়। কত কীটপতঙ্গ, বাড়িঘর, জনপদ, বৃহৎ বৃক্ষের গুঁড়ি, মানুষের মরদেহ এমনকি একটি পাতাও  তার জলে ভেসে যায়। অথচ কিছুতেই তার বিকার নেই। চিরকাল তার একটাই ধর্ম—বহতা। সকলকেই ভাসতে দেওয়া। সকলকেই জলের প্রবাহে আগলে রাখা। সকলকেই ভ্রমণের অধিকার দেয়া। কোনও অবরোধ নেই তার। কোনও অনুযোগ নেই। স্বার্থ, পরিতাপ, অনুশোচনা এবং কোনও অনুরোধও নেই। তার সঙ্গে যারা যাবে যেতে পারে। যে ভাসতে চায় ভাসতে পারে। যা থাকতে চায় থাকতে পারে। যে চলতে চায় চলতে পারে। মোট কথা বাঁধনের যে আগল —নদী তাতে যুক্ত নয়। তার জল তার স্রোত সমস্ত কিছুই বিযুক্ত।

আবেগ যেমন বুদ্ধিমানদের বোকা বানিয়ে দিতে পারে, তেমনি বোকাদের বুদ্ধিমান

বিদেশ-বাসের এই করুণ জীবনে মনে হয় আমিও তাই। ত্রিশের এই বাঁধনছেঁড়া অভিমুখে বুঝি আমিও এক মনুষ্য নদী। সমস্ত উৎসবের অলক্ষে যেভাবে নিরিবিলি বয়ে চলছি, যেভাবে বেঁচে আছি, তাতে বিশ্বাস করি—’যেকোনো কিছুই প্রস্থানমুখি। জীবের ধর্মই ছেড়ে যাওয়া। দুঃখই আমাদের প্রকৃত সহোদর।’  ফলে প্রাপ্তির আনন্দ যদি কিছু থেকে থাকে, অপ্রাপ্তিও তেমনি। কেউ ভালোবাসলে মনে যে নির্দোষ আনন্দের লোভ জাগে, কেউ ছেড়ে গেলে বিরহে মুমূর্ষু হয়ে পড়ি না। অনুরূপ আপন সাধনার ক্ষেত্রেও। যেহেতু লিখি তাই প্রায়শই মানুষের মন্তব্যের স্বীকার হই। কখনও প্রতক্ষ্যে কখনও অলক্ষ্যে। এই ক্ষেত্রে আমার যে বিবেচনা তা বেশ নির্মম। অনেক ভেবে দেখেছি, সমগ্র সৃষ্টির ভেতর কেবল মানুষই (সকলেই) সামগ্রিকভাবে একটি বিষয়ে প্রতারিত হয়। তা স্তুতি ও সমালোচনা। অতএব কেউ যদি এ দুটি বিষয় এড়াতে পারে তবে তাঁর আরাধনাটা সহজ হয়। বিশেষত শিল্পীরা এ দুটি জিনিসে যত কম কান দেবে ততই মঙ্গল। তেমনি আবেগ সম্বন্ধেও একই ভাবনা। এ নিয়ে চমৎকার একটা কথা বলেছেন ফরাসি দার্শনিক লা রোশফুকো। ফুকো বলেন, ‘আবেগ যেমন বুদ্ধিমানদের বোকা বানিয়ে দিতে পারে, তেমনি বোকাদের বুদ্ধিমান।’

ক্রমশ..

লেখক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *