আয়েশা, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা

আয়েশা, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা

মনজুর সা’দ

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আয়েশার সাথে ইশারায় কথা হচ্ছে ফুয়াদের। পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে তারা থাকে। ফুয়াদরা বেশ আগে থেকে হলেও আয়েশারা এই বাসায় উঠেছে নতুন। এরই মধ্যে ফুয়াদের আম্মুর সাথে আয়েশার আম্মুর বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। শুধু তাই না! ভালো কিছু রান্না হলে তারা একে অপরকে দেয়।

আয়েশা দেখতে সুন্দরী। খুব লাজুক প্রকৃতির মেয়ে। কথা বলার সময় মুচকি মুচকি হেসে।

এই রাস্তায় সারাক্ষণ সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে থাকে। মৃত্যুপ্রায় নগরী। নিষিদ্ধ নগরী। কেউ কোথাও যেতে পারছে না। কিছু করতে পারছে না। চার দেয়ালে বসে বসে দিন কাটাচ্ছে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়। এই জন্যই আয়েশার আম্মু এ বাসায় এখন বেশি একটা আসতে পারেন না। ফুয়াদের আম্মুর সাথে দূর থেকে ইশারায় কথা হয়।

হোমকোয়ারেন্টাইনে থেকে ফুয়াদ কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে। সারাদিন বই পড়ে কিচুটা ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করে। দেখলে মনে হবে এই হলো প্রকৃত বইপ্রেমী। ফুয়াদ সারাক্ষণ দখিনা জানালা খোলে বই পড়ে। আর জানালার গ্রীলে হেলান দিয়ে বসে ডায়েরিতে কী যেন লিখে! আয়েশা বেশ কিছু দিন হলো ফুয়াদকে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখছে। এর আগে কখনো সে তাকে দেখেনি।

সত্যি ছেলেটা অনেক সুন্দর। এতো কী পড়ে! খুব ঈর্ষা হয়। আমি কেন এতো পড়তে পারি না? অদ্ভুত তো। এতো মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারে মানুষ!

রাত ন’টা। সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠল ফুয়াদ। বাম হাতে চায়ের কাপ। ডান হাতে নাটি বিস্কুট। ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে চা’য়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। চা শেষ কিন্তু বিস্কুটের প্যাকেটে কয়েকটা বিস্কুট এখনো আছে। ফুয়াদ পেটে হাত দিয়ে বলল,’নাহ্,আর খেতে পারছি না।’

ছাদ থেকে সে শহর দেখছে। পুরো শহর নিরবে কান্না করছে। কোনো হৈচৈ নেই। নেই চিৎকার চেচামেচি। মরা মরা লাগছে শহরটাকে। রাস্তার সোডিয়াম লাইটের আলোগুলোও যেন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে পুরো শহর জুড়ে। মৃদু বাতাস অনুভব করছে। আজ আকাশটা তাঁরা ভরা। তাকিয়ে আছে ফুয়াদ নিবিষ্ট মনে। তাঁরাদের সাথে যদি একটু মিতালি করতে পারতাম। আহ, কতো ভালো লাগতো!

এক দুই তিন এই তো চার! দূর প্যাচ লাগছে কেন? ফুয়াদ জানে যে, সে তাঁরা গুনতে পারবে না। তবুও গুনতে ভালো লাগছে। শৈশব কালে বাড়ির উঠোনে ভাই-বোনরা মিলে তাঁরা গুনার প্রতিযোগিতা করতো।

হঠাৎ পাশের ছাদ থেকে হালকা হাসির শব্দ শুনলো ফুয়াদ। ফুয়াদের বাচ্চামি দেখে আয়েশা হাসি দমিয়ে রাখতে পারলো না। তাই হেসে উঠল। এদিকে ভীষণ লজ্জা পেলো ফুয়াদ।

এই যে শুনুন, ফুয়াদ এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো, আমাকে বলছেন?
জ্বি আপনাকেই। আশেপাশে কি কেউ আছে যে তাকে বলব?
ফুয়াদ মনে মনে বলল, মেয়েটার হয়তো হাসির রোগ আছে। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি সে। বুকের ধুকধুকানি বাড়তে শুরু করেছে।

– জান্নাত কি বাসায় আছে? (জান্নাত ফুয়াদের ছোট বোন।)
– জি, বাসায়।
– ও আচ্ছা।
– সময় পেলে একটু আমাদের বাসায় আসতে বলবেন। ওর সাথে কথা আছে।
– জি আচ্ছা।
– এতো জি জি করছেন ক্যান?
– আমি কি আপনাকে খেয়ে ফেলব? হিহিহিহি…
– আসলে আমি….
– জানি জানি আমাকে চিনতে পারছেন না তো! আপনার আম্মু আমার আন্টি হয়। আমার আম্মুর বান্ধবী। আর আপনার বোন আমার বান্ধবী।
– জি, এখন বুঝতে পেরেছি।
– আবার! হিহিহিহি…
– ওহ হে। হুম।

ফুয়াদ সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠল। এ কী! এতো ঘাম কোত্থেকে এলো? ওরে বাবা! এই মেয়েকে যে বিয়ে করবে ওর জীবন ত্যানত্যানা হয়ে যাবে। জীবনের শেষ ঘন্টা বেজে যাবে। অতি অল্প সময়েই!

সকাল। সূর্যের আলো আসছে পর্দা বেধ করে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠল। ফুয়াদের বোন চা দিয়ে গেছে। ঘন্টা খানিক আগে। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তারপরও একটা চুমুক দিল। ফুয়াদ ছাদের অল্প একটু জায়গায় শখের ছোট্ট একটা বাগান করেছে। বেশ কিছু গাছ ফুয়াদের বাবা আমজাদ সাহেব গার্ডেন থেকে কিনে এনেছেন। মাস দুয়েক হবে। তাও আবার ফুয়াদের পীড়াপীড়িতে। বাগানের পরিচর্যা ওর মা’ই করে। ফুয়াদ যখন বাসায় থাকে তখন সেই করে। খুব আনন্দের সাথে। গাছে পানি দেয়। অনেক দিন হলো, বাগানের খোঁজ খবর নেওয়া হয় না। তাই আজ ভাঙা টবগুলো পরিষ্কার করছে ফুয়াদ।

– কি করেন মালি সাহেব?
– আপনি আবার?!
– সে কী?
– আমি কি আসতে পারবো না!
– এটা তো আমাদের ছাদ। আর ওটা আপনাদের।
– হুম।কিন্তু…

ফুয়াদ এই ফুয়াদ!
জি মা।
বাসায় একটু আয়।
আসছি মা।

আয়েশা মামুণি কেমন আছো?
জি আন্টি ভালো। তবে…
তবে কি?
আপনি আমাদের বাসায় এখন আসেন না কেন ?
দ্যাখো না দেশের যে অবস্থা! সারাক্ষণ সেনাবাহিনী রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। যাকেই বাইরে দেখবে তাকেই জেরা করবে। কী দরকার আছে। শহরে সুস্থ হোক। আসব তোমাদের বাসায়।

কাজ শেষ করে ফুয়াদ বলল, আম্মু আমি চলে গেলাম। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।

ফুয়াদ শোন, পরিচয় করিয়ে দেয়। এই আয়েশা হচ্ছে তোর ঐ বাসার আন্টির মেয়ে।
ফুয়াদ হড়হড় করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলো। শুনছে বলে মনে হল না।

বারান্দায় বসে আয়েশার দাদি পান চিবাচ্ছে। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেছে। রুমে প্রচুর গরম। ভ্যাপসা গরম। ফুয়াদ হাতে একটা বই নিয়ে পড়তে পড়তে বারান্দায় এলো। বাতাস এসে গায়ে লাগছে। বেশ ভালোই লাগছে। আয়েশার দাদি পানে পিচকিরি ফেলার সময় জোরে একটু আওয়াজ করল। হু ওয়াক থু!

ফুয়াদ বই থেকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে। এলাহি কান্ড। বেশ ভালোই জাবরকাটতে পারে দেখি আয়েশার দাদি। গরুর মতো সারাদিনই মনে হয় জাবরকাটে।

আয়েশা ভেজা এলোমেলো চুলে বারান্দায় কাপড় নাড়ছে। হয়তো একটু আগেই গোসল সেরেছে। এখনো চুলগুলো ভেজা। আজ আয়েশাকে বেশ অন্য রকম লাগছে। খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ফুয়াদের সাহসেই কুলাচ্ছে না। জানালার পর্দা হালকা সরিয়ে গ্রীল ধরে গুনগুনিয়ে কবিতা আবৃত্তি করছিল। রবিঠাকুর ঠিক এ ধরনের কোনো একটা মেয়েকে দেখে লিখেছিল- ‘মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে/বাজিলো বুকে সুখের মতো ব্যথা।’

কখন যে তার আম্মু ওর রুমে আসছে ও বুঝতেই পারেনি। আয়েশা রুমে চলে গেল। ফুয়াদ জানালা থেকে মুখ সরাতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

– আরে আম্মু, তুমি কখন এলে?
– মিনিট পাঁচেক আগে।
– কতোবার বলছি ঘরে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নিবে, কিন্তু তুমি…
– আমি এসব প্রেম-প্রীতি পছন্দ করি না। আর যেন না দেখি।
বলে চলে গেলেন আম্মু।

২.

ফুয়াদ আর আয়েশার মাঝে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুয়াদ আয়েশাকে ইশারায় বলছে, আয়েশা, শুনো, আম্মু এসব পছন্দ করেন না। আমার আর বারান্দায় আসা হবে না। আমাদের কথা হবে না। আয়েশা কী যেন বলতে চেয়ে থেমে গেলো। ফুয়াদ পিছনে তাকিয়ে দেখে…

বাসায় আয়েশার বাবা মা দাদি সবাই আসছেন। মহল্লার ইমাম সাব এখনো আসছেন না কেন? বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুয়াদের বাবা পায়চারি করছেন। প্রায় ঘন্টা খানিক হয়ে গেলো কিন্তু আসছেনা কেন? এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। ফুয়াদের বাবা দরজা খুলে দিল। ইমাম সাব এসেছেন। হাতে বিশাল বড় একটা বক্স।

এ কী! আপনি এগুলো কি নিয়ে এসেছেন? তেমন কিছু না। ফুয়াদ আর আয়েশার জন্য সামন্য কিছু উপহার। ইমাম সাহেব বিয়ের খুৎবা পড়লেন। ওদের জন্য বরকতের দোআ করে বিদায় নিলেন। ফুয়াদ মুচকি হাসছে। হোমকোয়ারেন্টাইনে থেকেও যে এতো বড় একটা উপহার পাবে বাবা মার কাছ থেকে। সে কখনো কল্পনাও করতে পারেনি।

রাতেই চলে গেলো আয়েশার বাবা মা। আয়েশার দাদি ফুয়াদের রুমের দরজা লাগিয়ে কী যেন বলছে আয়েশাকে। একটু পর বের হলেন। ফুয়াদ কতো করে বলল, আজ থেকে যান না দাদি।

– ফুয়াদ,আজ থাকব না। অন্য আরেকদিন। আয়েশা ভেতরে আছে। একা, একা। খুব লজ্জা পাচ্ছে গিয়ে দেখো। তোমার সঙ্গিনী তোমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
– এই,বারান্দায় চলো। চাঁদ দেখি। আজকে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। বিছানা থেকে উঠে একটু বারান্দায় এসে দ্যাখো না। কি সুন্দর চাঁদ! ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’

আয়েশা বলল,আচ্ছা, এটা কোন কবি যেন বলেছেন? না,মনে করতে পারছি না। কবির প্রতি খুব রাগ হচ্ছে, এতো সুন্দর একটা কবিতা সে লিখে ফেলল। অথচ এই কবিতা লেখার কথা ছিলো আমার। এই তো মনে পড়েছে, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। হে মহাজীবন কবিতায় লিখেছেন।

– আজ সারারাত কবিতা আবৃত্তি করে শুনাবেন।
– উঁহু,এই পূর্ণীমা রাতে আমি তোমাকে আবৃত্তি করব। তুমিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা!

লেখক: শিক্ষার্থী, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *