আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ: উম্মাহর কল্যাণকামী এক মজলুম আলেমের গল্প
- আমিনুল ইসলাম কাসেমী
এদেশে আলেমদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী জুলুমের শিকার আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ দামাতবারাকাতুহুম। প্রতিটি সরকারের আমলেই তিনি জুলুমের শিকার হয়েছেন । চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মওদুদীবাদী ক্ষমতাসীনদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হন। দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন । আর বর্তমান সরকারের আমলে স্বজাতির দ্বারা হয়েছেন নির্মম নিপীড়নের শিকার । স্বজাতির আক্রমণের মাত্রাটা ছিল অসহনীয়। সেই ২০১৩ সন বরং তারও আগ থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন সময়ে স্বজাতি ভাইদের নানাবিধ আক্রমণে বিশেষ করে নির্জলা মিথ্যা অপবাদে তিনি হয়েছেন জর্জরিত। যে বিষয়ে তাঁর কোন প্রকার সম্পৃক্ততা নেই, সেসব বিষয়ের অপবাদ দিয়ে তাকে ঘায়েল করা হয়েছিল। সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ব্যাপার ছিল, বায়তুল মোকাররমের সামনে হাজার হাজার মাদ্রাসার ছাত্র নিয়ে আল্লামা মাসঊদ সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হয়েছিল। তবলীগের দ্বন্দ, যে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না, সে বিষয়ে আল্লামা আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবকে খামাখা দোষারোপ করে ছাত্র জনতাকে উস্কে দিয়েছিল কিছু আলেম নামধারী লোকেরা। তাদের বিচার অবশ্য দুনিয়াতেই হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, বিশাল বড় বড় পোষ্টারে আল্লামা মাসঊদ সাহেবের ছবি দিয়ে পুরো দেশ ছেয়ে ফেলা হয়েছিল, তিনি নাকি টঙ্গীর ঘটনার জন্য দায়ী (নাউজুবিল্লাহ)।
এরকম বহু নির্যাতন এবং জুলুমের খড়গ চেপে বসে ছিল আল্লামা ফরীদ ঊদ্দীন মাসঊদ সাহেবের উপর। মানে নির্যাতিত হওয়ার শেষ সীমানায় তিনি চলে গিয়েছিলেন। অনলাইন – অফলাইন সবজগতে তাঁকে কোণঠাসা করে রাখার অপচেষ্টা করা হয়েছিলো। পুরো দেশের মাদারিসগুলোতে তাঁর বিরুদ্ধে বদনাম রটানো ছিল যেন কিছু আলেম নামধারীর দৈনন্দিন ওজিফা। আমার মনেহয় এই বাংলাদেশে তাঁর মত আর কাউকে এমন জুলুমের শিকার হতে হয়নি। এরকম আর কারো নামে মিথ্যারোপ করা হয়নি। আর কারো উপর এমন জুলুমের বোঝা চাপানো হয়নি কখনো। একজন বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলার, ফেদায়েমিল্লাতের খলিফা, হাজার হাজার মুহাদ্দিস- মুফতির উস্তাদ তিনি। অর্ধশতাব্দীকাল থেকে বুখারী শরীফের দরস দেন যিনি। কিন্তু সেই মহান আলেমকেই সহ্য করতে হয় স্বজাতি ভাইদের আপবাদ।
তবে ফেদায়েমিল্লাতের এই খলিফা, নববী আদর্শে উজ্জেবিত মহান এই ব্যক্তিত্ব ভেঙ্গে পড়েননি তিনি। কাউকে বদদোয়া পর্যন্ত করেননি। বরং সবকিছু নিরবে সয়ে গেছেন। যারা জুলুমের হাত বাড়িয়েছেন তাদের জন্য দুআ মুনাজাত করেছেন। আর সবকিছু আল্লাহ তায়ালার উপরে সোপর্দ করেছেন। এত ঝড়- তুফান বয়েগেছে, তবুও বিচলিত না হয়ে অবুঝ মানুষের জন্য দুআর দরজা খোলা রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, যারা তার বিরোধীতা করেছে, বিভিন্ন সময়ে মিথ্যারোপ করেছে, তারা যখন বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়েছে, তখন তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। এ যেন সত্যিকারের নায়েবে নবী। পেয়ারা হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন দুশমুনেরা কষ্ট দিয়েছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে কোনদিন বদদোয়া করেননি। আবার ওই দুশমুনেরা বিপদে পড়লে পেয়ারা হাবীব তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। তদ্রুপ শাইখুল ইসলাম আল্লামা মাসঊদকে যারা কষ্ট- ক্লেশ দিয়ে আনন্দ ভোগ করেছিলেন, তাদেরই বিপদে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন।
আকাবিরে দেওবন্দ যে মেজাজে চলেছেন সেই মেজাজে তিনি চলার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে শাইখুল ইসলাম মাদানী এর মত চিন্তাধারা ও কলাকৌশলে তাঁর জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করেন।
অনন্য ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ এর নাম স্বর্ণাক্ষারে লেখা থাকবে চিরকাল। একাবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিকালে দেওবন্দী মাসলাক- মাশরাবের অতুলনীয় মনিষা তিনি। তাঁর উপমা তিনি নিজেই। হাজারো চড়াই- উৎরাই পেরিয়ে ওলামায়ে দেওবন্দ তথা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের পদচিহ্ন ধরে এগিয়ে চলেছেন। যতই আসুক ঝড়- তুফান তবুও তিনি দেওবন্দী চিন্তাধারার উপরে অটল- অবিচল। আকাবির- আসলাফের বাতলানো পথে নিজেকে পুরোপুরি বিলীন করেদিয়েছেন। যার জ্ঞান- প্রজ্ঞা হুবহু পূর্বসূরীদের মত। আকাবিরে দেওবন্দ যে মেজাজে চলেছেন সেই মেজাজে তিনি চলার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে শাইখুল ইসলাম মাদানী এর মত চিন্তাধারা ও কলাকৌশলে আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ তাঁর জীবন পরিচালনা করার চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন: আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের মতো ব্যক্তিত্ব কয়েক শতাব্দিতে একজন জন্মায়: তাড়াইল ইজতিমায় শায়েখ আনিস আযাদ বিলগ্রামী
এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী এবং তাঁর শাগরেদগণের মধ্যে যারা বড় ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে শাইখুল ইসলাম মাদানী ছিলেন উল্লেখযোগ্য। তার চিন্তাধারা ছিল অতুলনীয়। অনেকেই হযরত মাদানীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং মেজাজ বুঝতে ভুল করত। না বুঝে শাইখুল ইসলাম মাদানীকে গালমন্দ করত। কেউ কেউ তো তাকে কাফের পর্যন্ত ফতোয়া দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তিতে মাওলানা মাদানীর চিন্তাধারা এবং তার কলাকৌশল স্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ পেয়েছিল তখন কিন্তু সকলেরই আফসোসের অন্ত ছিলনা।
তিনি যে কল্যাণমূলক কাজগুলো এ জাতির জন্য করে যাচ্ছেন সেটা চিরকাল স্মরণ থাকবে।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ এর চিন্তাধারা তদ্রুপ মাওলানা মাদানী এর মত। অনেকেই তাঁর কর্মকৌশল বুঝতে অপারগ। তিনি যে কোন বিষয়ের আদ্যপান্ত অনেক সহজেই বুঝে ফেলেন, কিন্তু কিছু মানুষের বুঝতে অনেক দেরী হয়। যে কারণে না বুঝে অনেকেই আল্লামা মাসঊদ এর ব্যাপারে বিরুপ মন্তব্য করে থাকেন। কিন্তু শেষমেষ যখন আল্লামা মাসঊদ সাহেবের চিন্তাধারা বিজয় লাভ করেন তখন সকলের মাথা নুইয়ে যায়। তবে তিনি কোন সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত নন। কিন্তু তাঁর যে রাজনৈতিক জ্ঞান, কলাকৌশল ও কর্মপদ্ধতি, সেটা যেন উম্মাহর হাজার বছরের কামিয়াবী। এদেশ ও জাতি এবং আলেম সমাজের কল্যাণে তার খেদমত অপরিসীম। তিনি যে কল্যাণমূলক কাজগুলো এ জাতির জন্য করে যাচ্ছেন সেটা চিরকাল স্মরণ থাকবে।
আজকাল দুদিন পরপর মানুষ খোলস বদলায়। আজ এদলে তো কাল অন্য দলে। এমনিভাবে কিছুদিন পরপর দল এবং চিন্তাধারার ব্যাপক পরিবর্তন করে থাকেন। কিন্তু আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ এর একই বক্তব্য, তিনি দেওবন্দী চিন্তাধারার উপরে প্রতিষ্ঠিত। এধারা থেকে বিন্দু মাত্র সরে দাঁড়াবার বান্দা তিনি নন। যুগ যুগ ধরে আকাবির – আসলাফের কদমে পা রেখে চলেছেন। কখনো সে চিন্তাধারা থেকে ফিরে আসেননি। আর এই দেওবন্দী চিন্তাধারার উপরে অটলতা- অবিচলতায় কিছু মানুষ ভুল বোঝা শুরু করেন। স্রোতের সাথে তিনি তাল মিলিয়ে চলেন না বিধায় অনেক অনেক গ্লানি তাকে সহ্য করতে হয়। কিন্তু স্রোতের সাথে চলে যারা শেষমেষ ধাক্কা খেয়ে কাতর হয়ে পড়েন, তখনই আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদকে স্মরণ করেন। ফিরে আসেন তাঁর কাছে। তবে মাজলুম এ মানুষটির হৃদয়খানি অনেক প্রশস্ত। কাউকে দূরে ঠেলে দেন না। বুকে তুলে নেন সকলকে। এমনকি হাসপাতালের বেডে শুয়ে কারাবন্দী আলেমদের জন্য দুআ করেছেন। তাদের কল্যাণ চেয়েছেন। আরো বড় ব্যাপার হল, প্রধানমন্ত্রীর সামনে রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামে যেখানে শত শত আলেম- উলামাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ উপস্হিত ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে হেফাজতের মামলা থেকে আলেমদের নিস্কৃতি চেয়েছিলেন। যেটা সেসময়ের ‘টক অব দ্য কান্ট্রি ছিল’। স্বজাতি ভায়েরা যতই ভুল করুক তিনি কিন্তু ভুল করেননি। তিনি সকল উলামায়েকেরামের কল্যাণ চেয়েছেন। মানুষ যতই তাঁর প্রতি জুলুম – নির্যাতনের খড়গ চেপে দেক না কেন তিনি সকলের জন্য দুআ করেছেন। মজলুম হওয়ার পরেও উম্মাহর কল্যাণকামী তিনি। আল্লাহতায়ালা তাঁকে নেক হায়াত দান করুন। কর্মের মাঝে বরকত দিন। আমিন।
লেখক, শিক্ষক ও কলামিস্ট