ইংরেজদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অপকৌশল

ইংরেজদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অপকৌশল

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সাইয়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. : আরেকটি ঘটনা, হাফিজুল মুলক যখন সাহেবজাদা ইরাদাত খাঁর বিবাহে গিয়ে শাহজাহানপুর থেকে ফিরছিলেন; তো প্রথম মঞ্জিলে জনৈক সেনা অফিসারের তত্ত্বাবধানে চাকরিরত হিন্দু সৈনিক রসদবাহি গাড়ির কাছে এসে কুড়ি সের আটা এবং কুড়ি সের ঘি চাইলো। কর্মচারীরা তাকে জিজ্ঞেস করলো তোমার একার জন্যে না কি তোমার সঙ্গে আরো লোক আছে? তুমি কোন অফিসারের অধীন? সেই হিন্দু নিজের অফিসারের নাম বললো। এবং বললো আমার সঙ্গে আরো দশজন আছে, আর এই ঘি অফিসারের ঘোড়ার জন্যে নেওয়া হচ্ছে। ঘটনাক্রমে যেই অফিসারের নাম বলেছে তার কর্মচারি কিছু আগেই প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে গেছে। তাই দায়িত্বরত কর্মচারীদের মনে সন্দেহ জাগলো এবং তারা সঠিক বিষয় জানার জন্যে এক ব্যক্তিকে রেসালদারের নিকট পাঠালো। অনুসন্ধানে হিন্দু সৈনিকের মিথ্যা ও প্রতারণা ধরা পড়ে গেল। তাকে গ্রেফতার করে হফিজুলমুলকের দরবারে নিয়ে সমস্ত ঘটনা শোনানো হলো। হাফিজুল মুলক আদেশ করলেন, এই ব্যক্তিকে ২৫ সের আটা এবং ২৫ সের ঘি দিয়ে দাও। এও বললেন যে, এধরনের অনুসন্ধান বা ঘাঁটাঘাঁটি যাতে দরিদ্র মানুষের লজ্জার কারণ হয় এধরনের আচরণ থেকে ভবিষ্যতে বিরত থাকবে, ছোটখাট অপরাধ জায়গায় দাফন করে দিবে।

হাফিজুলমুলকের উদারতা, সচেতনতা, উন্নত ভাবনা এবং ন্যায় বিচারের ফল ছিল এই যে, হিন্দু প্রজারাও নিজেদের শ্রদ্ধাভাজন নবাবের বিশ্বাস রক্ষার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেয়। যে সময় সমস্ত মুসলমান, আত্মীয়, সুহৃদ, ঘনিষ্ঠজন এবং নেতৃস্থানীয় সকলেই হাফিজুল মুলক এর প্রাণ রক্ষার জন্যে অর্থ সংগ্রহে অস্বীকৃতি জানায় ঠিক সেই নাযুক সময় দেওয়ান পাহাড় সিং-এর ৪০ লক্ষ টাকা পেশ করা এবং যখন চরম সম্বলহীনতার ভেতর হাফিজুল মুলক প্রিয় মাতৃভূমি রক্ষার্থে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে জিহাদের ঝা-া উঁচু করেন সে সময় দলে দলে রাজপুতরা তার বাহিনীতে শরিক হওয়া এমন ঘটনা নয় পৃথিবী যা দ্রুত বিস্মৃত হতে পারবে। এসব এমন অসাধারণ অনন্য ইতিহাস, পৃথিবীর গ্রন্থসমূহে যা সর্বদা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

রণজিৎ সিং এর মন্ত্রী এবং বিশেষ নির্ভরযোগ্য সভাসদ ছিলেন পীরযাদা আযিযুদ্দীন। এবং রণজিৎ সিংহের তোপখানার ঊর্ধ্বতন অফিসার এলাহি বখশ। এলাহি বখশের নামেই তোপখানার নামকরণ হয়েছিল। শুধু এই নয় যে, দুনিয়াদার রাজা বাদশাহ ও নবাবদের পরস্পরের ওপর এই পরিমাণ আস্থা ও ভরসা ছিল বরং ধর্মীয় মনীষীদের মাঝেও সমান আস্থা ও নির্ভরতা বিদ্যমান ছিল। শিখদের সঙ্গে যুদ্ধে হযরত সাইয়্যিদ আহমাদ শহীদ বেরেলভী রহ. নিজেদের তোপখানার ইনচার্জ বানিয়েছিলেন রাজা রাম রাজপুত নামে একজন হিন্দু সৈন্যকে। যিনি ইতমান যাইর যুদ্ধে শিখদের ওপর শক্ত গোলাবর্ষণ করে পরাস্ত করেছিলেন। [উলামায়ে হিন্দ কা শান্দার মাজি পৃ. ৫]

সার কথাÑঅতীত ইতিহাসের পুরো সময়জুড়ে হিন্দু মুসলমান উভয়ের মাঝে অত্যন্ত আস্থা ও ভরসা, হৃদ্যতা ও সহমর্মিতার সম্পর্ক ছিল। ভারতবর্ষে নানান ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষ পরস্পরে মিলে মিশে প্রিয়জন, সুহৃদ ও আত্মীয়ের মতো পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে সহাবস্থান করতো।

১৮৫৭ ইং সাল পর্যন্ত সাধারণের মাঝে ধর্মীয় বা জাতিগত কোন বিবাদের অস্তিত্ব ছিল না। সিপাইদের মাঝে যখন বিদ্রোহ দেখা দিল এবং সংগ্রাম শুরু হলো তখন সব অঞ্চলের সিপাইরা ছাউনিতে আগুন লাগিয়ে যার যার সেনা ছাউনি ধ্বংস করে দিল্লির বরখাস্ত হওয়া অকেজো বাদশাহ মরহুম বাহাদুর শাহের কাছে ছুটে আসে। বিহার থেকেও সিপাহি এসেছিল। এসব সৈন্যের মাঝে সকল ধর্ম মতের ভারতবাসী ছিল। হিন্দু সিপাহিও ‘বাহাদুরশাহের জয়’ বলে সেøাগান দিত। যদি বর্তমান সমেয়র সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি সে সময় থাকতো তাহলে মুসলমান সিপাহিরা মুসলমান বাদশাহ বা নবাবের কাছে যেত আর হিন্দু সিপাহি যেত কোন হিন্দু রাজার কাছে। অথচ কি আশ্চর্য! সব ধর্ম বর্ণের মানুষ ছুটে গেল প্রাণহীন শক্তিহীন একজন হতভাগা মুসলিম বাদশার কাছে!

১. মহারাজা বধোর ওরফে নানা সাহেব
মহারাজা বধোর ওরফে নানা সাহেব মারাঠী কানপুরি [তাঁর প্রকৃত নাম ধুন্ধুপন্থ]যখন কানপুর দখল করলেন তখন বাহাদুর শাহ’র সবুজ ঝা-া উড়িয়ে বাদশার নামে একশত তোপের সম্মাননা দিলেন।

২. আজিমুল্লাহ খান
নানা সাহেবের পেশকার ছিলেন আজিমুল্লাহ খান। তার সম্পর্কে প্রসিদ্ধি আছে যে, ১৮৫৭ ইং সালের বিপ্লবের পরিকল্পনা তাঁরই চিন্তার ফসল। বড় যোগ্য প্রতিভাবান এবং ইংরেজি ভাষায় সুপ-িত ছিলেন, নানা সাহেবের পক্ষ থেকে তার মোকাদ্দামা লড়ার জন্যে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন।

৩. তাঁতিয়া তোপী মারাঠা
তাতিয়া তোপী মারাঠা কলিপির স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন এবং কানপুরে নানা সাহেবের সেনাপতির দায়িত্বে থাকেন।

৪. ঝাঁসির রানি
মারাঠা শাসনাধীন বারাণসীর ঝাঁসী ভারতের উত্তরাংশে অবস্থিত। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় এখানের রাণী ছিলেন লক্ষ্মী বাঈ। ১৮৩৫ সালে তাঁর জন্ম। ১৮৫৮ সালে গোয়ালিয়রে বৃটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ২২ বছর। ইতিহাসে তিনি ঝাঁসী কী রাণী নামে পরিচিত। তাঁকে ভারতীয রমণীদের সাহসের প্রতীক ও প্রতিকল্প হিসেবে চিত্রিত করা হয়। সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম নারী দলের নামকরণ করেন রাণী লক্ষ¥ী বাঈকে স্মরণপূর্বক। এখনও ভারতের জাতীয় বীরাঙ্গনা হিসেবে তিনি খ্যাতঝাঁসির রানি কোম্পানীর ফৌজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দিল্লির বাদশাহর পতাকা উড়িয়ে দেন। এবং নিজে ঘোড়ায় চড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

৫. রাজা কুনওয়ার সিং
বিহার প্রদেশের জগদিশপুরের রাজা কুনোর সিং আশি বছর বয়সে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং ইংরেজদের ধারাবাহিক পরাস্ত করতে থাকেন। যার ফলে ভাইসরয় লর্ড কেনিং ঘাবড়ে যান। যখন বেনারসে লর্ড মার্কের ফৌজের সঙ্গে মুকাবেলা হয় তখন রাজা সাহেব বিদ্যুতের মতো এদিক থেকে ওদিকে ছুটতে থাকেন। বালিয়ার সন্নিকটে গঙ্গা পার হতে গিয়ে তার ডান হাত গুলিবিদ্ধ হয়। বাম হাতের তরবারি দিয়ে তিনি ডান হাত কেটে পট্টি বেঁধে দেন। যাতে বিষ না ছড়ায়। আট মাস যুদ্ধের পর এই বয়োবৃদ্ধ রাজা নিজের রাজধানির নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে সক্ষম হন, কিন্তু যখম বরদাশত করতে না পেরে মৃত্যু বরণ করেন।

৬. নবাব খান বাহাদুর খান
রোহিলাখ-ের শেষ উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি তার ঘোষণায় একথার ওপর বিশেষ জোর দেন যে, ‘ইংরেজরা সব সময় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এসেছে এবং জমি হরণ করে এসেছে। এবং হিন্দু মুসলমানের মাঝে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে চলেছে। কাজেই এখন হিন্দু মুসলমান উভয়ে মিলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত।’ রোহিলাখ-ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিনি খুব লড়াই করেন। তেমনিভাবে ওয়াজেদ আলী খানের স্ত্রী বেগম হযরত মহল, নবাব নজিব খানের সেনাপতি বখত খান এবং মাওলানা আহমাদুল্লাহ শাহ প্রমুখ স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।

এসব ঘটনায় খুব স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যেসব জুলুম অত্যাচার অন্যায় অবিচারের দোষ মুসলিম শাসকদের ওপর চাপানো হয় তা সর্বাংশে মিথ্যা এবং ভুল। বরং বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। যেমনটি আমরা পেছনে দেখিয়েছি, তা নাহলে বাদশার প্রতি জনতার এই ভালবাসা তা-ও এমন সময়ে যখন তাঁর রাজত্ব সমাপ্তির পথে। এমন মুহূর্তে এ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনো কারণ খোঁজে পাওয়া যাবে না। তেমনিভাবে নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোসের মত উচ্চশিক্ষিত অমুসলিম নেতার বাহাদুর শাহর কবরে গিয়ে অশ্রু বর্ষণ এবং ভক্তি প্রকাশ এসব বানানো গল্পসমূহের ভুল, প্রলাপ ও মিথ্যা হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। [দেখুন: রওশন মুস্তাকবেল পৃ. ৭৭, ৭৮, ৭৯, ৮০, ৮১॥]

ইংরেজদের নীতি
{এতো গেল অন্যান্য জাতির সঙ্গে মুসলমান বাদশাদের কর্মপন্থার আলোচনা। এখন একটু ইংরেজ শাসনামলের দিকেও দেখুন। সমাজের সর্বত্র সম্প্রীতি রক্ষার চেষ্টা-তদবীর তো দূরের কথা কিভাবে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লাগিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যায় তার জন্য বৃটিশ রাজনীতিক ও প-িতদের সমস্ত প্রতিভা ব্যয় হয় সুনিপুণ কর্মকুশলতায়।}
ইংরেজদের বিভক্ত করে শাসন করা নীতি যদিও শুরু থেকেই ছিল কিন্তু ১৮৫৭ ইং সালে যখন হিন্দু মুসলমান সাধারণ মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে সমান হারে শরিক হলো তখন ইংরেজদের মনে এ দুই জাতির ঐক্যের বিষয়টি প্রকট সমস্যার রূপ নিয়ে ধরা দিল। এ জন্যে তারা তখন থেকে আরো বেশি ভাবতে লাগলো কিভাবে এ দুই ধর্মের মানুষের মাঝে স্থায়ী কোন বিভেদের রেখা টেনে দেওয়া যায়। যাতে এরা আর কখনও পরস্পরে মিলতে না পারে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ইলিয়ট ও কমিশন সাহেবরা এসব জালিয়াতিপূর্ণ মিথ্যা ইতিহাস প্রপাগা-া করতেই রচনা সম্পন্ন করেন। তাতে হিন্দুদের ওপর মুসলমান বাদশাহদের জুলুম অত্যাচার দেখানো হয়।

তারপর এ গ্রন্থসমূহের অনুবাদ স্কুল কলেজ ও ইউনিভার্সিটির পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করে তরুণ নবীন ছাত্রদের পড়ানো হয়। এছাড়া হিন্দু মুসলিম পৃথক নির্বাচন এবং মুসলিম লীগ ও হিন্দু মহাসভার ভিত্তি রাখা হয়। গরু কুরবানি এবং মসজিদের সামনে বাদ্য বাজানোর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদিও এ বিভেদ নীতি বাস্তবায়নের শক্তিশালী মাধ্যম।

অফিসে চাকরিতে দুই জাতির মাঝে এমন পদ্ধতিতে নিয়োগ দেওয়া হতো যেন এ বিভেদের ভিত্তি মজবুত হয়ে যায় এবং চির সম্প্রীতিপূর্ণ দুটি জাতি একে অপরেরর চরম শত্রু হয়ে যায়। এ ধরনের ইতিহাস পাঠশালাসমূহে পড়িয়ে এবং অন্যান্য উপায় অবলম্বন করে হিন্দু মুসলমান বিভেদের প্রয়াসকে সুদৃঢ় করা হয়েছে।

ডিভাইড এন্ড রুল নীতি সম্পর্কে আরও সাক্ষ্য
এ বিষয়ে আরো কিছু সাক্ষ্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। যথা, ক. লর্ড ইনফস্টেন বোম্বের গভর্নর ১৪ মে ১৮৫৯ ইং সালে এক স্মৃতিচারণে লিখেন,
‘বিভক্ত করে শাসন করার নীতি ছিল রোমানদের। এ নীতিটি আমাদেরও গ্রহণ করা উচিত।
হুকুমতে খোদ ইখতিয়ারী পৃ. ৫৫

টহযধঢ়ঢ়ু ওহফরধ থেকে গৃহীত
খ. এরপূর্বে কার্ণে টেক্স এশিয়াটিক জার্নালে ১৮২১ ইং সালে লিখেছিলেন, ‘ডিভাইড এন্ড রুল, রোমান উক্তি আমাদের ভারতীয় সা¤্রাজ্য পরিচালনার মূলনীতি হওয়া উচিত। চাই তাতে সভ্যতা ধ্বংস হোক। রাজনীতি, কৃষ্টি ও সৈন্য পরিচালনা সকল ক্ষেত্রেই আমাদের এমন নীতি থাকা উচিত।’
হুকুমতে খোদ ইখতিয়ারী পৃ. ৫২
গ. মিস্টার এডওয়ার্ড টামসন তার ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের চিত্রের অপর পিঠ গ্রন্থে লিখেন, বৃটেনের রাজনীতিতে তো আমরা মি. গ্লাডিস্টন [মৃ.১৮৯৮] এবং লর্ড সালিসবেরির মতো প্রসিদ্ধ চিন্তাবিদদের চিন্তাধারা ত্যাগ করেছি। কেননা সময়ের প্রয়োজন এর বিপরীত নির্দেশনা দেয়। কিন্তু ভারতবর্ষে আমরা সেই পুরানো পলিসির অনুসরণ করে চলেছি। এমনকি ভারতীয়দের মাঝে অনৈক্য ও পারস্পরিক বিবাদ জিইয়ে রাখা বহু আগ থেকেই আমাদের রাজনীতিবিদদের আকর্ষণীয় কর্মব্যস্ততা হয়ে আছে। তবে ভারতের মানুষ ঐক্য সম্প্রীতির প্রয়োজন খুব দ্রুততার সঙ্গে অনুভব করছে।

ঘ. মেজর জেনারেল স্মিথের বিস্ময়কর সাক্ষাৎকার দেখুন। প্রস্পারাস ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় স্যার উইলিয়াম ডিগবি প্রশ্নোত্তর আকারে ১০৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন।
প্রশ্ন: আপনি কি একথা অস্বীকার করতে পারেন যে, স্বদেশীদের নিজেদের শক্তি সম্পর্কে ধারণা হবে না?

উত্তর: আমার খেয়ালে মানুষের ইতিহাসে কোন একটি দৃষ্টান্তও পাওয়া যাবে না যে, গুটি কতেক বিদেশী কোটি কোটি মানুষের দেশের রাজত্ব করতে পারে। এ জন্যে যখনই এ জাতি শিক্ষিত হয়ে উঠবে তখন এ শিক্ষার প্রভাবে তাদের মাঝের ধর্ম ও বর্ণগত বিভেদ দূর হয়ে যাবে। তাদের বিভক্তির ফলেই মূলত আমরা এত দিন পর্যন্ত এ দেশটি দখল করে রাখতে পেরেছি। তাছাড়া শিক্ষার ফলে তাদের মন বড় হয়ে যাবে এবং তাদের নিজেদের শক্তি সম্পর্কে ধারণা তৈরী হবে।

ঙ. মি. চার্চিল ২৭ জুন ১৯৩২ ইং তারিখে বক্তৃতায় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী (মি.ম্যাকডোনাল্ড [১৮৬৬-১৯৩৭]) সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তিনি সম্প্রদায় ভিত্তিক ফয়সালা দিবেন। আমার মতে এতে বড় শঙ্কা রয়েছে। যদি তিনি সব দলকে সন্তুষ্ট করতে চান কাউকেই খুশি করতে পারবেন না। রোমানদের নীতি ছিল ‘বিভক্ত করে শাসন করো’, কিন্তু আমরা সর্বসম্মত হয়েছি এ ব্যাপারে যে, এ নীতি মোটেও ঠিক নয়। তাই বলে এর সাথে এমন নীতিও গ্রহণ করা উচিত হবে না যা এর সম্পূর্ণ বিপরীত হবে। এভাবে যে, সব মানুষকে একতাবদ্ধ করে দেওয়া। কারণ ঐক্যের ফলে আমাদের সাম্রাজ্য হারানো ছাড়া পথ থাকবে না। মূলত এটি একটি বড় শঙ্কার বিষয়। আমরা যেন কোন সঙ্কটে না পড়ি সেদিকে আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।’
দৈনিক লিডার ১৪ জুলাই ১৯৩২ ইং

চ. স্যার জন মিনার্ড : ‘হিন্দু মুসলমানের মাঝে বিরোধের সূচনা হয় বৃটিশ শাসনামলে।’
দৈনিক লিডার ১৪ জুলাই ১৯৩২ ইং

ছ. অনরবেল অম্বিকা চরণ মজুমদার বলেন, ‘শুরু শুরুতে মুসলমানদের মোকাবিলায় হিন্দুদের অগ্রসর করা হয়েছে তারপর হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদের ওপরে উঠানো হয়েছে। এই নিয়োগের অসমতা ও পক্ষপাতিত্ব তাদের পারস্পরিক শত্রুতা ও রেষারেষির কারণ হয়েছে।
হিন্দুস্তান কা কাওমি ইরাতিকা পৃ. ২৪৮ রওশন মুস্তাকবেল পৃ. ১৫৫

এ প্রক্রিয়ায় অফিসে এবং রাষ্ট্রিয় পদে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিভক্তি ছড়ানো হয়েছে। খোলাসা এই যে, ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু ও অন্যান্য জাতি সবসময় মিলে মিশে আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয় মানুষের মতো একত্রে বসবাস করতো এবং পরস্পরে সহিষ্ণুতা বরং একতা ও সৌহার্দ্যরে সঙ্গে চলে আসছিল। ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে এ সম্প্রীতিকে শঙ্কাজনক বুঝতে পেরে বিভিন্ন উপায়ে বিভক্ত করে এবং পরস্পরের মাঝে ভেদবুদ্ধি সৃষ্টি করে। কখনও এক দলের ওপর অনুগ্রহ করে তো কখনও আরেক দলের ওপর অনুগ্রহ করে।

এভাবে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি করে হিংসা বিদ্বেষ ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির মাধ্যমে দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধানোর পরিস্থিতি প্রস্তুত করে। যদিও মি. চার্চিল বলছেন যে, আমরা এ বিভক্ত করার নীতিকে বেঠিক মনে করি কিন্তু এ্যাডওয়ার্ড টামসান তার বইয়ে স্বীকার করেন যে, ভারতীয়দের মাঝে অনৈক্য ও বিভেদ জিইয়ে রাখা বহু আগ থেকেই আমাদের রাজনীতিকদের খুবই প্রিয় কাজ হয়ে থেকেছে। বাস্তবে এটাই সঠিক। খোদ চার্চিলও ভারতীয়দের ঐক্য চরমভাবে অপছন্দ করতেন এবং ভারতীয়দের ধর্মীয় সম্প্রীতিকে বৃটিশ রাজ্যের জন্য অশনি সংকেত মনে করতেন। প্রতিদিনের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে, বৃটিশ শাসক শ্রেণী এখনও ভারতে একই খেলা খেলে যাচ্ছে। আর যদিও পূর্বে বপন করা বিষাক্ত বীজ বহু বছরের জন্যে বরং শত বৎসর বা তার চেয়ে বেশি সময়কালের জন্যে যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এখনও বৃটিশরা এ কাজে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ জারি রেখেছেন।
জ. মি. আর এস রনিকার অফ সিপি নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি ১৯ নভেম্বর ১৯৪৬ ইং সালে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং বৃটেন ঘোরার সময় আমার বড় বড় নেতৃবৃন্দ, আইনজ্ঞ, সাংবাদিক এবং ব্যবসায়িকদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে।

যখন আমি লন্ডনে ছিলাম তখন আমি এ গুজব শুনেছি যে, কিছু কনজারভেটিভ মানুষ ভারতের দাঙ্গায় অস্বাভাবিক উৎসাহিত বোধ করছে। আমি এ কথাও শুনেছি যে, তারা ভারতে দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠিকে অর্থ সহযোগিতাও করছে। আজ কাল সেখানে এ গুজবও রটছে যে, কনজারভেটিভ পার্টির একজন দূত দাঙ্গা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে রওয়ানা হয়ে গেছেন।

প্রতাপ, লাহোর ২১ নভেম্বর ১৯৪৬ ইং
ঝ. মি. লুই ফিশার (প্রখ্যাত আমেরিকান রাইটার) লন্ডন থেকে তাঁর বার্তায় একটি আর্টিকাল ভারতে পাঠান। যা ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ ইং তারিখে স্ট্যান্ডার্ড কলকাতায় প্রকাশ পায়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চার্চিল এবং জিন্নাহর মাঝে বেশ কয় মাস যাবৎ ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ধারণ বিষয়ে পত্র আদান প্রদান হয়েছে তাতে অনেক গোপন রহস্যালাপ রয়েছে। এ ঘটনা চার্চিলের এমন একটি গোপন পত্র ফাঁস হবার পর প্রকাশ পায় যে, মুসলিম লীগ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দলের প্রস্তাবনাসমূহে পুনর্বার চিন্তা ভাবনা করেছে এবং আইন প্রণয়নকারী এসেম্বলি ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যেই এসেম্বলি স্বাধীন ভারতের আইন প্রণয়ন করবে।

বৃটিশ ক্যাবিনেট মিশন অত্যন্ত চেষ্টা করে যাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃটিশদের হাত থেকে ভারতীয়দের হাতে হস্তান্তরের পথ পরিষ্কার করে দেওয়া হয় কিন্তু জিন্নাহ ও চার্চিল এসব চেষ্টাকে ব্যর্থ বানানোর প্রয়াস চালিয়ে গেলেন। মিস্টার জিন্নাহর হীন পলিসির ফল কলকাতায় লুটপাট, মৃত্যু, হত্যা, লুণ্ঠন এবং চরম ধ্বংসযজ্ঞের রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। {অবশেষে বহু রক্তগঙ্গা বইয়ে ভারতবর্ষকে বিভক্ত করা হয়।}

ভাষান্তর : ফয়জুল্লাহ আমান

 

মাসিক পাথেয়, ফেব্রুয়ারি ২০১৮

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *