ইতিহাসের আলোকিত মশাল হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.

ইতিহাসের আলোকিত মশাল হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.

ইতিহাসের আলোকিত মশাল হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.

মাওলানা আমিনুল ইসলাম :: যাদের নিয়ে ইতিহাস লেখা হয়, যারা ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন। যাদের কর্মময় জীবন, যাদের অবদান চিরস্মরণীয়। বিশেষ করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যাদের সীমাহীন ত্যাগ – কোরবানী রয়েছে। তাদের মধ্যে হুসাইন আহমাদ মাদানী অন্যতম। দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান এর কথা তুললে, যার নাম লিখতেই হয়, তিনি হুসাইন আহমাদ মাদানী। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে যার অবদান পরতে পরতে তাঁর নাম হুসাইন আহমাদ মাদানী। দারুল উলুম দেওবন্দে হাদীসের মসনদ যিনি আলোকিত করেছেন, তার নাম হুসাইন আহমাদ মাদানী।

হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ, এমন এক ব্যক্তিত্ব, এমন এক মর্দে মুজাহিদ, এমন এক কামেল আদর্শ মানুষ, যার কামালিয়্যাত সর্বক্ষেত্রে। কোন সেক্টর বাকি নেই, যেখানে মাওলানা মাদানীর অবদান নেই।

এই মহান ব্যক্তি এমন কিছু মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছিলেন, যারা বিশ্বব্যাপি সকল ফনুনাতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ঠিক সেই তিন মহান ব্যক্তির সোহবতে তিনিও হয়ে ওঠেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত। একদিকে কুতুবে আলম, বিশ্ব কুতুব। ইলমে তাসাউফ সাধনায় বিশ্ব ওলীর মর্য্যাদায় পৌছে ছিলেন। একজন মর্দে মুজাহিদ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ। অদম্য সাহসিকতায় তিনি পরাক্রমশালী ব্রিটিশবাহিনীকে ধরাশায়ী করেছিলেন। আবার তিনি ছিলেন খাতামুল মুহাদ্দিসীন। শতাব্দীর সেরা এক মুহাদ্দিস।

তিনজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের সোহবত মাওলানা মাদানীকে ধন্য করেছিল।
এক,, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ,, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন।

দুই,, রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ,, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এক মর্দেমুজাহিদ সৈনিক। আবার ফকীহুন নাফস। কতুবে রাব্বানী।

তিন,, শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ,, যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে রেশমী রুমাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যে আন্দোলনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। শায়খুল হিন্দের সে আন্দোলন সংগ্রাম বিশ্ববাসীর হৃদয়পটে আজো গেঁথে আছে।

উক্ত তিন মনিষীর সংস্পর্শে মাওলানা মাদানী নিজেকে অনেক উচ্চতায় নিতে সক্ষম। তাঁর উস্তাদগণের রেখে যাওয়া আমানত পুঙ্খানুপুঙ্খু রুপে রক্ষা করেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কলিজা কাঁপানো এক মুজাহিদ। যার ত্যাগ- তিতিক্ষায় শেষমেষ ব্রিটিশ বাহিনী স্যারেন্ডার করতে বাধ্য হয়েছিল।

একজন বে- মেছাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যার কোন তুলনা সমকালিন যুগে কারো সাথে হয় না। খ্যাতিমান আলেম, ইলমে হাদীসের ময়দানের এক উজ্জল নক্ষত্র। সুদীর্ঘকাল মসজিদে নববীতে হাদীসের দরস দিয়েছেন। দারুল উলুম উলুম দেওবন্দে প্রায় ত্রিশবছর যাবত শায়খুল হাদীসের পদকে অলংকৃত করেছিলেন। কুতুবে রব্বানী রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহীর আজাল্লে দরজার খলিফা। এ ময়দানের সর্বোচ্চ চুড়ায় তাঁর বিচরণ ছিল। আবার রাজনীতির ময়দানে তেজস্বী এক নেতা। যার দক্ষ নেতৃত্বে কাবু হয়েছে হিংস্র ব্রিটিশ বাহিনী।

মাওলানা মাদানী কেমন ছিলেন? কি তাঁর যোগ্যতা? কি রকম ইলম? কত উঁচু পর্যায়ের বুজুর্গ তিনি। সেটা আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের বয়ান করা সম্ভব নয়। মাদানী রহ, এর বড় বড় শাগরেদ, যারা জগদ্বিখ্যাত আলেম ছিলেন, তারা পর্যন্ত অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। অনেক মহাপন্ডিত মাদানী রহ, এর মর্য্যাদা, ব্যাক্তিত্বের বর্ননা দিতে দুর্বলতা প্রকাশ করেছেন, সেখানে আমার দ্বারা তো কিছু লেখা সম্ভব নয়।

দারুল উলুম দেওবন্দের দীর্ঘদিনের মুহতামিম, আল্লামা ক্বারী তৈয়ব সাহেব রহ, লিখেছেন, ” শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ, আমাদের আকাবির ও মহান ব্যক্তিদের মাঝে অতুলনীয় ও অনন্য বৈশিষ্টের অধিকারী। ” হযরত কি মেছাল হযরত খোদ হেঁ” তাঁর তুলনা তিনি স্বয়ং,। ক্বারী তৈয়ব সাহেব রহ, আরো লিখেছেন, মাওলানা মাদানী রহ, তিনি একই সময় মুসলিম বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মুহাদ্দিস, শাইখে তরীকত এবং সুদীর্ঘ বিরামহীন সিপাহসালার ছিলেন”। ” তাঁর কর্মবহুল জীবনে ক্লান্তি- শ্রান্তির নাম গন্ধ ছিল না, বিশ্রাম ও অবকাশ যাপনের অনুপ্রবেশ ও তাঁর জীবনে ঘটেনি।
( বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর,লেখক, আল্লামা কাজী মু’ তাসিম বিল্লাহ, পৃষ্টা- ৪)

হযরত মাদানীর ইন্তেকালের পর এক শোক সভায় আল্লামা ক্বারী তৈয়ব সাহেব রহ, বলেন, ” ১৮৫৭ সনে শামেলীর প্রান্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান সেনাপতি হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী রহ, সম্মুখ সমরে বিপর্যয়ের পরে জিহাদে আজাদীর নতুন ফ্রন্ট খোলার মানসে মুসলিম বিশ্বের অতুলনীয় বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান ” দারুল উলুম দেওবন্দের সুচনা করে যে চারা রোপন করে যান, হযরত নানুতবী রহ, এর মানসপুত্র হযরত শায়খুল হিন্দ হাসান রহ, সেই রোপিত চারাকে সযত্নে পরিচর্যা করে সতেজ-সজীব বৃক্ষে পরিণত করেন। জানেশীনে শায়খুল হিন্দ পুত্রবৎ সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হযরত মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ, সে বৃক্ষকে ফুলে-ফলে, পত্রে পুস্পে সুশোভিত প্রকান্ড মহীরুহ পরিণত করে চলে গেলেন। এভাবে একশত বর্ষের সংগ্রাম – সাধনা তার পরিপুর্ণতায় পৌছে গেল।” ( বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর, লেখক, আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ পৃষ্টা- ৬)

মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহঃ এর বিশিষ্ট শাগরেদ, মুজাহিদে আযম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহঃ তিনি মাদানী রহ,, সম্পর্কে লিখেছেন-
মাওলানা মাদানী রহ, সারাবিশ্বের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ক্ষণজন্মা মনীষীগণের অন্যতম। তাঁর জ্ঞান ও গুণ সম্বন্ধে বর্ননা দান করা আমার ন্যায় গুণহীন ক্ষুদ্র জ্ঞান বিশিষ্ট লোকের পক্ষে সম্পুর্ণ অসম্ভব। কিন্তু মানুষ সাধারণত একটি আদর্শ সম্মুখে না পেলে এবং জীবন গঠনের তরতীব না পেলে আদর্শ জীবন গঠন করতে পারেনা। যেসব মানুষ মাওলানা মাদানীর ব্যক্তিত্বের কিছু পরিচয় জানেন, তাঁরা এক ব্যাক্যে স্বীকার করবেন যে, দুনিয়াতে আদর্শ মানুষ বলতে শেষ যুগে যারা পয়দা হয়েছিলেন, তাদের সেই সিলসিলার শেষ ব্যক্তি ছিলেন মাওলানা মাদানী রহ,।

আজ জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে মানুষ যাকে তাকে মুহাদ্দিস বলে থাকে। দারুল উলুম দেওবন্দে মুহাদ্দিস এবং ছদরে -মুদাররিস ও সেরপরস্ত যেমন তেমন লোক কখনো হতে পারেনি। এ পর্যন্ত যে কয়জন দারুল উলুম দেওবন্দের ছদরে- মুদাররিস বা সেরপরস্ত হয়েছেন, তাঁরা ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র, আধ্যাত্মিক জগতের সেরা, মনুষ্যত্বের প্রতিচ্ছবি। তারা হলেন-

১/ মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ,,
২/ মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ,
৩/ মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানুতবী রহ,
৪/ শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ,
৫/ মাওলানা খলীল আহমাদ সাহারণপুরী রহ,,
৬/ মাওলানা আশরাফ আলী থানুবী রহ,,
৭/ মাওলানা সাইয়্যেদ আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ,
৮/ মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ,

এঁদের মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন শায়খুল ইসলাম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ,। তারা সকলেই ছিলেন কামেল ও আদর্শ পুরুষ। কামেল ও আদর্শ পুরুষের জন্য যা কিছু জ্ঞান ও গুণের প্রয়োজন, সে সবই মাওলানা মাদানী অর্জন করেছিলেন। ইলম হাসিলের পর্যায়ে আদব বা আরবী সাহিত্য তার যাবতীয় উপকরণ হতে আরম্ভ করে হাদীস, তাফসীর, দর্শন, ভুগোল, ইতিহাস, শরীর বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, ইলমে সিয়াসাত তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইলমে কালাম ও তাসাউফ প্রভৃতি ত্রিশপ্রকারের বিদ্যায় এতো গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা এবং পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন যে, সকল শাস্ত্রের কিতাবসমুহ যদি খোদা নাখাস্তা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হতো, তবুও এ সমস্ত শাস্ত্রের কিতাবসমুহ তিনি পুন: রচনা করে দিতে পারতেন। কথাটা অনেকেই হয়ত অতিরন্জিত মনে করবেন। কিন্তু আমি তাঁকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি। যারা মাওলানা মাদানীকে আমার মতো কাছে থেকে দেখার সুযোগ লাভ করেছেন, তারা নিশ্চয়ই আমার কথার সত্যতা পুর্ণভাবে স্বীকার করবেন।
( “ফিদায়ে মিল্লাত সাইয়িদ আসআদ মাদানী (র) ” লেখক, সালেহ আহমাদ) পৃষ্টা-২৯)

মাওলানা মাদানী রহ, অত্যান্ত মেধা- ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন। জ্ঞান অর্জনের সকল বিষয়ে তিনি কৃতিত্বের সাথে সফল হয়েছিলেন। শুধু মাত্র বৈষয়িক ট্রেনিং নয়, আধ্যাত্মিকতার ট্রেনিং এ তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ন হন।

কঠোর সাধনায় তাঁর জীবন গঠন। জীবনের শুরু থেকে কঠিন অধ্যাবসায়ে তাঁর জীবন গড়ে তোলা। নিজেকে মেহনত- মোজাহাদার মাধ্যমে অতি উচ্চতায় নিতে তাঁর অবিরাম মেহনত ছিল চিরদিন।

চরিত্রগুণে মানবতার শীর্ষ চুড়ায় ছিল তাঁর বিচরণ। যারা চাক্ষুস দেখেছেন তারাই সাক্ষি হয়ে আছেন। গরীব দুঃখি, আত্মীয়- অনাত্মীয়, অনাথ,দুস্হ, রোগীর সেবা, সর্বসাধারণের পাশে ছিল তাঁর মুক্ত হস্ত। প্রতিদিন প্রায় শত মানুষকে মেহমানদারী করতেন। প্রাণখুলে মানুষের আদর আপ্যায়ন করতেন। নিজের খাওয়ার প্রতি কোন আসক্তি কাজ করেনি।বরং মেহমানদারীর পরে অবশিষ্ট খাবার যদি থাকত, সেটা খেয়ে প্রভুর দরবারে শুকরিয়া আদায় করতেন।

বিরামহীন সংগ্রাম – সাধনা, মাওলানা মাদানীর বৈশিষ্ট ছিল। কষ্টকে তিনি কষ্ট মনে করেন নি। তিনি বলতেন, দুঃখ- কষ্ট যখন মানুষের অভ্যাসগত হয়ে পড়ে, তখন তা সহজ হয়ে যায়। আমার উপর দু:খ কষ্ট এত অধিক নিপতিত হয়েছে যে, তা এখন সহজ হয়ে পড়েছে।

জীবনের বহু সময় নানান জন্জাল পোহাতে হয়েছে, বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদ ব্রিটিশদের জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন যুগের পর যুগ। জালিমের জেলখানায় বন্দী থেকে বহু কষ্ট সহ্য করেছেন। এ জন্য তাঁর কাছ। কষ্ট আর কষ্ট মনে হতনা।

তিনি হাদীসের প্রধান কিতাব বুখারী শরীফের দরস দিতেন। ইলমে হাদীসের ময়দানে তিনি ছিলেন মহাসম্রাট। যত কষ্ট হোক, যত প্রোগ্রাম থাকুক, হাদীসের ক্লাশ কখনো মিস হতনা। ক্লাশে সেসময়ে দুই আড়াইশ ছাত্র। শুধু ইবারত পড়ে তর্জমা করে দিয়ে ক্ষান্ত হতেন না। সমস্ত দুনিয়ার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও চারিত্রিক ঘটনাবলী এবং বিজ্ঞানসমুহ সামনে রেখে হাদীসের ব্যাখ্যা করতেন। কখনো জ্ঞান- বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার আলো দ্বারা তিনি হাদীস ও কুরআনের বিশ্লেষণ করতেন, আবার কখনো কোরআন – হাদীসের আলোকে জ্ঞান- বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার ব্যাখ্যা করতেন।

এরপর শুরু হত, ছাত্রদের প্রশ্নত্তোর পর্ব। শত শত ছাত্রের প্রশ্নের উত্তর দিতেন হাসিমুখে। কখনো কোন প্রকার কষ্ট অনুভব করতে দেখা যায় নি। তাঁর দরস ছিল অত্যান্ত চমৎকার। তিনি ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব এমন ভাবে দিতেন, প্রতিটি ছাত্রের পিপাসা মিটে যেত। আর মাদানী সাহেবের কথার মাধুরতায় মজলিসটা যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠত।

দরস – তাদরীসের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গাতে দ্বীনি প্রোগ্রাম করেছেন।দেওবন্দের পার্শবর্তী জেলাগুলোতে মাদ্রাসার সবক শেষ করে সেসব প্রোগ্রামে নিয়মিত হাজির হয়েছেন। মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত পৌছেছেন, সাধারন জনতার দ্বারে কুরআন- হাদীসের বাণী পৌছে দিয়েছেন। তবে তার জন্য হাদীসের দরসের কোন ক্ষতি তিনি করেন নি। এমনকি তাকরীর কম করেন নি। বরং যথাযথ ভাবে ছাত্রদের হক আদায় করেছেন।

বাদ ফজর থেকে নিয়ে বেলা বারটা পর্যন্ত এবং জোহর থেকে আসর পর্যন্ত পুনরায় এশা থেকে নিয়ে রাত বারটা পর্যন্ত তিনি অধ্যাপনার কাজ করেছেন। এরপর দরস শেষে গভীর রাতে বিভিন্ন সভা,ওয়াজ মাহফিলে বক্তৃতা করেছেন, আবার সকালে যথারীতি সবক পড়ায়েছেন,এতে তিনি কখনো বিরক্তি বোধ করেন নি। বা তাঁর চেহারায় বিরক্তিভাব ফুটে ওঠেনি।

দরসে কখনো রাজনীতির আলোচনা টেনে আনেন নি। সাংগঠনিক কোন কার্যক্রম তাঁর দরসে চলত না। তাঁর কোন কথায় বা কোন রাজনৈতিক ইঙ্গিত ও তিনি সবকের মধ্যে দেন নি।

আধ্যাত্মিকতার মহান সাধক। অতি উচ্চ পর্যায়ের মনীষী। তবে তিনি শুধু তাসবীহ খানকায়ে বসে থাকার প্রবক্তা নয়। বা তাঁর মুরীদদের খানকার গন্ডির মধ্যে সময় কাটাতে বলেন নি। বরং আল্লাহর জিকির এবং আধ্যাত্মিকতার আলোর মাধ্যমে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সবকিছুকে আলোকিত করে সমাজ থেকে অনাচার দুরীভুত করার প্রচেষ্টা ছিল তাঁর। একারণে মাওলানা মাদানী রহ, যেমন ছিলেন, তদ্রুপ তাঁর খুলাফাগণ,ছাত্রগণ। তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপি। সমাজের স্তরে স্তরে পৌছে তারা দ্বীনের বাতি জ্বালিয়েছেন। সমাজ থেকে মিথ্যার ফুলঝুরি বিদায় ঘন্টা বাজানোর কোশেশ করে তারা।

মাওলানা মাদানী রহ, এর শাগরেদ যে যেখানে আছে, সকলেই এক অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তারা আধ্যত্মিকতার প্রাণপুরুষ আবার বাতিলের মোকাবেলায় লড়াকু সৈনিক।

রাজনৈতিক ময়দানে মাওলানা মাদানী রহ, এর বিচরণ ছিল বে- মেছাল। তাঁর রাজনীতির কোন তুলনা হয় না। প্রথমতঃ তিনি তো রাজনীতি শিখেছেন এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে, যারা বিশ্বব্যাপি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছিলেন। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ, যিনি শামেলীর প্রান্তরে প্রধানমন্ত্রীর ভুমিকায় ছিলেন,তেমনী রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ, তিনি ছিলেন সেই জিহাদের সৈনিক, আর তাঁর প্রিয় উস্তাদ শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী ছিলেন তো রেশমী রুমাল আন্দোলনের সিপাহসালার। এই তিন মহান ব্যক্তির সোহবত থেকেই তো মাদানী রহ, এর রাজনীতির হাতেখড়ি। সুতরাং তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে অন্য কারো সাথে তুলনা হতে পারেনা।

মাওলানা মাদানী রহ, এর রাজনীতি এবং জীবন পরিচালনা ছিল, পুরোপুরি সাহাবায়ে কেরামের নকশে কদমে। সাহাবাদের বৈশিষ্ট ছিল, ” ফুরাসান ফিন্নাহারী ওয়া রুহবানান ফিল্লাইলে”। দিনে অশ্বারোহী সৈনিক আর রাতে দুনিয়মুখ সন্ন্যাসী।

তিনি প্রচলিত রাজনীতিবিদদের মত দ্বীন ইসলামের প্রতি উদাসীন ছিলেন না। বরং তাঁর রাজনীতি ছিল মহান প্রভুর রেজামন্দী হাসিলের। পাশাপাশি নির্জনে খোদাপ্রেমে ডুবে থাকতেন। যত পরিশ্রম হোকনা কেন, গভীর রাতে মহান প্রভুর সাথে যেন তিনি কানাকানি করেছেন। বিভিন্ন প্রোগ্রাম সেরে রাত একটা/ দুইটার সময়ে যদি তিনি ঘুমিয়েছেন, তবুও আখেরী রাতে তাহাজ্জুদে কোরআন তেলাওয়াত ছোটেনি কখনো।

মাদানী রহ, এর রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন। সকলের সমর্থন তিনি পান নি। কিন্তু তাঁর রাজনীতি, তাঁর চিন্তা- চেতনা সঠিক ছিল, এটা বুঝে এসেছে পরবর্তিতে। যারাই এক সময় মাওলানা মাদানীর ঘোর বিরোধী ছিল, শেষমেষ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এমনকি তাদের মুখ থেকে বের হয়েছে মাওলানা মাদানীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা সঠিক।

বহু চড়াই- উৎরাই পেরিয়ে তিনি রাজনৈতিক মিশনকে সুদৃঢ় রেখেছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি সামনে অগ্রসর হয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। জেল- জুলুম ভোগ করতে হয়েছে। বছরের পর জালিমের বন্দীখানায় তিনি কাটিয়েছিলেন। কিন্তু হার মানেন নি দুশমুনদের কাছে। দুর্বার গতিতে সম্মুখে এগিয়ে গেছেন।

দেশকে বাঁচাতে,দেশের মানুষকে বাঁচাতে, দ্বীন ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে তাঁর যে কোরবানী,সেটা চিরদিন স্মরণ করবে ভারতবর্ষের মানুষ। ইংরেজদের মাল্টার কারাগারে প্রায় চারবছর থাকতে হয়েছিল। এরপর দেশে ফেরার পর আবারও বিভিন্ন সময়ে তাঁকে জালিম শাহীর বন্দীখানায় থাকতে হয়েছে। এভাবে বছরের পর বছর। তাঁর এই ত্যাগ- কোরবানীর বিনিময়ে এদেশে স্বাধীনতার সুর্য উদিত হয়েছিল। তাঁর মত মর্দে মুজাহিদদের ত্যাগ- তিতিক্ষা না থাকলে হয়ত আমরা এখনো ব্রিটিশদের সেবদাসে পরিণত হতাম।

এই ভারতবর্ষের পরতে পরতে মাদানী রহ, এর অবদান। আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি। সেই মহান ব্যক্তিত্বের অবদান জাতির ভবিষ্যত স্বপ্নকে উজ্জল করেছে। দেশকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করেছে।

মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ, একটি সংগ্রাম,একটি ইতিহাস, এক দেদীপ্যমান মশাল। যে মশাল জ্বলছে শত বছর ধরে। এই ভারতবর্ষ যতদিন থাকবে, সে মশাল আরো আলোকিত হবে। সৌরভ ছড়াবে দেশ থেকে দেশান্তরে। মাদানী এর সৌরভ আরো ছড়িয়ে পড়ুক। তাঁর ফয়ুজ বারাকাত থেকে জাতি ধন্য হোক এই কামনা।

মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ, আল্লাহ তায়ালা হযরত মাদানীর জান্নাতে দারাজাত বুলন্দ হোক। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *