ইখলাস সৎকর্মের প্রাণ

ইখলাস সৎকর্মের প্রাণ

আত্মশুদ্ধি ● কাজী আবুল কালাম সিদ্দীক

প্রতিটি কাজের ধারণা অথবা আদেশ অথবা প্রারম্ভ প্রক্রিয়া যেখান থেকেই আসুক না কেন, সিদ্ধান্ত নিতে হয় ব্যক্তিকেই। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে এ নিয়ে ভাবতে হয়, ভালো-মন্দ ফলাফলেরও একটা অগ্রিম রূপ দেখে নেয় মনে মনে। এঁকে নেয় কর্মনীতি ও কর্মপন্থার রূপরেখা। তবে সবকিছুই নির্ভর করে এমন এক মৌলিক গুণের ওপর, যার নাম নিয়ত বা সংকল্প অথবা ইচ্ছা। এই নিয়ত বা ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতেই মোড় নেয় কাজের ধরন, গতি, ধারা এবং ফলাফল। ভালো ও মন্দ কাজের শুরুটা মূলত নিয়তের দ্বারাই হয় এবং ইচ্ছার প্রভাবেই বিভাজিত হয়।

ইখলাস বলতে যা বোঝায় তা হলো ইচ্ছার স্বচ্ছতা বা একনিষ্ঠতা। পৃথিবীর যে কোনো আদর্শে, যে কোনো কাজেÑচাই তা ভালো হোক কিংবা মন্দ, ইখলাসই পৌঁছে দিতে পারে সাফল্যের দোরগোড়ায়। দোরগোড়ায় এ জন্য যে, অনেক ক্ষেত্রে কোনো কার্যের সফলতা ভাগ্যে না থাকলে সঠিক ইখলাস ও কর্মতৎপরতা সত্ত্বেও ব্যক্তি ব্যর্থ হয়। এটা একান্তই তাকদিরের বিষয়। কিন্তু ব্যক্তির উচিত যে কর্ম সাধন করার ইচ্ছা বা নিয়ত করেছে, তাতে পরিপূর্ণ আন্তরিক হওয়া, বিশুদ্ধতা পোষণ করা। আর সৎ কার্যাবলীর ক্ষেত্রে তো এর কোনো বিকল্প নেই। কেননা, সৎ কাজ আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার প্রধান শর্তই হলো নিয়তের বিশুদ্ধতা। আমিরুল মুমিনিন উমর ইবনে খাত্তাব রা. বর্ণনা করেন, আমি রাসুলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, সব কাজের প্রতিফল কেবল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তিই নিয়ত অনুসারে তার কাজের প্রতিফল পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলর (সন্তুষ্টির) জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরত আল্লাহ ও রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত দুনিয়া হাসিল করা কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হবে, তার হিজরত সে লক্ষ্যেই নিবেদিত হবে। [বুখারি : ১/২(১), মুসলিম : ৬/৪৮(১৯০৭)] পবিত্র কোরআনে ইখলাস সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যথাÑবলো, ‘তোমরা কি আমাদের সঙ্গে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করছ অথচ তিনি আমাদের রব ও তোমাদের রব? আর আমাদের জন্য রয়েছে আমাদের আমলগুলো এবং তোমাদের জন্য তোমাদের আমলগুলো এবং আমরা তাঁর জন্যই একনিষ্ঠ। ( সূরা বাকারা : ১৩৯ ) অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেনÑজেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই বিশুদ্ধ ইবাদতÑআনুগত্য। আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা কেবল এজন্যই তাদের ইবাদত করি যে, তারা আমাদের আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে।’ যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে, আল্লাহ নিশ্চয় সে ব্যাপারে তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না। (সূরা আয-যুমার : ৩) ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। আর তুমি কখনও তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী পাবে না। (১৪৫) তবে যারা তাওবা করে নিজদের শুধরে নেয়, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে এবং আল্লাহর জন্য নিজেদের দীনকে খালেস করে, তারা মুমিনদের সঙ্গে থাকবে। আর অচিরেই আল্লাহ মুমিনদের মহাপুরস্কার দান করবেন। (১৪৬) ( সূরা আন-নিসা : ১৪৫-১৪৬)

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেনÑ‘তুমি কি দেখনি যে, নৌযানগুলো আল্লাহর অনুগ্রহে সমুদ্রে চলাচল করে, যাতে তিনি তাঁর কিছু নিদর্শন তোমাদের দেখাতে পারেন। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে। আর যখন ঢেউ তাদের ছায়ার মতো আচ্ছন্ন করে নেয়, তখন তারা একনিষ্ঠ অবস্থায় আনুগত্যভরে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর যখন তিনি তাদের উদ্ধার করে স্থলে পৌঁছে দেন, তখন তাদের কেউ কেউ (ঈমান ও কুফরির) মধ্যপথে থাকে। আর বিশ্বাসঘাতক ও কাফির ব্যক্তি ছাড়া কেউ আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করে না। (সূরা লুকমান : ৩১-৩২)

কর্মের সঙ্গে ইখলাসের সংযোজন যে কত বড় মহা সাফল্য এনে দিতে পারে মুমিনের ইহ ও পরজীবনে, তা নিম্নের হাদিস থেকে অনুধাবন করা যাবে : ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রব থেকে বর্ণনা করেছেন : তিনি বলেন, আল্লাহ্ ভালো এবং মন্দ লিখে দিয়েছেন, তারপর তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। অতএব, যে কেউ কোনো সৎকাজের ইচ্ছা করে তা না করলেও আল্লাহ তাকে পূর্ণ কাজের সওয়াব দেবেন। আর যদি সে সৎ কাজের ইচ্ছা করে এবং বাস্তবে তা করেও ফেলে, আল্লাহ্ তার জন্য দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত; এমনকি এর চেয়েও অধিক সওয়াব লিখে দেন। আর যে কেউ কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করার পর যদি তা না করে, তবে আল্লাহ্ তার বিনিময়ে তাকে পূর্ণ কাজের সওয়াব দেন। পক্ষান্তরে যদি সে মন্দ কাজের ইচ্ছা করে এবং কাজটা করেই ফেলে, তাহলে আল্লাহ্ তার জন্য একটি মাত্র গোনাহ্ লেখেন।) [বুখারি : ৬৪৯১, মুসলিম : ১৩১]

উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা বর্ণনা করেন, রাসুলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন Ñএকটি সেনাদল কাবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে যাবে। তারা যখন সমতলভূমিতে পৌঁছবে, তখন তাদের সামনের ও পেছনের সব লোকসহ ভূমিতে ধসিয়ে দেয়া হবে। হজরত আয়েশা রা জিজ্ঞেস করলেন : হে আল্লাহর রাসুল! কীভাবে আগের ও পরের সব লোকসহ তাদের ধসিয়ে দেয়া হবে? যখন তাদের মধ্যে অনেক শহরবাসী থাকবে এবং অনেকে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে তাদের সঙ্গে শামিল হবে না? রাসূলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আগের ও পরের সব লোককেই ভূমিতে ধসিয়ে দেয়া হবে। অতঃপর লোকদের নিয়ত অনুসারে তাদের পুনরুত্থিত করা হবে। [বুখারি : ৩/৮৬(২১১৮) ও মুসলিম : ৮/১৬৮ (২৮৮৪)] এখানে শব্দাবলী শুধু বুখারি থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ আল-আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে এক যুদ্ধে শরিক হলাম, তখন তিনি বলেন, মদিনায় এমন কিছু লোক রয়েছে, তোমরা যেখানেই সফর কর এবং যে উপত্যকা অতিক্রম কর, সেখানেই তারা তোমাদের সঙ্গে থাকে। রোগ-ব্যাধি তাদের আটকে রেখেছে। (মুসলিম) অন্য বর্ণনা মতে, তারা সওয়াবে তোমাদের সঙ্গেই শরিক থাকবে। ইমাম বুখারি এই হাদিসটি হজরত আনাস রা. থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন : আমরা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর তিনি বলেন : আমরা মদিনায় আমাদের পেছনে এমন কিছু লোক রেখে গিয়েছিলাম, আমরা যে গিরিপথ এবং যে ময়দানই অতিক্রম করেছি, তারা (যেন) আমাদের সঙ্গেই ছিল। এক ধরনের ওজর তাদের আটকে রেখেছে।

হজরত আবু ইসহাক সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্ আস রা. বর্ণনা করেন : আমি বিদায় হজের বছরে খুব কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে রাসুলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার খোঁজখবর নিতে এলেন। আমি নিবেদন করলাম : হে আল্লাহর রাসূল! আমার রোগের তীব্রতা আপনি লক্ষ্য করছেন। আমি অনেক ধন-মালের অধিকারী। কিন্তু আমার উত্তরাধিকারী শুধু আমার মেয়েই। এ অবস্থায় আমি কি আমার সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ সদকা করে দিতে পারি? রাসূলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘না’। আমি নিবেদন করলাম : ‘তাহলে অর্ধেক পরিমাণ (দান করে দেই)? তিনি বলেন : না। আমি আবার নিবেদন করলাম, ‘তাহলে এক-তৃতীয়াংশ (দান করে দেই)? তিনি বলেন : ‘হ্যাঁ, এক-তৃতীয়াংশ দান করতে পার।’ অবশ্য এটাও অনেক বেশি অথবা বড়। তোমাদের উত্তরাধিকারীদের একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় না রেখে তাদের বিত্তবান অবস্থায় রেখে যাওয়াই শ্রেয়, যেন তাদের মানুষের সামনে হাত পাততে না হয়। তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যা কিছুই ব্যয় করবে, এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে যে খাবার তুলে দেবে, তার সবকিছুরই সওয়াব (প্রতিদান) তোমাকে দেয়া হবে। এরপর আমি (বর্ণনাকারী আবু ইসহাক) বললাম : হে আল্লাহর রাসূল! আমার সঙ্গী-সাথীদের (মদিনায়) চলে যাওয়ার পর আমি কি পেছনে (মক্কায়) থেকে যাব? তিনি বললেন, পেছনে থেকে গেলে তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে কাজই করবে, তাতে তোমার সম্মান ও মর্যাদা অত্যন্ত বেড়ে যাবে। আশা করা যায়, তুমি দীর্ঘ জীবন লাভ করবে। ফলে কিছু লোক তোমার দ্বারা উপকৃত হবে, আবার অন্য কিছু লোক তোমার দ্বারা কষ্ট পাবে। হে আল্লাহ! আমার সাহাবিদের হিজরত পূর্ণ করে দাও এবং তাদের ব্যর্থতার কবল থেকে রক্ষা কর।” তবে সা’দ ইবনে খাওলা যথার্থই কৃপার পাত্র। মক্কায় তার মৃত্যু ঘটলে রাসুলে আকরাম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মর্মে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন যে, তিনি হিজরতের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হন। [বুখারি : ১/২২(৫৬) ও মুসলিম : ৫/৭১(১৬২৮)(৫)]

ভালো কাজ কমবেশি সব মানুষই করে থাকে। যারা দুনিয়ার জীবনকেই একমাত্র জীবন মনে করে, মৃত্যুকেই মানবের নিঃশেষ বলে বিশ্বাস করে কিংবা সত্য দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না, তাদের সৎকর্মের ফলাফল কোনো না কোনোভাবে আল্লাহ্ দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন। কেননা, আখেরাতে প্রতিদান পেতে হলে শর্ত হলো সৎকর্মের সঙ্গে ঈমানের সংযুক্তি। অতএব, যারা সৎকর্ম শুধু জনকল্যাণ, সততার বহিঃপ্রকাশ কিংবা একান্ত নিজস্ব প্রয়োজনে সম্পাদন করে থাকে তারা পার্থিবতায় যা পায় একজন ঈমানদার ব্যক্তিও তা থেকে বঞ্চিত হন না। পার্থক্য হলো মুমিন ব্যক্তি তার ঈমানের দাবি হিসেবে, তার প্রভুর আদেশ হিসেবে এবং তার আখিরাতের পুঁজির অতিরিক্ত কিছু হিসেব করেই সৎকর্মের নিয়ত বা ইচ্ছা করে থাকে। তাই উভয়ের কর্ম এক হলেও প্রতিদানের পার্থক্য ব্যাপক। তদুপরি মুমিনদের মধ্য থেকে কেউ যদি সৎকর্মের জন্য অসৎ নিয়ত বা ইচ্ছা পোষণ না করে, কপটতা করে, কূটকৌশল সম্পাদনের জন্যই সৎকর্ম করে কিংবা ইত্যকার যাবতীয় ইখলাস পরিপন্থী ইচ্ছার ফলে সৎকর্ম সম্পাদন করে, তবে তার এই সৎকর্ম দুনিয়ার উদ্দেশ্য সফল করতে পারলেও আখেরাতে তা কোনোই কাজে আসবে না; বরং অসৎ উদ্দেশ্যে সাধিত সৎকর্মই তার জন্য পাপ বয়ে আনবে ও জাহান্নামের কারণ হয়ে যাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *