আরাফার প্রেমময় অমর কবিতা

আরাফার প্রেমময় অমর কবিতা

  • তামীম আব্দুল্লাহ

আঁধার যুগের পরে যখন
সত্য আলো জ্বললো রে
না বেসে কেউ পারেনি ভালো
রাসুল মুহাম্মদকে রে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যে নামের সৌরভে আন্দোলিত হয়েছিল গোটা বিশ্ব। তুমুল পাশ্চাত্যের যুগে শুষ্ক তপ্ত মরুর বুকে যে সভ্যতা আর শান্তির পয়গামের মশালে তিনি যে আলো জ্বালিয়ে ছিলেন সে আলোর রশ্মিতে এখনো এতকুটু রং কমে নি বরং সময়ের পরিক্রমায় উন্নত বিজ্ঞানমনষ্ক পৃথিবীতে তার চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তার কাছে বারবার ধরা দিয়েছে মনুষ্য স্বত্ত্বা। তবে আরবী বাগধারার সে কথা যথার্থ— “প্রথম জন প্রথম ভুলো মন।”
আমরা আমাদের জিবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচারগুলো প্রায়শই ভুলে যাই। ভুলে যাই দেড় হাজার বছর ধরে লালিত করা আমানতের কথা। ভুলে যাই মানবিক সভ্যতা।আমাদের সামাজিক, মানবিক, আত্মিক, পারিবারিক অথবা রাষ্ট্রীয় দিক যা-ই বলি না কেন সবভাবেই পিছিয়ে পড়েছি যেন আরো দেড় হাজার বছর পিছে।

আমাদের এসব নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে নবিজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবসময় তৎপর। আর ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী এবং মুগ্ধতার বিষয় হলো এই নৈতিকতা। আর কোনো ধর্মে নৈতিকতার প্রভাব এমন নিরঙ্কুশ এবং ঐশ্বর্যশীলতার সাথে মোহময় করে তুলে নি যতটা ইসলাম ধর্ম করেছে। ইসলাম ধর্মের প্রসারতা ও মানুষের মাঝে কোমল স্নিগ্ধতা মেখে তার অগ্রগামীতা দিনে দিনে হয়েছে আরো সমৃদ্ধশীল।

পেয়ারে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি ইসলামের এই নৈতিকতাকে লালনের সাথে সাথে ছড়িয়ে দিয়েছেন সাহাবা আজমাইন এবং তৎকালীন সমাজের মাঝে। এবং ১০ম হিজরীতে ‘হুজ্জাতুল বিদা‘তে আরাফার ময়দানে যে ঐতিহাসিক আলোচনা তিনি ১০ লক্ষ সাহাবায়ে কেরামের উপস্থিতিতে করেছিলেন তা যে কোনো যুগ কিংবা শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পঙক্তিমালা ছাড়া আর কনো শব্দ ব্যাবহার করার সীমা জানা নেই। সেই আলোচনায়ওঠে এসেছে মানব জীবনের সুন্দরতম বিষয়গুলো যেগুলো একজন মুসলমান চরিত্রকে তো অতুলনীয় করে তুলেই সাথে সাথে প্রত্যেক মানুষকে করে তুলে মানবীয় গুণে পরিপূর্ণ। আর ইসলাম শুধু ব্যক্তির চারিত্রিক সংশোধনই কামনা করে না বরং সমগ্র মনাব জাতির সমষ্টিগত জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য। গোত্রীয় ও আঞ্চলিক চিন্তা-ধারার সংকীর্ণ আবর্ত থেকে মুক্তি দান করে গোটা মানব জাতিকে আন্তর্জাতিক মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য।

এ সমস্ত গুণের কথা মানবতার কথা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদের পর্যন্ত এসেছে বংশীয় ক্রমিকধারার মতো। বিভিন্ন হাদীসের কিতাব, উল্লেখযোগ্য তাফসীর, ইতিহাস গ্রন্থ যার সুস্পষ্ট প্রমাণ। বুখারী শরীফের ১৬২৩, ১৬২৬ এবং ৬৩৬১ নম্বর হাদিসে আরাফার ময়দানে হযরতের বিদায় ভাষণের বিভিন্ন অংশ ইমাম বুখরী উল্লেখ করেছেন। সহীহ মুসলিম শরীফে ৯৮ নম্বর হাদিসে বিদায় খুৎবা বর্ণিত হয়েছে। তিরমিজি শরীফের ১৬২৮, ২০৪৬ এবং ২০৮৫ সংখ্যক হাদিসে বিদায় খুৎবার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বিদায় খুৎবার দীর্ঘতম উদ্ধৃতি দিয়েছেন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল। তাঁর সংকলিত হাদিসগ্রন্থ ‘মুসনাদ’-এর ১৯৭৭৮ সংখ্যক হাদিসে যা দীর্ঘতর করে তিনি আলোচনা করেছেন। সে দিনের ছোট্ট একটা কথা যেটা রাসূলে আরাবী বলেছিলেন, আজ তোমরা যারা এখানে আছো তারা সবাই তোমাদের মধ্যে থেকে যারা অনুপস্থিত তাদের কাছে পৌঁছে দিও। আজ সেই মুক্তির বাণী, সভ্যতার বাণী শুনলে আমাদের হৃদয়ে একটা নিরব আকুতি নিয়ে কথাগুলো প্রানবন্ত হয়ে ওঠে। একটা পরিপূর্ণ শরীয়তের রূপ যেটা রাসূল রেখে গেছেন তার অবুঝ উম্মতের জন্য। মুখে গুঞ্জরণ হয় দুরুদের। গর্ব হয় না চাইতেই এক মুহাম্মদের উম্মত হওয়ায় আহমদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার ময়দানে সে দিন শুনিয়ে শিখিয়েছেন, সাম্যের ভিত্তিতে শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক, শ্রেষ্ঠতম শ্রমনীতি ঘোষণা মানব সভ্যতাবিরোধী সব বর্বরতা নিষেধ, সুদবিহীন অর্থনীতি প্রণয়ন, অন্যের অর্থ আত্মসাৎ ও জুলুম-নির্যাতনের ব্যাপারে সর্তকতা, আদর্শিক দ্বন্দ্বে পরমতসহিষ্ণু হওয়া, দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা, ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, মুসলিম ভাইদের প্রতি সহনশীলতা ও তাদের মর্যাদা বজায় রাখা, অন্যেকে ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা, ঋণগ্রস্থ মানুষের উপর চড়াও না হওয়া, এবং কোরআন এবং সুন্নাহকে আকড়ে ধরা।

এমন সব আলোচনা করেছেন যেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিশ্রান্ত অধ্যায়। এই উৎকৃষ্ট মনুষ্য সভ্যতা যারা গ্রহণ করেছে তারাই শিখরে পৌঁছিয়েছে। আর সভ্যতার মূল উপজীব্যই হলো মানুষ। মানুষেরা যখন পাশ্চাত্যের ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন জীবন-যাপন করছে তখন এ সভ্যতাই তাদের আলো এবং মুক্তির পথ দেখিয়েছে। আর সভ্যতা সর্বকালেই তার চেয়ে উৎকৃষ্ট কাউকে খোঁজে। যার ফলে গ্রীক পারস্য ও রোমানের মতো সভ্যতার নিয়ম মেনেই উত্থান-পতনের মুখোমুখি হয়েছিল। গ্রীক সভ্যতা আত্মসমর্পণ করেছিলো পারস্য ও রোমানের কাছে। আর পারস্য ও রোমান সভ্যতা আশ্রয় নিয়েছে সর্ব নন্দিত বিশ্বজনীন ইসলামের কাছে। পরবর্তীতে সময়ে মুসলিমদের ধারক- বাহকদের মাঝে ছন্দপতন আসলে গ্রীক ও রোমান সভ্যতা থেকে জন্ম নেয়া পশ্চিমা সভ্যতা বর্তমান অবস্থা শোচনীয় হলেও পূর্ববর্তী সময়ের উত্থানকালে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি হিসেবে বেছে নেয় ইসলামের চিরন্তন উৎসকে; এগিয়ে যায় নানান আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতায়।

যার একটা উদাহরণ বিখ্যাত চিন্তাবীদ মেজর আর্থার লীন ওয়ার্ড বলেন, ততকালীন আরবের মাঝে সভ্যতা, মানুষিক উৎকর্ষ ও উচ্চশিক্ষার প্রণালী প্রবর্তিত না হলে ইউরোপ অদ্যাবধি অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতো। বিজেতার উপর তারা যে রকম উদারতার ও সদাচারণ করেছিলো তা সত্যি চিত্তাকর্ষক। তাই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বিদায় হজের ভাষণে তাঁর উম্মতের জন্য অবর্ণনীয় শিক্ষামূলক জীবন-যাপনের কথা এবং গোত্র থেকে গোত্র এবং রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রের অগ্রগামীতার মূল শিক্ষাকে আমাদের জন্য রেখে গেছেন।

আর এ বিশ্ব সভ্যতাকে ইসলাম যে অসীম জ্ঞানসম্ভারের সন্ধান দিয়েছে তা সত্যিই অতুলনীয়। ‘জিসি ওয়েলস’ এর ভাষায়— মুসলিম আরবদের মধ্য দিয়েই মানব ভাগ্য তার আলোক শক্তি সঞ্চার করেছে ল্যাটিন জাতির ভিতর দিয়ে নয়।

এমন উদাহরণের কথা কত কত যে আছে তার ইয়ত্তা নেই। আজ আমাদের এই সংকীর্ণ হয়ে যেতে থাকার বেলায় এ আলোচনা আমাদের পথের দিশা হোক। রাসূলে রহমতে আলমের দেয়া নৈতিক শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে ছড়িয়ে পড়ুক সুবহে সাদিকের মতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *