আয় কমেছে, বেড়েছে ব্যয়

আয় কমেছে, বেড়েছে ব্যয়

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : দেশে মূল্যস্ফীতি গত কয়েক বছরে সর্বোচ্চ। আয় কমেছে মানুষের। বেড়েছে ব্যয়। অনেক নিত্যপণ্যের দাম নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। বিভিন্ন প্রসাধনীর দামও আকাশচুম্বী। এর মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কা খোদ সরকারপ্রধানের মুখে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে খাদ্য সংকটে পড়া দেশের তালিকায়ও রয়েছে বাংলাদেশ, যা বাড়তি চাপ তৈরি করেছে সব শ্রেণির মানুষের। এর মধ্যে দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দামও বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। সব মিলে ওষ্ঠাগত জনজীবন।

খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগ এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা কিছুটা বেশি। সেখানে বাইসাইকেল মেরামতকারী জালাল মিয়া বলেন, ‘এমনিতে সংসার চলছে না আগের মতো। এক ছেলে স্কুল বাদ দিয়ে দোকানে লেগেছে। সঞ্চয় দূরের কথা, এখন প্রতি মাসে ধার করছি। পাওনাদারের তাগাদায় একরকম পালিয়ে বেড়াতে হয় মাস শেষে। এর মধ্যে দুর্ভিক্ষের খবরের পর থেকে ঘুম হয় না।’

তিনি বলেন, ‘এখন এ পরিস্থিতিতে অন্য কার কী ক্ষতি হচ্ছে জানি না। তবে আমার সন্তানের পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলো। সেটা পোষাবো কীভাবে? আমিও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছি, সেটা না হয় একসময় ঠিক হয়ে যাবে।’

ওই এলাকায় জালাল মিয়ার মতো আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের দুরবস্থা ও দুশ্চিন্তার কথা জানা যায়। শুধু সেখানেই নয়, দেশে গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় সবখানে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের বেশি ভোগাচ্ছে। শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও চাপে আছেন।

তারা বলছেন, পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে যে যার মতো মানিয়ে চলার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন খাতে নানাভাবে নিজেদের খরচ কাটছাঁট করছেন। কেউ দামি খাবার খাওয়া কমিয়েছেন, কেউবা বন্ধ রেখেছেন পোশাক কেনা। আবার কেউ বাসা পাল্টিয়ে খরচ সাশ্রয় করছেন।

সিপাহীবাগ এলাকায় কথা হয় সালাউদ্দিন আহমেদ নামে একজনের সঙ্গে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের এ চাকরিজীবী বলেন, ‘ছেলেমেয়ে পল্লীমা একাডেমিতে পড়ে। শুরু থেকে স্কুলের পাশে চৌধুরীপাড়া এলাকায় থাকতাম। সেখানে বাসাভাড়া বেশি। সেজন্য এখন এ এলাকায় এসেছি।’

তিনি বলেন, ‘তাতেও হিসাব মেলে না মাস শেষে। সেজন্য বাজার খরচ ও ঘোরাফেরা কমিয়ে দিতে হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে বাবা-মায়ের। গ্রামে তাদের খরচ পাঠাতে পারছি না আগের মতো।’

বিগত কয়েক মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) ছাড়া আরও কিছু খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থা বলছে, ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে অনেক দেশ। বৈশ্বিক এ মন্দার কবলে পড়লে বিশ্বের ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে। এসব সংস্থার খাদ্য সংকটের তালিকায় নাম আছে বাংলাদেশেরও।

সাধারণ মানুষ বলছে, গত কয়েক মাসে বাজারে কোনো সুখবর নেই। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকে বৈশ্বিক পণ্যবাজারে দামের উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে দেশের বাজারে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবও পড়েছে। এতে কয়েক দফা বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম। দুর্ভিক্ষের খবরের পর আবারও দফায় দফায় পণ্যের দাম বাড়ছে, যা এখন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেই খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ।

বাজারের তথ্যও বলছে এমন কথা। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, বিগত এক বছরের ব্যবধানে বাজারে আটার দাম ৭৯ শতাংশ বেড়েছে। মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৮ শতাংশ। একইভাবে ময়দার দাম বছর ব্যবধানে ৬৪.৭৭ শতাংশ এবং মাসের ব্যবধানে ১৬ শতাংশ বেড়েছে।

চালের দাম বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রধান দুটি খাদ্যশস্যের দাম বাড়ায় দারুণ চাপে পড়েছে মানুষ। বাংলাদেশের বাজারে দুটি পণ্যের দামই দাঁড়িয়েছে ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগে মানুষ চালের দাম বাড়লে বিকল্প হিসেবে আটা-ময়দা বেছে নিতো। এবছর সে সুযোগও নেই। আটার দামও অত্যন্ত চড়া। এমনকি চালের দামকে ছাড়িয়ে গেছে আটা-ময়দার দাম।

অন্যদিকে টিসিবির তথ্য আরও বলছে, বাজারে সয়াবিন তেলের দাম এখন গত বছরের তুলনায় সাড়ে ২১ শতাংশ বেশি। আর চিনির দাম বেড়েছে সাড়ে ৪৫ শতাংশ। চিনির ক্ষেত্রে গত একমাসেই দাম বেড়েছে ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত বছর এক কেজি চিনির দাম ৮০ টাকার মধ্যে থাকলেও সেটি এখন ১১৫ টাকা।

বাজারের তথ্য আরও বলছে, বিগত এক বছরে মসুর ডালের দাম ২৬ শতাংশ, অ্যাংকর ডালের দাম ৪৭ শতাংশ, রসুনের দাম ৫০ শতাংশ, শুকনা মরিচের দাম ১১৫ শতাংশ, আদার দাম ১৩০ শতাংশ, গুঁড়ো দুধের দাম ৩৭ শতাংশ, লবণের দাম ১৫ শতাংশ, ফার্মের ডিমের দাম ২৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট থেকে শুরু করে ডলারের সংকট হয়েছে সেটা সত্য। তবে সেসব কারণ দেখিয়ে যে হারে পণ্যমূল্য বাড়ানো হয়েছে সেটা বেশি।’

তিনি বলেন, ‘বাজারের এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এখন হুট করেই তৈরি হয়নি। করোনা পরিস্থিতির পর থেকেই আস্তে আস্তে হচ্ছে, কিন্তু সেটা সরকার আমলে নেয়নি, যা এখন চরম আকার ধারণ করেছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।’

সাবেক কৃষি সচিব ড. আনোয়ার ফারুক বলেন, ‘আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। কিন্তু তেল, চিনি, ডাল ও আটা-ময়দার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য এমন গুরুত্বপূর্ণ যেসব পণ্য আমদানি হয়, সেগুলো যেন ব্যাহত না হয় সে ব্যবস্থা দরকার। প্রয়োজনে সরবরাহ ঠিক রাখতে যেখানে ডলার সংকট রয়েছে, তাদের সাধ্যমতো সাপোর্ট দিতে হবে। যেন তারা সুবিধামতো পণ্য আমদানি করতে পারে। তাহলে বাজারও স্থিতিশীল থাকবে।’

বাজার বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যসহ অনেক পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশের বাজারে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা, পরিবহন খরচ ও বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব রয়েছে বাজারে। পাশাপাশি একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সরবরাহ ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছেন। দুর্ভিক্ষের খবর পুঁজি করে তারা পণ্য মজুত ও অযাচিতভাবে দাম বাড়াচ্ছে।

বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে বিকল্প আমদানির উৎস খোঁজার চেষ্টা, খাদ্যে ভর্তুকি বাড়ানো ও দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর পরিসর বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *