আল্লাহর সাথে লেনদেন | মুহাম্মাদ আইয়ুব

আল্লাহর সাথে লেনদেন | মুহাম্মাদ আইয়ুব

আল্লাহর সাথে লেনদেন | মুহাম্মাদ আইয়ুব

জকিগঞ্জের জনাব নুরুদ্দিন। বাবা-মা, শশুর-শাশুড়ি, ভাই-বোন, বউ সবার কাছে তার পরিচয় হাবাগোবা; না পারে টাকা কামাই করতে, না পারে কাউকে সুন্দর করে দু’চার কথা গুছিয়ে বলতে। অথচ জনাব নিজে নিজের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হিসেবে পরিচিত।

আসল গোলযোগটা এখানেই। নুরুদ্দিন সাহেবের মতে রাসূলের (সাঃ) কথা আদৌ ভুলভাল বা অসত্য হতে পারে না। এটা তার শৈশব থেকে লালন করা বিশ্বাস, যে বিশ্বাসে আজও চিড় ধরে নি, ধরার দূরতম সন্দেহও নেই। ব্যাপারটা বুঝতে একটু সামনে যেতে হবে পাঠক!

জনাব নুরুদ্দিনের ফ্যামেলি মেম্বারদের বিশ্বাস সব শান্তি টাকা পয়সায়। তাই বুদ্ধিমান তো সে যে সময়মতো পয়সা কামাইতে মন দেয় অথচ হাবাটা অহরহ পয়সা কামানোর সুযোগ পেয়েও হেসে-খেলে হাতছাড়া করে। আর হযরত নুরুদ্দিনের কথা হচ্ছে, আমি তো দেখি পয়সাওয়ালারা না খেয়ে মরছে, যার যত পয়সা তার সাথে টেনশনের বন্ধুত্ব তত বেশি। সুতরাং অল্প কয়দিনের এ জীবনে টেনশনে মরব কেন? তার বিশ্বাস সব শান্তি অল্পেতুষ্টিতে। এর সাথে পরকালমুখীতা আর মানব সেবা যদি থাকে তাহলে তো কেল্লাফতে।

জনাব আর পরিবারের দ্বন্দ্বটা ঠিক এখানেই। নুরুদ্দিন বহু যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও টাকা ইনকামের বেলায় সে বরাবর অযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে গেছে। সে ক্যালকুলেশন করে দেখল সংসার ও বাবা মা’র পিছনে সর্বসাকুল্যে মাসে ব্যয় হয় ১২ হাজার টাকা। তাই সে তার ইনকাম ১২ হাজারে সীমাবদ্ধ রেখেছে। এদিক সেদিক থেকে টাকা ইনকামের অনেক অফার আসলেও সে মোটেও পাত্তা দেয় না। যুক্তি একটাই বারো হাজারের উপর আমার দরকার নেই। সুতরাং টেনশন নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোন মানেই হয়না।

মাওলানা নুরুদ্দিন তার এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক মানুষের সাথে লেনদেন করেছে কিন্তু সবখানে তার সাক্ষাৎ হয়েছে মুসলিম নামধারী বাটপার-চিটারদের সাথে। সে এখন মুসলমানের এই দেশে চিটার-বাটপারদের খনি দেখে। এ যেন ভেজালের স্বর্গ। তাই নির্ভেজাল লেনদেনের জন্য সে এমন কাউকে খুঁজল যে তাকে অন্তত ঠকাবে না।

খুঁজতে খুঁজতে সে সন্ধান পেল এমন এক সত্ত্বার যিনি কাউকে ঠকান তো না-ই উল্টো লাভের পর লাভ দিতেই থাকেন। জ্বি! জনাব নুরুদ্দিন সন্ধান পেয়েছে তার মহান মাওলার, বিশ্বজগতের প্রতিপালক সুমহান আল্লাহর। তাই তাঁর এবারের মিশন এই মালিকের সাথে লেনদেনে যুক্ত হওয়া। বড় থেকে বড় স্কিম ধরা। একের পর এক আল্লাহর সাথেই নিত্য নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল সে কারণ এ দরবারে প্রাপ্তি ছাড়া হারানোর কিছুই নেই। কুরআন হাদিস ঘেটে দেখল এই দরবারে লেনদেনের ক্যাটাগরি অনেক। সব পরকালীন হলেও পার্থিব জীবনের সুখ সমৃদ্ধি এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

নুরুদ্দিন প্রথমে গেল কুরআনের ক্যাটাগরিতে। এখানে এসে দেখল আল্লাহর কাছে সবচেয়ে উত্তম ঐ ব্যক্তি যে কুরআন শিখবে এবং অপরকে শেখাবে। ব্যস শুরু হয়ে গেল কুরআন শেখা ও শেখানের ক্যাম্পেইন। এই ক্যাটাগরির অন্যখানে দেখল, কুরআন শরিফের এক অক্ষর পড়লে আল্লাহ দেন দশ নেকি। এ লেনদেনেও সে ঝাপিয়ে পড়তে দেরি করল না। দিনে তিনপারা করে পড়ে মাসে তিন খতম করে আখেরাতের এ্যাকাউন্ট ভরতে বদ্ধপরিকর হয়ে গেল।

আরেক জায়গায় দেখল পিতামাতার সেবা করলে আল্লাহ সোজা ভিআইপি জান্নাতে জায়গা করে দিবেন, আলিশান রাজ্য দিবেন ব্যস। ধ্যান মন লাগিয়ে সে বাবা মা’র সেবায় লেগে গেল। দুরুদের ঐখানে গিয়ে দেখল, রাসূল সাঃ এর উপর একবার দুরুদ পড়লে আল্লাহর পক্ষ থেকে দশটি রহমত বর্ষিত হয়। এই কারবারে পিছিয়ে না থেকে প্রত্যেক নামাজের পর একশো বার দুরুদ পড়া শুরু করে দিল।

মজার একটা অফার সে দেখতে পেল ফ্যামেলি ক্যাটাগরিতে যে, পরিবার পরিজনের জন্য খরচ করলেও নাকি আল্লাহ নেকি দান করেন। আর দেরি না করে বাজার থেকে সেরা পণ্য পরিবারের মুখে উঠিয়ে দেওয়া শুরু করে দিল।

দিনদিন আল্লাহর সাথে তার লেনদেন বাড়তে লাগল। আর জোয়ারের মতো তার বরকত ও প্রভাব আত্মিকও জাগতিকভাবে সে অনুভব করতে লাগল।

সে জেনেছে যে, সমস্ত সৃষ্টিজীব আল্লাহ তা’আলার পরিবার। আল্লাহর কাছে ঐ ব্যক্তি অতি প্রিয় যে তার পরিবারের সাথে সৎ ব্যবহার করে। আর কোন কথা নাই, আল্লাহর প্রিয় হতে নুরুদ্দিন দল-মত, জাত-পাত নির্বিশেষে সবার সাথে ভাল ব্যবহার করতে শুরু করল।

অন্যখানে গিয়ে তো তার চক্ষু ছানাবড়া! রাসূল সাঃ সর্বোত্তম মানুষের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে
যে আল্লাহকে ভয় করে, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে, মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দান করে এবং অসৎ কাজ থেকে বাঁধা দেয়; তখন সে এই গুণগুলো অর্জনে কোমরে গামছা বেঁধে ময়দানে নেমে পড়ল।

নুরুদ্দিনের আবার অধিক বউ চাই যেটা দুনিয়াতে একপ্রকার অসম্ভব কিন্ত যখনই জানতে পারল যে, মসজিদ পরিষ্কারের সাথে একটা আকর্ষনীয় অফার আছে অর্থাৎ যারা মসজিদ পরিষ্কার করে জান্নাতের ডাগর আঁখি বিশিষ্ট হুররা তার অপেক্ষায় থাকে সেদিন থেকে নুরুদ্দিন মসজিদে কোন ময়লা আবর্জনাকে জায়গা দেয়নি সব ঝেটিয়ে বিদায় করেছে।

বড় ভাই সায়রুদ্দিনের সাথে একটু আধটু বিবাদ হয়েছিল সেই মাস তিনেক আগে, এর মাঝে আর কথা হয়নি। কিন্তু রাসূলের (সাঃ) পবিত্র জবানের নতুন এক লেনদেনের কথা শুনে তো তার হুঁশ নেই। সন্ধ্যার পরপরই হাজার খানেক টাকার ফলমূল মিষ্টামুষ্টা নিয়ে খুলনার পথে পা বাড়াল। কারণ যেখানে রাসূল সাঃ বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতি লোকদের ব্যাপারে বলব না? সাহাবিদের সোৎসাহ কন্ঠ শুনে বললেন, নবীগণ জান্নাতি, সিদ্দিকগণ জান্নাতি, আর ঐ ব্যক্তি ও জান্নাতি যে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শহরের দূরবর্তী এলাকায় নিজের ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে যায়। এই সংবাদ শোনার পর নুরুদ্দিন ঘরে বসে থাকবে এত বড় বোকা সে নয়।

আহ! নুরুদ্দিনের লেনদেন কতই না উত্তম লেনদেন।

লেখক : খতিব ও প্রাবন্ধিক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *