২০শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ , ২৭শে শাবান, ১৪৪৪ হিজরি
ইদানিং নবিজি মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই মনে হয়—আমি একজনের লিখিত বই থেকে শব্দ-বাক্য নকল করছি, কিংবা তাঁর অভিনব ঢঙ অনুকরণ করে লিখছি। কারণ ওই লেখকের মতো এত মুগ্ধকর, প্রোজ্জ্বল ও হৃদয়গ্রাহী ভাবে অবলীলায় আরো কাউকে বাংলা ভাষায় ঐশ্বর্যময় করে—অভূতপূর্ব চিত্রায়নে নবিজির সীরাত লিখতে দেখিনি, যেন তিনিই প্রথম। নবিজির শানে যুৎসই শব্দ ব্যবহার করে সুনিপুণভাবে তিনি যেসব বাক্য সাজিয়েছেন, তা পড়ে আমার শুকনো পাতার মতো রঙহীন মর্মর হৃদয় সজীবতা পেয়েছে—যেমন সজীবতা পেয়ে থাকে আম্মার মুখ দেখলে।
বলছিলাম আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দামাত বারাকাতুহুম) রচিত ‘আল্লাহর পরে শ্রেষ্ঠ যিনি’ গ্রন্থটির কথা। যা পড়ে আমার সীরাত পাঠের সমস্ত মুগ্ধতা, শান্তিময়ীতা পূর্ণতা পেয়েছে—যেমন পূর্ণতা পেয়েছিলো দাওরায়ে হাদীসে ‘শামায়েলে তিরমিজি’ পড়ে। আর এই পাঠের প্রভাব আমার উপর এতটাই রয়ে গেছে যে, এখন নবিজিকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলেই মনে হয়—আমি যেন তাঁকে নকল করে লিখছি। কারণ তিনি নবিজির ঝলঝলে উজ্জ্বল, লাবণ্যময়, দুধে আলতা, কিংবা ডালিম ফুলের চেয়েও রাঙা অবয়বের বর্ণনা এত মাধুর্যময়-প্রেমময় করে লিখেছেন, যা পরিপূর্ণতায় যেন তুলনারহিত—যেমন তুলনারহিত নবিজিকে মাত্র একবার হলেও দেখা বেদুঈন সাহাবির বর্ণনা।
গ্রন্থটি হাতে নিলেই প্রথম ফ্ল্যাপে আপনি যা দেখতে পাবেন, এর কিছু অংশ এখন একসাথে পড়া যেতে পারে, চলুন পড়ি—
❝কেমন করে আঁকা যায় সেই রূপময় কান্তি, যা অনুভবময় হয়েও অনুভবের ঊর্ধ্বে, স্পর্শময় হওয়ার পরও পরশ করা যায় না যাঁকে, অঙ্গময় হওয়ার পরও আঙ্গিক কাঠামো যাঁর বর্ণনার ঊর্ধ্বে, স্নিগ্ধ বর্ণময়তার শোভায় পিছলে যায় চোখ যাঁর দর্শনে! সমস্ত উপমা যেখানে হারায় তার উপমেয়তা, তুলনা যেখানে অতুলনীয় বলেও হয় না বলার শেষ।
বলো, কেমন করে আঁকা যাবে সেই কান্তিময় নাসিকাগ্রের নূর, দর্শকের যেখানে ঘটতো দৃষ্টিবিভ্রম, যাতে তাঁর নূরময় নাসিকা আরো, আরো একটু উঁচু মনে হতো! বাণী নির্ঝরণীর সময় সেই শিশির-পিছল স্ফটিক দন্তরাজির ফাঁকে ফাঁকে অঙ্গহীন গড়িয়ে পড়তো পবিত্র মুখগহ্বরের স্ফুলিঙ্গ, আভাময় দীপ্তি, কেমন করে আঁকবে তাঁকে!
…আঁকা গেলো কি? তিনি তো ছিলেন ‘খালকান ও খিলকাতান’ শারীরিক গঠন ও স্বভাবচরিত্র উভয় সৌন্দর্যেরই পরিপূর্ণতায় পূর্ণময়, সৃষ্ট সৌন্দর্যের সবদিক চূড়ান্ত হয়েছে এখানে, শেষ এখানেই।❞
‘মানবসভ্যতার নববী ধারা’ অধ্যায়ে ‘শুরু হলো মানবসভ্যতার’ শিরোনামে গ্রন্থটি শুরু করেছেন লেখক। এই অধ্যায়ে হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে—ক্রমে ক্রমে মারয়াম তনয় হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত নবী-রাসূলের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি তখনকার সমসাময়িক বিশ্বের পরিবেশ এবং ধর্মীয় ও নৈতিক অবস্থার আলোচনা করেছেন জাওয়ামিউল কালিমে। ধীরে ধীরে অদ্ভুত এক কারিশমায় ‘আবির্ভূত হলেন তিনি’ অধ্যায়ে ‘পরিপূর্ণ এক খুঁতহীন সত্তা’ শিরোনামে পূর্ণিমা-রাতের স্নিগ্ধ উজ্জ্বল চাঁদের অথবা রূপাচূর্ণের মতো চকচকে শব্দে নবিজির আলাপ শুরু করেন তিনি।
লিখেন—
❝খরা তাণ্ডবগ্রস্ত উত্তপ্ত বিশুষ্ক মরুভূমির মার্তণ্ড উত্তাপে হারিয়ে যাওয়া জলধারার এই সময়ে সারা পৃথিবীর প্রাণরস নিয়ে, রাব্বুল আলামীনের রহমত বিন্দু নিয়ে রহমাতুল লিল আলামীনের আবির্ভাব হলো রহমত বৃষ্টির মুষলধারায় মানবতার অত্যুঙ্গ শিখর শীর্ষে। বিশ্ব মানবতার জীবন্ত প্রতীক হয়ে এলেন এক পরিপূর্ণ মানুষ, সর্বকালের, সব স্থানের, সব বর্ণের, সব ক্ষেত্রে, সর্ব বিষয়ে, সব নারী, পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ বণিতার পরিপূর্ণ আদর্শ হয়ে উসওয়াতুন হাসানার রূপ ধরে। আঙ্গিক সৌষ্ঠব এবং অভ্যন্তরীন গুণ মাহাত্ম্য, কোথাও কোনো খুঁত ছিলো না তাঁর। সর্বদিক দিয়ে নিখুঁত পরিপূর্ণ এক সত্তা।❞
আশ্চর্য এক মনোযোগে আমি গ্রন্থটি পড়েছি। আর ভেবেছি—আমার অন্তর তোলপাড় করা ভালোবাসা এমন শৈল্পিকভাবেও উপস্থাপন করা যায়? লেখা যায়? আর কেউ পারবে? আমি জানি না! তবে এক জীবন সাধনা করলেও আমি পারবো বলে মনে হয় না। যেন নবিজির জীবন এবং তখনকার যাপনের অন্তরঙ্গ বয়ান এই লেখকের লিখনীতে এক আশ্চর্য অসীম অনন্য দক্ষতায় ফুটে ওঠেছে—অনুসন্ধিৎসু চোখে সৌন্দর্যমন্ডিত সরল গদ্যে বর্ণিত হয়েছে। নবিজির ‘জোতির্ময় শৈশব’, ‘সুশোভন কৈশোর’, ‘উদ্দীপনাময় নিষ্কলুষ যৌবন’, ‘সূর্যোদয়ের পূর্বাভাস’ অধ্যায়গুলো পড়লে যে কেউ বলতে বাধ্য হবে—লেখক নবিজির জীবন গভীরভাবেই আত্মস্থ করে অপার লাবণ্যে ঘেরা মোহময় সৃষ্টির তাড়না থেকে, নূরের নান্দনিক শব্দে যেন এই সীরাত লিখেছেন।
মোহমদিরাময় নয়নে, সুরভিরাশি ও রবির জ্যোতির বসন্তপরশে—লেখক নবিজির মক্কি জিন্দেগীর ফুলগুলো ফুটিয়েছেন ‘মানুষ গড়ার তেরো বছর’ এর কাননে, মনোব্যাথা নিয়ে চরণতলে বহুদিন ঘুমঘোরে ডুবে থাকা চিরজন্ম সঙ্গোপনে, ‘প্রদীপ থেকে জ্বললো প্রদীপ’ করপরেশনে। গ্রন্থটি পড়লে, যে কেউ বুঝবে, কিছুদিন ওহীর সাময়িক বিরতির পর শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে, স্নেহের স্বরে, ‘কমলিওয়ালা’ কীভাবে ওঠে দাঁড়ালেন, সতর্ক করলেন ‘তাবৎ জিন ও ইনসানকে’। অন্তিম যামিনীর নয়া প্রত্যয়ে, নয়া উদ্দীপনায়, নয়া আসমানী পরিকল্পনায় আবার শুরু হলো অবারিত ওহীর ধারা—গরম হলো নুযূলে ওহীর হাওয়া। যেন অতিশয় যত্নে ‘মক্কা পেরিয়ে ছড়ালো এ কিরণ’ হাসি হাসি আননে, ‘প্রকাশ্যে দাওয়াত’ এর আমোদে, বিরামহীন ক্লান্তিহীন মুখে ‘সাফা পাহাড়ের শিখরে’।
জীবনবোধে, বর্ণনার অসমান্য অনুভূতির অবয়বে, নবিজির শোক-দুঃখের প্রতিচ্ছবি পাঠকের চোখের সামনে ফুটে ওঠবে ‘নেমে এলো বাধার পাহাড় ও নির্মম নির্যাতন’, ‘নানা ষড়যন্ত্র, নানা কূটকৌশল’, ‘কঠিন গিরিসংকট’, ‘শোক ও বিষাদের বছর’, ‘তায়েফে ইসলামের দাওয়াত ও নির্মম নির্যাতন ভোগ’ অধ্যায়গুলো পড়লে। দুর্দান্ত মৌলিকতায়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তায়, নবিজির শোকের আলাপ পড়তে পড়তে, লেখকের আশ্চর্য শক্তিময় শব্দ বিন্যাসে, যেন এক বর্ষাকাল কেটে যাবে পাঠকের চোখের জলে। ‘তায়েফবাসীর প্রতিক্রিয়া’ ও ‘লেলিয়া দিলো গুণ্ডাদের’ অনুচ্ছেদে লেখক যার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—
❝সামনে-পিছনে দু’পাশ থেকে পাথরের পর পাথর ছুড়ছিল। আঘাতে আঘাতে তাঁর বদন মুবারক রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। তিনি রক্তে রক্তে ভেসে গেলেন। মাঝে মাঝে আঘাতের চোটে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলেন। এই অবস্থায়ও পাষণ্ডরা তাঁকে হাত দিয়ে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে আবার ঢিল ছুড়ছিল। আর উল্লাসে ফেটে পড়ছিল।
…কিন্তু একা তিনি কী করবেন। জন নেই, মাল নেই, সহমর্মী নেই, চতুর্দিকে কেবল পাথর আর পাষণ্ড পশুদের অট্টহাসি। হযরত যায়দেরও মাথা-শরীর আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে গেলো।
…সারা শরীর মুবারক রক্তে জবজবে। পাশেই দেখা গেলো একটা আঙ্গুর বাগান। একটু ছায়ায় বিশ্রামের আশায় হযরত যায়দ রা. কে নিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন।❞
তায়েফের পর জরজর হৃদয়ে, মর্মবেদনায় নবিজির দিবানিশি অশ্রুজলে—যেন তৈরি হলো প্রশান্ত সুনীল অনন্ত এক সাগর। এরপর আল্লাহর সুধাসরসে, তৃষিত মধু পসমে, রূহানী উন্নতির চরম সোপানের শীর্ষ চূড়ায় পোঁছে দেয়া হলো নবিজিকে। বিরহানলে প্রেমানল জ্বলিয়ে দুঃখ মোচনে পরমতমের অসীম বিপুল সান্নিধ্যের আবেগঘন আকুলময় মহাডাক এলো নবিজির জীবনে। আল্লাহ রূহানী উপহারে-উপঢৌকনে ছেয়ে দিলেন তাঁর প্রিয় হাবীবকে। অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনের সুরভিত সুখন মায়ায় প্রেম সোহাগে ভরে দিলেন তাঁকে। আর কোনো সৃষ্টি, ফেরেশতা, নবি-রাসূলের নসিবে জুটেনি এমন নজীরবিহীন মহাসফর। আকুল নিশ্বাসে ‘ইসরা ও মিরাজ’ অধ্যায়ে লেখক যার আলোচনা করেছেন জগত মম তুমুল আনন্দে, নিখিল বন্ধন খুলে অঙ্গেভঙ্গে হিল্লোল শশী সুশোভনে—যেন এক পরিপূর্ণ বসন্ত সমীরণে।
এক পর্যায়ে অরুণ আলোর করুণ পরশে গ্রন্থটির প্রথম খন্ড শেষ হয়ে যায় ‘কবীলায় কবীলায় ছড়িয়ে গেলো ইসলামে মহাআহ্বান’ অধ্যায়ে এসে। শেষ হতেই পাঠকের মনে হবে—যেন ভরদুপুরে আচমকা সন্ধ্যা নেমে এসেছে শিরে শিরে। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে হারিয়ে যাবেন পাঠ-মুগ্ধতার গুঞ্জরণে। যেমনটা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে লেখকের সুধাশ্যামল নিবিড়তিমির শব্দলীলার ঘোরে। এখন বিদায় বাঁশির করুণ রবে আমি এই গ্রন্থটির দ্বিতীয় খন্ডের অপেক্ষায় আছি এমনভাবে, প্রথম গর্ভবতী রমনী—যেভাবে সন্তান প্রসবের অপেক্ষায় থাকে। নিশ্চয়ই আপনিও আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দামাত বারাকাতুহুম) লিখিত ‘আল্লাহর পরে শ্রেষ্ঠ যিনি’ সীরাত গ্রন্থের প্রথম খন্ড পড়লে, আমার মতো করে দ্বিতীয় খন্ডের অপেক্ষায় তাসবি দানা গুনে গুনে দিন পার করতে থাকবেন। এ আমার ঝলোমলো টলোমলো উদ্দাম উতল উচ্ছ্বাসের দৃঢ় বিশ্বাস।