আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হোক ওয়াজ মাহফিল

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হোক ওয়াজ মাহফিল

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

ছোট্ট সোনার দেশ এই বাংলাদেশ। এদেশের মানুষ ধমর্প্রাণ। অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে চলে। সেই সাথে কোরআন-হাদীসকে ভালবাসে সকলে। কোরআনের আলোচনা, তাফসীর, ব্যাখ্যা এসব শুনতে চায় তারা। ধর্মীয় রীতি-নীতি কম পালন করলেও ওয়াজ শোনার পাগল। তাফসীর শোনার ভক্ত। কিছু লোক আছে, নামাজ রোজা কম করলেও আলেমদের ওয়াজ শুনতে চায়। কোথাও ওয়াজ মাহফিলের কথা শুনলে সেখানে হাজার হাজার মানুষ গিয়ে ভীড় জমায়।

এখন আশ্বিন মাস চলছে। কদিন পরেই আসছে কার্তিক মাস। তখন হালকা শীত অনুভূত হবে। বৃষ্টি কম থাকবে। মাঠ-ঘাট শুকিয়ে যাবে। ঠিক এই শুস্ক মৌসুম থেকেই আমাদের দেশে ওয়াজ মাহফিল শুরু হয়ে যাবে। একটানা ফাল্গুন-চৈত্রমাস পর্যন্ত চলবে, পুরো দেশব্যাপি। কওমী মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ এ সকল ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করে থাকেন। এমনিভাবে বিভিন্ন মসজিদ কর্তৃপক্ষ,  বিভিন্ন বাজারের কর্তৃপক্ষ বা কোথাও কোথাও ব্যক্তি উদ্যোগেও ওয়াজের আয়োজন হয়। আবার কোথাও পীরের খানকার উদ্যোগে ওয়াজের আয়োজন হয়ে থাকে। মোটকথা, এই শীত মৌসুমে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ওয়াজ মাহফিলের হিড়িক পড়ে যায়।

অবশ্য ওয়াজ মাহফিল দ্বারা ব্যাপক ফায়দা হয় মানুষের। ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত হয়। মানুষের চিন্তাচেতনায় আমূল পরিবর্তন ঘটে। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে চলে আসে। অজানা বহু জিনিস মানুষ জানতে পারে। সভ্যতা-সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে ওয়াজ মাহফিল। ধর্মীয় আবেগ, ধর্মীয় জযবায় মানুষ তৈরী হয়ে দ্বীন-ইসলামের রশি আঁকড়ে ধরে। হাজারো মানুষকে দেখা যায়, ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে তারা নিজের জীবনকে সুন্দর করেছেন। ইবাদত বন্দেগীর গাফলতি কাটিয়ে নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে ইবাদতে জুড়েছেন। এই ওয়াজ মাহফিলের সবচেয়ে বড় ফায়দা হল, সামগ্রিক এক দ্বীনি চেতনা নিয়ে মানুষ বাড়ি ফিরে আসে।

আরও পড়ুন: ফেদায়ে মিল্লাত: নুরানী আলোয় উদ্ভাসিত যিনি

তবে ওয়াজ মাহফিলের সেই সুন্দর পরিবেশ ও মানুষের উপকারের পরিবর্তে কিছু ক্ষতিকর দিক বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আগের সেই ওয়াজ মাহফিল থেকে মানুষ যেমন দ্বীনি চেতনা নিয়ে ফিরেছে, সেটার হার যেন এখন কমে এসেছে। এখন সেই পরিবেশে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে গেছে। এর কারণ কয়েকটি বোঝা যায়ঃ

১. ওয়াজ মাহফিলের বক্তার ইলম নেই। তিনি ইলম ছাড়া ওয়াজ করেন।

২. বক্তা এখন দ্বীনি আলোচনা বাদ দিয়ে কমেডিয়ান সেজেছেন। মঞ্চে বসে হাসি-তামাশার কথা বলেন।

৩. গানের শিল্পি হয়ে গেছেন ওয়াজের বক্তা। তিনি তো গান গেয়েই সময় কাটান। একারণে ওয়াজে দ্বীনি কথাবার্তা বলেন না।

৪. কিছু বক্তা আগেভাগে টাকার চুক্তি করেন। ধর্মের বানী পৌঁছানোর চেয়ে ব্যবসাই যেন তার মুখ্য উদ্দেশ্য। একারণে তার কথায় শ্রোতার অন্তরে কোনো প্রভাব পড়ে না, আছর হয়না।

৫. কিছু বক্তা ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। মূল আলোচনা কেউ বুঝতে পারেনা।

৬. কেউ ওয়াজে উঠে অন্য আলেমের গীবত-শেকায়েত করতে থাকেন। এর দ্বারাও মানুষ কোন উপকার পায়না।

৭. কিছু বক্তা আছেন যারা আলেম নন। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেননি, করলেও বড়জোর কয়েকক্লাস পড়েছেন। তাদের কোরআন পড়াই সহী না। তারা এখন বক্তা। টাকার লোভে ওয়াজ করে বেড়ান।

৮. সর্বোপরি লিল্লাহিয়্যাত কমে গেছে বহু বক্তার। আগের মতো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা লোকের বড় অভাব।

তাই সকলকে সতর্ক হওয়া দরকার।  ওয়াজ মাহফিলকে সেই আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যহত রাখতে হবে। ইলম ছাড়া বক্তা, মুর্খ-জাহেলদের বয়কট করা প্রয়োজন। এগুলো না করলে ওয়াজ মাহফিলের সেই ঐতিহ্য ও শান বজায় রাখা যাবেনা।

একটু লক্ষ্য করুন, আগে মানুষ আল্লাহর ভয়, আখেরাতের ভয়, কবর, হাশর- নশর, জাহান্নামের ভয় নিয়ে মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরেছে। এর কারণ ছিল, তখনকার বক্তারা এসব ওয়াজ বেশী করতেন। বক্তাও নিজেও হতেন আল্লাহর খাছ পেয়ারা বান্দা।

আর এখন মানুষ বাড়ি ফেরে গান গাইতে গাইতে। অর্থাৎ, বক্তা মাহফিলে কোনো জনপ্রিয় হিন্দিগান বা বাংলাগান নকল করে ইসলামী গান নাম দিয়েছে। সেটা ওয়াজ মাহফিলে পরিবেশন করা হচ্ছে। সাধারণ জনতা সেখানেই মুখস্ত করে নিয়েছে । তাই তো বাড়ি ফেরার সময় ঐ গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে।

বড় পরিতাপের বিষয়, ওয়াজ মাহফিলের সেই রুহানিয়্যাত আজ আর বাকি নেই। যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরী।

তাই মনে রাখতে হবে, ওয়াজের মাহফিলে দ্বীনি কথা ছাড়া অশালীন কথা, অনৈতিক কথা পরিহার করতে হবে সকলকে। যারা ওয়াজ মাহফিলকে বিনোদন কেন্দ্র বানাতে চাচ্ছে বা বিতর্কিত করতে চাচ্ছে, তাদেরকে সতর্ক করা দরকার।

আসুন! আমরা আওয়াজ তুলি, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হোক দ্বীনি আলোচনা, ওয়াজ মাহফিল। আমাদের সব কাজে থাকুক আল্লাহ পাকের রেজামন্দি।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের নেক কাজগুলো কবুল করুন। আমিন।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিষ্ট

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *