আসছে করোনার তৃতীয় ঢেউ

আসছে করোনার তৃতীয় ঢেউ

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : দেশে করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। ডেলটা ধরনের অতিসংক্রমণের ক্ষমতা এবং মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার উদাসীনতায় করোনা পরিস্থিতির দিনদিন অবনতি ঘটছে। তারপরও লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কেউ কোয়ারেন্টাইন মানেন না। সর্বত্রই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। এ কারণে দ্বিতীয় ঢেউ শেষ হতে না হতেই ধেয়ে আসছে করোনার তৃতীয় ঢেউ।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনায় মৃত্যু ও রোগী শনাক্ত দুটোই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে (১৩ থেকে ১৯ জুন) তার আগের সপ্তাহের (৬ থেকে ১২ জুন) চেয়ে মৃত্যুহার বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। এই সময়ে রোগী শনাক্তের হার বেড়েছে ৫৫ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা বলেন, সামনে কোরবানির ঈদ, বসবে পশুর হাট। গত ঈদে লকডাউন দিয়েও ঘরমুখী মানুষের স্রোত থামানো যায়নি। আর কোরবানির পশুর হাটে কেউ মানে না স্বাস্থ্যবিধি। এ কারণে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। আর সেটি হবে ভয়ঙ্কর। তাই শুধু টিকায় জোর দিলে হবে না, আমলে নিতে হবে স্বাস্থ্যবিধিও। সর্বত্রই স্বাস্থ্যবিধি মানাতে মানুষকে বাধ্য করতে হবে। তাহলেই দেশ ভয়াবহ অবস্থা থেকে রক্ষা পাবে।

এছাড়া ঢাকার বাইরে বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ বাড়ছেই। স্থানীয় প্রশাসন শুধু ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে দায়িত্ব শেষ করেছে। ফলে ঐ সব জেলা-উপজেলায় ‘লকডাউন’ নামকাওয়াস্তে চলছে। ‘লকডাউন’ ঘোষিত এলাকার সড়ক ও বাজারে জনগণের উপস্থিতি আগের মতোই থাকছে। অপ্রয়োজনে ঘোরাঘুরি করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

উত্তরাঞ্চলে যখন সংক্রমণ বাড়তে শুরু করল, তখন লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে আজকের এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এখনই সতর্ক না হলে দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ঢাকার বাইরে করোনা চিকিৎসা সেবার সক্ষমতা নেই। দেশের অর্ধেকের বেশি জেলায় আইসিইউ নেই। কোভিড মহামারির মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পর এক বছর কেটে গেলেও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ ব্যবস্থা চালু হয়নি।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৭টিতেই কোভিড চিকিত্সার জন্য আইসিইউ নেই। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের পাঁচটি, চট্টগ্রামের আটটি, রংপুরের ছয়টি, সিলেটের দুটি, বরিশালের চারটি, খুলনার চারটি, রাজশাহীর ছয়টি ও ময়মনসিংহের দুটি জেলা রয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বাদে বিভিন্ন জেলায় ‘হাই ফ্লো নেইজল ক্যানুলা’ সংবলিত আইসিইউ সমতুল্য শয্যা আছে ১ হাজার ৬০৩টি। ১১টি জেলায় সেরকম শয্যাও নেই।

এ কারণে বাইরে থেকে রোগীরা ঢাকায় আসছেন। ইতিমধ্যে রাজধানীতে আইসিইউ শয্যা রোগীতে পূর্ণ হওয়ার উপক্রম। সামনে কোরবানির ঈদ। ঘরমুখী মানুষের স্রোত নামবে। কোরবানির পশুর হাটে মানুষের ভিড় হবে। তখনই শুরু হবে করোনার তৃতীয় ঢেউ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করার দুটি উপায়—টিকা ও স্বাস্থ্যবিধি। সবাইকে টিকা দেওয়া গেলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ দূরের কথা, দ্বিতীয় ঢেউই আসত না।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, করোনার সংক্রমণ রোধ করতে হলে টিকা দিতে হবে এবং সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তবে আমাদের জীবিকার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকা কী হবে, তার সঠিক দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। তাহলেই লকডাউন বাস্তবায়িত হবে এবং করোনা নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে। ভারত, ইউরোপ, ব্রাজিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রথমে করোনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরে ব্যাপকভিত্তিক ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে করোনা নিয়ন্ত্রণ করেছে তারা।

তিনি বলেন, যে যেখানে আছে, সেখানে ঈদ করবে—সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে কোথায় সংক্রমণ বেশি, সেটা বোঝা যাবে এবং অধিক সংক্রমিত এলাকা চিহ্নিত করে কঠোর লকডাউন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ করতে হবে স্বাস্থ্য বিভাগকে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, ২০১৮ সালের সংক্রামক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, মহামারি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অধিক সংক্রমিত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। যারা দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন এবং করোনা নেগেটিভ তারাই শুধু কোরবানির পশুর হাটে যেতে পারবেন—এমন নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ইজারাদারদের কঠোর নির্দেশনা দিতে হবে। গত ঈদে যেভাবে মানুষ যাতায়াত করেছে, এবার সেই অবস্থা হলে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে আর দেরি হবে না।

করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, দেশে লকডাউনের নামে ভাঁওতাবাজি চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বছর আগেই দেশের সব জেলায় আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। সব জেলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা চালু হয়নি, যে কারণে করোনা রোগীদের নিজ নিজ জেলায় চিকিত্সাসেবা দেওয়া সম্ভব হয়নি।

সবাই ঢাকায় এলে করোনা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে যখন সংক্রমণ বৃদ্ধি শুরু হলো, তখন সেখানে লকডাউন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। এ কারণে সংক্রমণ বেড়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে লকডাউন দিতে হবে এবং তা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। কোয়ারেন্টাইনে ১৪ দিন রাখতেই হবে। এ ব্যাপারে কোনো আপস করা যাবে না। তাহলেই করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *