সাইয়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. ●
ভারতবর্ষের অধিবাসীদের মাঝে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি
সব সমঝদার বরং নির্বোধ মানুষের কাছেও স্বীকৃত একটি নীতি এই যে, একতা, সহিষ্ণুতাÑ পারস্পরিক সৌহার্দ্যই সার্বজনীন মানুষের কল্যাণ, সফলতা এবং পার্থিব-ধর্মীয় উন্নতি-প্রশান্তির অন্যতম উপায়।
মানুষ বুদ্ধিমান ও সভ্য প্রাণী। সুতরাং একথা বুঝতে পারা মানুষের পক্ষে বিস্ময়কর কিছু নয়; কিন্তু এ বিষয়টি তো বুনো জানোয়ার এমনকি হিং¯্র প্রাণীদের মাঝেও পাওয়া যায়। জানোয়াররাও একতা ও সৌভ্রাতৃত্বের সঙ্গে বসবাস করে এবং এ বিষয়ের প্রতি যতœবান থাকে।
একথা সব সমঝদার মানুষই স্বীকার করবেন যে, লড়াই-ঝগড়া, সমাজে পারস্পরিক শত্রুতা, বিদ্বেষপরায়ণতা, বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা সমাজ ধ্বংসের শক্তিশালী মাধ্যম। এসবের অনুমতি কোনভাবেই দেওয়া যায় না। কিন্তু স্বার্থপরতা এবং অন্তর্গত দুশ্চরিত্র এমন মন্দ একটি বিষয় যা বিভিন্ন মানুষ ও জাতিকে এধরনের অভিশপ্ত কূটনৈতিক পদ্ধতি গ্রহণে বাধ্য করে। এসব নরাধমদের জঙলিপনার কারণে বহু জাতি ধ্বংসের বেদিতে বলিদানের শিকার হয়ে যায়।
ইউরোপীয়রা বিশেষত বৃটিশরা এশিয়া ও আফ্রিকার জাতিসমূহের সঙ্গে এমন পলিসি জরুরি মনে করলো, যেই অভিশপ্ত পলিসির দ্বারা পুরো দেশ দখল করা সহজ হয়ে যায়। তারপর দেশটাকে ওলটপালট করে নিজেদের লৌহ পাঞ্জার ভেতরে দাবিয়ে চুষতে থাকা হচ্ছে ইংল্যান্ডের অতিপ্রিয় কর্মকৌশল। বৃটিশরা ভারতের জাতিসমূহের মাঝে পারস্পরিক শত্রুতা, জাতিগত বিদ্বেষ ও দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধানোর জন্য নিত্য নতুন পলিসি আবিষ্কার করাকে তাদের পরম উদ্দেশ্য বানিয়ে নিল। যখন কোন রাষ্ট্রের কর্ণধারদের উদ্দেশ্য এমন ধ্বংসাত্মক হয় তখন সে দেশ ধ্বংসের ব্যাপারে আর কি সংশয় থাকতে পারে। কিন্তু হিং¯্র জন্তুদের তাতে পরোয়া কীসের? তাদের তো চাই কেবল রক্ত চোষা। রক্ত চুষতে গিয়ে শিকার মরে কি বাঁচে তা দেখার আর সময় কোথায়? বৃটেনের ২০০ বছরের লজ্জাজনক পলিসি ভারতবর্ষকে কঠিন ধ্বংসের গহ্বরে ফেলে দিয়েছে এবং এমন পুঁতিগন্ধ কাজ ও নষ্ট চরিত্রে আক্রান্ত করেছে যে, শত বৎসরেও তা থেকে পরিত্রাণ সম্ভবপর মনে হয় না।
আমরা খুব সংক্ষেপে এ চরম উত্তেজক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী পলিসির চিত্র অঙ্কন করছি। যার দ্বারা সহমর্মিতা, মানবিকতা এবং মানবসেবার মত বৃটিশদের বড় বড় দাবির আসল চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এবং বাস্তবতা থেকে পর্দা সরে যাবে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা : স্যার জন ম্যালকম বলেন, এ বিশাল দেশে আমাদের অস্বাভাবিক শাসন ক্ষমতার সুরক্ষার পথ একটিই। আর তা হলো এই যে, আমাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত যেসব প্রধান ধর্মের অনুসারী আছে তাদের বিভক্ত করতে হবে। তারপর প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের বিভিন্ন জাত, সম্প্রদায় ও ছোট ছোট দলে ভাগ করে ফেলতে হবে। যতদিন এ জনসমষ্টি বিভক্ত থাকবে ততদিন তাদের ভেতর এমন কোনো বিদ্রোহের আশঙ্কা নাই যার ফলে আমাদের সাম্রাজ্য ধ্বংস হতে পারে বা কোনো ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়ার এই হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থের লক্ষ্যেই ধুরন্ধর ধূর্ত ইংরেজ রাইটারদের কালো কলমে এমনতর ইতিহাস রচিত হলো যেই ইতিহাসে হিন্দুদের ওপর মুসলিম শাসকদের অত্যাচারের ভয়ানক কাল্পনিক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এসব ইতিহাস গ্রন্থের ভেতর প্রসিদ্ধ হচ্ছে স্যার হেনরি ইলিয়টের [১৮০৮-১৮৫৩] ইতিহাস গ্রন্থ। ইলিয়টের কাছে এটা খুব অসহ্য ছিল যে, লেখাপড়া জানা শিক্ষিত কোনো হিন্দু কেন অতীত মুসলিম আমলের প্রশংসা করবে, আর আধুনিক ইংরেজ আমলের ত্রুটি অন্বেষণ করবে?
সে যুগে ইতিহাসের যত গ্রন্থ ছিল এমনকি খোদ হিন্দু লেখকদের ইতিহাস গ্রন্থেও মুসলমানদের উদারতা, সহিষ্ণুতা ও মাহাত্ম্যের কথা উল্লেখ থাকত। ইংরেজরা এটা একদম সহ্য করতে পারত না। এজন্যে এই হেনরি ইলিয়ট ভারতবর্ষের একটি ইতিহাস লিখে তার প্রথম খ- ১৮৪৯ ইং সালে প্রকাশ করেন। এটিই সর্বপ্রথম ইতিহাসগ্রন্থ যার মাঝে প্রাচীন ভারত বিশেষত মুসলিম আমলের ব্যাপারে খুব বিষোদগার করা হয়েছে। ইতিহাসের এ বিকৃত পাঠ দেশী ভাষায় ভাষান্তরিত করে স্কুলের অবুঝ বাচ্চাদের মাঝে বিতরণ করা হয়। সাধারণ হিন্দুদের মনে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতার বীজ বপনে এ বইটিকে হাতিয়ার বানানো হয়। কারো যদি এ লেখকের ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্যটা জানার ইচ্ছা হয় তাহলে কেবল বইটির ভূমিকা পড়া-ই যথেষ্ট হবে। ভূমিকায় লেখক তাঁর উদ্দেশ্য স্পষ্ট ভাষায় লিখে দিয়েছেন। লেখক লিখেছেন, হিন্দু লেখকদের কথা ভাবলে বড় আক্ষেপ হয়। আমাদের আশা ছিল, হিন্দু লেখকরা তাদের লেখায় নিজেদের আবেগ অনুভূতি এবং বিশ্বাস অনুসারে শব্দ চয়ন করবে; কিন্তু তারা সম্পূর্ণ অন্য রকম আচরণ করে এসেছে। মুহররম মাসকে হিন্দু লেখকরাও মুহররম শরিফ লিখে, কুরআনকে কালাম পাক বলে আরও বিস্ময়ের ব্যাপার তাদের রচনা তারা বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করে!
ইলিয়ট সাহেব হিন্দু লেখকদের এ বিষয়টি নিয়ে ক্রোধান্বিত হন, হিন্দুরা কেন মুসলমানদের ধর্ম ও রীতিনীতির এতটা সম্মান প্রদর্শন করবে। এক বয়োবৃদ্ধ হিন্দু লেখক বলে ফেলেছেন, তিনি তাঁর আরতির কাছে আছেন, তিনি কবরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। তো ইলিয়ট সাহেব তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে বলেন, ঐ হিন্দুর জানা আছে, তার লাশ জ্বালিয়ে ছাই গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হবে, তারপরও সে ‘কবরের কিনারায় দাঁড়ানো’ কেন লিখবে? অথচ ঐ লেখক কথাটি ভাবপ্রকাশে বৈচিত্র্য আনতেই বলেছেন; অন্য কিছু নয়।
ইলিয়ট সাহেবের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি এ বিষয়ে যে, এখন যখন হিন্দুরা মুসলমানদের থাবা থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হয়ে গেছে। এখন তো তারা কোনো বাঁধা ছাড়াই তাদের মনের কথা প্রকাশ করতে পারে; অথচ এখনও দাসত্বের মানসিকতা সম্পন্ন লেখকদের একজনও নিজের দেশের মানুষের আবেগকে মূল্যায়ন করে লেখে না। দীর্ঘ দিনের নিপীড়নে তাদের ভেতর যেমন বিরক্তি বা কষ্ট সঞ্চিত হবার কথা তা কিছুই প্রকাশ করে না।
কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, মুসলমানদের আমলে যদি তাদের সত্যিই কোনো কষ্ট হতো তাহলে মুসলিম শাসকদের পতনকালে অবশ্যই তা তাদের জবানে প্রকাশ করতো। ইলিয়ট সাহেবের এ কারণেই খুব দুঃখ, হিন্দুরা মুসলিম আমলের প্রশংসা কেন করে! ইংরেজদের দোষত্রুটি কেন বের করে!!
ইংরেজরা চেষ্টা করলো যাতে করে ইতিহাসের পুরাতন স্তূপ থেকে এমন সব ঘটনা বের করা যায় যা থেকে এ সিদ্ধান্ত টানা সম্ভবপর হয়ে ওঠে যে, মুসলমানদের শাসনামল ছিল জুলুমে ভরা আর ইংরেজদের দুঃশাসন সেই তুলনায় খোদার রহমত। এ উদ্দেশ্যকেই ইলিয়ট তাঁর নিম্নের ভাষ্যে স্পষ্ট করেছেনÑ যদিও পুরনো ইতিহাসের মূল্য নিতান্ত কম। তা সত্ত্বেও গভীর অধ্যয়নে তাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া সম্ভব। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অজ্ঞতার তিমির দূর করা যায়। যে অজ্ঞতার তিমির ভারতবর্ষের অতীত সম্পর্কে ধারণাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এ কথা সাব্যস্ত করা যায় যে, মুসলিম শাসনামল সম্বন্ধে ইতিহাসের অনেক কিছু এখনও লিখা বাকি আছে। এসব তথ্যের দ্বারা জনসাধারণকে আমাদের ইংরেজ আমলের অসীম ফায়দা ও অভূতপূর্ব ন্যায়বিচার সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যেতে পারে।
ইলিয়ট সাহেবের কাছে হিন্দুদের মুখে মুসলমানদের প্রশংসা বড়ই বিরক্তিকর ছিল। কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, মুসলিম আমলের প্রশংসায় হিন্দুদের সেসব কথা বাস্তবতার ভিত্তিতে ছিল। হিন্দু লেখকরা ইংরেজ শাসনের সমালোচনায় যেসব কথা বলতেন সেসবও বাস্তবতার আলোকেই বলতেন। নি¤েœ উপর্যুক্ত বক্তব্যের পক্ষে কিছু সাক্ষ্য উল্লেখ করা হলোÑ
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক যিনি শুরুতে মাদ্রাজের গভর্নর এবং পরে ভারতের ভাইসরয় হয়েছিলেন। আর এ বিষয়ে তাঁর সাক্ষ্যের চেয়ে ওজনদার কথা আর কারো হতে পারে না। তিনি ১৮২৮ ইং সালে কোম্পানীর সামনে বিবৃতি দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বহু বিষয়ে মুসলিম শাসনব্যবস্থা ইংরেজ রাজত্বের তুলনায় বহুগুণে ভাল ছিল। মুসলমানরা শাসনক্ষমতা লাভের পর এ দেশেই বসবাস শুরু করে দেয়। তারা এদেশের অধিবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ভারতীয়দের মাঝেই তারা বিয়ে শাদি সম্বন্ধ করতে থাকে। মুসলমানরা ভারতীয় জাতিসমূহকে সবধরনের অধিকার দেয়। বিজেতা ও বিজিতের রুচি, চাহিদা, পছন্দ-অপছন্দ এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্যে একতা ছিল। কোনো ধরনের পার্থক্য ছিল না। এর বিপরীতে ইংরেজদের পলিসি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। আমাদের আমলে অমানবিকতা, স্বার্থপরতা এবং বেপরোয়া ভাবপ্রকট। একেতো সরকারের লৌহ পাঞ্জার কঠোর শাসন। তারপর আবার এ রাষ্ট্র শাসনে স্বদেশীদের কোনোই দখল নেই।
আলআনসার, দেওবন্দ নং ২২ পৃ. ২
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৯৩৮ সালে বাঙালি মুসলিম ফেডারেশনের সভায় সভাপতির ভাষণে বলেন, সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে বাঙালি হিন্দুদের মনসবদারী এবং বড় বড় জায়গির দেওয়া হতো। বড় বড় জমিদার বানানো হতো। সম্রাট আলমগীর যার নামে বহু বদনাম রটানো হয় হিন্দুদেরকে গবর্নরও বানিয়েছেন। এমনকি বাদশা আলমগীর নিরেট মুসলিম প্রদেশ আফগানিস্তানেও যেই নায়েবুসসালতানাত নির্ধারণ করেন সে একজন হিন্দু রাজপুতই ছিল। [প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বক্তব্য সমগ্র থেকে সংগৃহীত]
প-িত সুন্দর লাল সাহেব ইলাহাবাদি [১৮৫৭-১৯১৮] ভাঢ়রতের ইংরেজ শাসন গ্রন্থে লিখেন সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গির, তারপর আওরঙ্গজেব এবং তাঁর পরবর্তী সম্রাটদের সময়েও হিন্দু মুসলিম সব জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের যাবতীয় বিষয়ে সমান মর্যাদায় ছিল। উভয় ধর্মের অনুসারীদের সমান সম্মান করা হতো। শুধু ধর্মের জন্যে কারো পক্ষপাতিত্ব করা হতো না। প্রত্যেক সম্রাটের পক্ষ থেকেই অসংখ্য হিন্দু মন্দিরের জন্য জায়গির দেওয়া হতো। আজ পর্যন্ত বহু হিন্দু মন্দিরের পূজারিদের কাছে আওরঙ্গজেবের স্বাক্ষরসহ ফরমান মজুদ রয়েছে। যেসব ফরমানে জায়গির দেওয়ার বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে এ ধরনের দুটি প্রজ্ঞাপনপত্র এখনো পর্যন্ত ইলাহাবাদে রয়েছে। দুটির একটি এরিয়াল অঞ্চলে সোমেশ্বরনাথের প্রসিদ্ধ মন্দিরের পূজারিদের কাছে। তেমনিভাবে বাদশাহ আলমগীর গুরুধর জগজীবন বেনারস জেলার ‘বসি’ অঞ্চলের এবং জদুমিশ্র মহেশপুর পরগনার এবং প-িত বলহদর মিশ্রকে জায়গির দিয়েছিলেন। [রওশন মুস্তাকবেল পৃ. ২১]
বাদশা জাহাঙ্গির লিখেন রাজা বিক্রমাদিত্য যিনি ভারতবর্ষের একজন বড় রাজা। যিনি ভারতে মানমন্দির বানিয়েছেন। তাকে খেতাব দিয়ে আমার তোপখানার প্রধান অফিসার বানিয়েছি। এবং তাকে আদেশ দিয়েছি যেন তোপখানায় সবসময় ৫০ হাজার তোপচালক এবং তিন হাজার উৎকৃষ্ট তোপ তৈরী থাকে। এ বিক্রমাদিত্য ক্ষত্রিয়। আমার মহান পিতার সময়ে হাতিশালার প্রধান এবং পূর্বাঞ্চলের দেওয়ানি এবং আমিরের স্তরে পৌঁছেছিল। সৈনিকগিরি এবং যুদ্ধের কলাকৌশল খুব ভালো জানে। [তুযুক জাহাঙ্গিরি]
আলমগীরের সময় হিন্দু আমির উমারাদের বিবরণ নি¤েœ প্রদত্ত হলো; ৭ হাজারি ২ জন, ৬ হাজারি ২ জন, ৫ হাজারি ২৫ জন, ৪ হাজারি ৫ জন, সাড়ে ৩ হাজারি ৪ জন, ৩ হাজারি ১৩ জন, আড়াই হাজারি ৫ জন, ২ হাজারি ১৬ জন, দেড় হাজারি ২৭ জন, ১ হাজারি ১৫ জন।
মিস্টার জহিরুদ্দিন ব্যারিস্টার তাযকিরাতুল উমারা গ্রন্থ থেকে উক্ত বিবরণ উল্লেখের পর বলেন, এ বিবরণ এবং অন্যান্য বাস্তব ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, বাদশাহ আলমগীর হিন্দুদেরকে তাদের যোগ্যতা ও প্রতিভা অনুসারে সব সময় সামনে অগ্রসর করেছেন। হিন্দুদেরকে সরকারি চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এই যে, ধর্মকে পার্থিব বিষয়ের মাঝে টেনে আনা অর্থহীন, এসব বিষয়ে ধর্মীয় গোড়ামীর পথ উন্মুক্ত রাখা অনুচিত। (ব্যারিস্টার জহিরুদ্দিন আলিগ রচিত আওরঙ্গজেব আওর উসকা আহদ থেকে গৃহীত)
বাদশাহ আলমগীরের সময়ে হিন্দু আমির উমারাদের আরেকটি তালিকা নিম্নরূপ:
৭ হাজারি ৩ জন, ৬ হাজারি ৩ জন, ৫ হাজারি ৯ জন, ৪ হাজারি ৫ জন, ৩ হাজারি ১৩ জন, আড়াই হাজারি ৯ জন, ২ হাজারি ৫ জন, দেড় হাজারি ৪০ জন, ১ হাজারি ৮ জন, ৭ শতকি ১ জন, ৫ শতকি ১ জন, ১ শতকি ১ জন।
উক্ত মনসবদারগণ ছাড়াও ৪১টি আরও বিভিন্ন পদে হিন্দু আমির উমারা ছিলেন। ০৭ হাজারি মনসব ছিল সবার উপরে। এ মনসবের অধিকারীর জন্য নি¤œ বর্ণিত সুবিধাদি থাকতো।
ঘোড়া ৪৯০ টি। হাতি ১৪১ টি। উট ১১০টি। খচ্চর ২৭ টি। ছ্যাকড়া ২২০ টি। মাসিক ভাতা ৪৫ হাজার রুপি।
১নং ৫ হাজারি মনসবের অধিকারীদের জন্য নি¤œ উল্লিখিত সুবিধা থাকতো।
ঘোড়া ৩৪০টি। হাতি ১১৫টি। উট ১০০টি। খচ্চর ২০টি। ছ্যাকড়া ১৬০টি। ভাতা ৩০ হাজার রুপি।
২ নং পাঁচ হাজারি মনসবের অধিকারী ব্যক্তির ভাতা ছিল ২৯ হাজার রুপি।
৩ নং এর ভাতা ছিল মাসিক ২৮ হাজার রুপি। এভাবে প্রত্যেক আমিরের স্তর অনুযায়ী বড় বড় ভাতা ও মাসোহারা ছিল যা আজকাল কল্পনায় আসতে পারে না।
৭ হাজারি হিন্দু আমিরদের ভেতর সাহু পেসার মহারাজা শিতাও ছিলেন। আর পাঁচ হাজারি আমীরদের মাঝে শিবাজী রাজে ভোঁসলের জামাতা রাজেন্দ্র জী এবং মালভি ভোঁসেলও ছিলেন। আওরঙ্গজেবের সেনাপতিদের মাঝে রাজা জয় সিংহ (যার নামে শহর জয়পুর) ৫ হাজারি মনসবদারদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রাজা জশুনাত সিংহ কাবুলের গভর্নর ছিলেন। [উলামায়ে হিন্দ কা শান্দার মাজি, ১ম খ-]
আওরঙ্গজেবের শাসনামল যেহেতু সুদীর্ঘ ছিল তাই আমিরদের তালিকায় হ্রাস বৃদ্ধি হওয়াই স্বাভাবিক। প্রত্যেক ঐতিহাসিক তাঁর সময়ের পরিসংখ্যান দিয়েছেন।
স¤্রাট জহিরুদ্দিন বাবর তাঁর সন্তান নাসিরুদ্দীন হুমায়ুনকে গোপন অসিয়তে লিখেন, হে বৎস! ভারতবর্ষ বিভিন্ন ধর্মের মানুষে পূর্ণ। আল্লাহর প্রশংসা। তিনি এই বিরাট সা¤্রাজ্যের বাদশাহি তোমাকে দান করেছেন। তোমার জন্য আবশ্যক হচ্ছে তুমি তোমার মন থেকে সমস্ত ধর্মীয় গোড়ামি ধুয়ে ফেল। ন্যায় বিচার করার ক্ষেত্রে সকল ধর্ম ও জাতির প্রতিই খেয়াল রাখবে। সব জাতি ও ধর্মকে সমান চোখে দেখা ছাড়া এত বড় ভারতবর্ষের সব মানুষের মন পাওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না। এদেশের মানুষ মমতা ও রাজসিক উদারতা ব্যতীত তোমার অনুগত থাকবে না। যেই জাতি বা ধর্মের অনুসারীরা রাষ্ট্রের অনুগত হবে তাদের মন্দির ও তীর্থস্থান সংরক্ষণ তোমার কর্তব্য। ধর্মীয় উপাসনালয় যেন কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। [চলমান]
ভাষান্তর : ফয়জুল্লাহ আমান
মাসিক পাথেয়, ডিসেম্বর ২০১৭