‘ইতিকাফ’ রবের কাছে ক্ষমার দাবিতে বান্দার অবস্থান কর্মসূচি

‘ইতিকাফ’ রবের কাছে ক্ষমার দাবিতে বান্দার অবস্থান কর্মসূচি

  • মাওলানা আবু আইমান

ইতিকাফ শব্দটি আরবি। এর অর্থ অবস্থান করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় দুনিয়াবি সমস্ত কার্যকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সওয়াব-এর উদ্দেশ্যে মসজিদে বা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা বা স্থিতিশীল থাকাকে ইতিকাফ বলে।

ইতিকাফে কি পাব? এই প্রশ্নের উত্তর জেনে আপনি অবাক হবেন। আসুন জেনে নেই-

১. একজন ব্যক্তি ইতিকাফকারী তার ছালাত যথাসময়ে জামাতের সাথে আদায় করতে পারবে, ফলে সে জামাতের সাথে ছালাতের সওয়াব অর্জন করবে। যা একা একা আদায় করার চেয়ে সাতাশ গুণ বেশি। অন্যদিকে বাইরের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে এই আধুনিক যুগে নানাব্যস্ততার কারণে এত ধারাবাহিকতার সাথে এই মহান পুরস্কারটি অর্জন করতে পারবে না।

২. একজন মুতাকিফের (ইতিকাফকারী) দ্বারা সবচেয়ে বেশি নফল সালাত আদায় করতে পারে।কারণ তার লক্ষ্য হল তার রবের ইবাদত করা এবং তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং এই অর্জনের সর্বোত্তম উপায় হলো নামাজ আদায় করা।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হয়, যখন সিজদারত থাকে। অতএব তোমরা তখন অধিক দোয়া করতে থাকো।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪৮২)

উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.) বর্ণনা করেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, ‘বান্দা যখনই আল্লাহর সামনে সিজদা করে, তখন তার জন্য একটি নেকী লিখে দেওয়া হয় এবং একটি গুনাহ মুছে ফেলা হয় এবং তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করা হয়, সুতরাং যতটা সম্ভব সেজদা কর।’ (ইবনে মাজা)

৩. ইতিকাফের আরেকটি সুবিধা হল মুতাকিফ প্রথম কাতারে তার নামায পড়তে পারে। এই কাতারে নামায পড়ার তার জন্য খুবই সহজ।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করে বলেছেন, ‘যদি মানুষ জানতে পারত, আজান এবং প্রথম কাতারে নামাজ আদায়ের মধ্যে কি ফজিলত, আর তা লটারি ব্যতীত অর্জন করা সম্ভব না হত, তবে তার জন্য লোকেরা অবশ্যই লটারি করত। আর যদি জানতে পারত, মসজিদে আগে আসার মধ্যে কি ফজিলত, তাহলে তার জন্য প্রতিযোগিতা করে আসত।’ (সহিহ বোখারি: ৬১৫)

৪. মুতাকিফের (ইতিকাফকারীর) আরেকটি সাওয়াব অর্জন হয় নামাজের অপেক্ষা করে।যা অন্য সবার চেয়ে তিনিই বেশি করেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুল (সা.) এর সঙ্গে মাগরিব আদায় করলাম, অতঃপর যারা ফিরে যাওয়ার ফিরে গেল এবং যারা থাকার থাকল, পরক্ষণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্রুত ফিরে এলেন, তাঁর নিঃশ্বাস জোরে পড়ছিল, তার হাঁটুর কাপড় উঠে যাচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, তোমাদের প্রতিপালক আসমানের একটি দরজা খুলে তোমাদের নিয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ব করছেন। তিনি বলছেন, আমার বান্দাদের দেখো, তারা এক ফরজ শেষ করে অপর ফরজের অপেক্ষা করছে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৮০১)

৫. দীর্ঘসময় মসজিদে অবস্থানের ফলে মসজিদের সাথে একটা কলবের সম্পর্ক তৈরি হয়।মসজিদের প্রতি আলাদা মায়া ভালবাসার সুতোর টান তৈরি হয়।যার ফলে জীবনের স্বাভাবিক ব্যস্ততার ভীড়েও মন পড়ে থাকে মসজিদে। এমন মানুষদের জন্যই নবিজি (সা.) চমৎকার এক অফার ঘোষণা করে বলেন- ‘আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না।তাদের অন্যতম হলেন,সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদসমূহের সাথে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে)।’

৬. ইতিকাফে তাহাজ্জুদ পড়া সবচেয়ে সহজ হয়ে যায়।অথচ এই নামাজ পড়তে শয়তান আমাদেরকে সারাবছর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

৭. ইতিকাফ আপনার শবে কদরকে নিশ্চিত করে। ইতিকাফ অবস্থায় থাকার অর্থ হল আপনি সেই মহিমান্বিত রাত যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তা নিশ্চিতভাবেই পাচ্ছেন।একটা শবে কদরের রাত ৩,০০০ দিন বা ৮৩ বছরের চেয়ে বেশি।অথচ অনেকের জন্য পুরো জীবনকালের চেয়েও বেশি তাই এই রাতে যদি আমাদের ইবাদত কবুল হয় তবে মনে হবে আমরা সারা জীবন ইবাদত করেছি!

নবী (সা.) বলেছেন, লাইলাতুল কদর হচ্ছে, রামাযান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতসমূহের যে কোন একটি রাত। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা. ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা রামাযান মাসের শেষ দশ দিনে রাতসমূহে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। (বুখারী)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস হতে অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ লাইলাতুল কদর রামাযানের শেষ দশ দিনের রাতসমূহে রয়েছে।’ (বুখারী)

তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা তা রামাযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতসমূহে লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (তিরমজী, মুসনাদে আহমাদ)

৮. কুরআন তিলাওয়াতের সেরা সময়। রমজানের সঙ্গে কোরআন মাজিদের বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও রমজান মাসে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। প্রতি বছর রমজান মাসে ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.) বারবার রাসুল (সা.)-এর কাছে কোরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রমজান মাসের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) রাসুল (সা.) এর কাছে হাজির হতেন এবং তারা উভয়ই কোরআন তেলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (সহিহ বোখারি)

রমজান মাস মুসলমানদের হৃদয়ে কোরআনকে লালন-পালন করার মাস। তাই কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত অন্য মাসের চেয়ে এ মাসে বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সাধ্যমতো গুরুত্বপূর্ণ সুরা বা আয়াতসমূহ অর্থ বুঝে শুদ্ধভাবে মুখস্থ করার চেষ্টা করা সবার জন্য অবশ্য কর্তব্য।আর মাহে রমজানের এই দাবী পূরনে ইতিকাফ হল সবচেয়ে কার্যকরী সময়।

৯. রবের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশের চমৎকার সুযোগ। আল্লাহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁর ইবাদাত করার জন্য। আর ইতিকাফের মাধ্যমে মানুষ তার রবের ইবাদত করে থাকে। কারণ একজন মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে তখন প্রথমে তার প্রতি আস্থাশীল হয়। তারপর তার আনুগত্য প্রকাশ করে। তারপর প্রয়োজনে তার জন্য বাড়ি-ঘর ত্যাগ করে। তারপর তার জন্য খানা-পিনা ইত্যাদি ত্যাগ করে।

ঠিক তেমনিভাবে মানুষ ঈমানের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল হয়। এরপর সালাতের মাধ্যমে প্রথমে অনুগত্য প্রকাশ করে। হজ্জের মাধ্যমে বাড়ি-ঘর ত্যাগ করে। যাকাতের মাধ্যমে অর্থ- সম্পদ ব্যায় করে। আর সাওমের মাধ্যমে খানা-পিনা ও স্ত্রীকে ত্যাগ করে বান্দা আল্লাহ তায়ালার চূড়ান্ত আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে।আর ইতিকাফ হলো এই সবগুলোর বান্ডেল প্যাকেজ যেখানে উল্লিখিত সবগুলোই বিদ্যমান।

১০. ফেরেশতাদের রঙে নিজেকে রঙিন করার সুবর্ণ সুযোগ। ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য হলো, ‘তারা গুনাহ করে না, আল্লাহতালার নির্দেশ পালনে বদ্ধপরিকর।’ ইতিকাফকারী সে মসজিদে থাকে গুনাহ করে না। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মোতাবেক পরিপূর্ণ জীবন যাপনের সুবর্ণ সুযোগ পায়। যার ফলে তার মাঝে আর ফেরেশতার মাঝে তেমন পার্থক্য থাকে না।

প্রিয় পাঠক! ইতিকাফ এ যেন রবের কাছে ক্ষমার দাবিতে বান্দার অবস্থান কর্মসূচি। যে রব এক বিশাল হায়াত আমাকে দান করেছেন, আসুন শুধুমাত্র তার জন্য অন্তত দশটি দিন কুরবানী করে নিজেদের জীবন আরো সুন্দর করি।

  • লেখক: খতীব, আল্লামা জালালুদ্দিন রুমি (রহ.) জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *