ইলমহীন-বেআমল বক্তা থেকে সাবধান

ইলমহীন-বেআমল বক্তা থেকে সাবধান

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

ওয়াজ মাহফিল আমাদের বাংলাদেশের জন্য নেয়ামত। এরকম খোলা ময়দানে দ্বীনি আলোচনা খুব কম জায়গাতে হয়ে থাকে। সোনার এই বাংলাতে গ্রামে গ্রামে, শহরে বন্দরে, মসজিদে মাদ্রাসায়, অলিতে-গলিতে সবখানে দেখা যায় ওয়াজ মাহফিল। তাছাড়া বাংলাদেশ আলেম-ওলামার দেশ। দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে ভরপুর। এদেশে অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা। আবার এসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে বেশুমার হক্কানী-রব্বানী ওলামায়ে কেরাম। আর ওয়াজ মাহফিলগুলোতে হক্কানী আলেমগণই নসীহত করে থাকেন। তাদের কাছ থেকে কোরআন-হাদীসের অমীয়বাণী শুনে সাধারণ জনতা হেদায়েতের নুরে আলোকিত হয়ে ওঠে।

ওয়াজ মাহফিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। একটা ক্লাশের মতো। ক্লাশে যেমন ছাত্ররা উস্তাদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করে। তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়, তেমনি ওয়াজ মাহফিল থেকেও সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। ওয়ায়েজ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। অজানা বিষয় জানতে পারে। দ্বীনি চেতনা জাগ্রত হয়। দ্বীন ইসলামের প্রতি মানুষের আগ্রহ জন্মে।

কিন্তু কথা হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি শিক্ষক অযোগ্য হয় তাহলে তার থেকে ছাত্ররা কোনো ফায়দা হাসিল করতে পারে না। বরং উস্তাদের অযোগ্যতা -মূর্খতার কারণে ছাত্ররাও সেই ভুলের শিকার হয়। তদ্রুপ কোনো ওয়ায়েজ যদি মুর্খ হয়, তাহলে তিনি তো কোরআন-হাদীসের সঠিক জ্ঞান দিতে পারেন না। তখন সাধারণ স্রোতাগণ কিছু শেখার পরিবর্তে গোমরাহির দিকে ধাবিত হয়ে থাকে।

অতীব দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, ওয়াজ মাহফিলগুলোত এখন মূর্খ বক্তার ছড়াছড়ি। বেআমল ওয়ায়েজে ভরে গেছে। ওয়াজ মাহফিলের মতো একটা পরিচ্ছন্ন জায়গাতে বেআমল এবং ইলমহীন মানুষেরা আধিপত্য বিস্তার করে আছে। এখন আর ওয়াজ মাহফিলে হক্কানী-রব্বানী আলেম পাওয়া যায় না। যোগ্যতা সম্পন্ন আলেমের সেখানে উপস্থিতি কম। তাছাড়া ওয়াজ মাহফিলগুলোর ষ্টিয়ারিং চলে গেছে জাহেল লোকদের হাতে। যেকারণে ওয়াজের মঞ্চে এখন অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষ ওয়াজ করে।

কোরআন-হাদীসের সঠিক জ্ঞান না থাকার কারনে মনগড়া ওয়াজ করে থাকে। কেউ শুধু হাসি-তামাশা করে কাটায়। কিছু জাহেল বক্তা এমন, তারা যখন কথা বলে মনে হয় না এটা ওয়াজের মঞ্চ। তারা যেন নাটকের ষ্টেজ বানিয়ে ফেলেছে। সিনেমা-নাটকের কৌতুক অভিনেতাদের মতো মঞ্চায়ন করে থাকে। তাছাড়া এমন এমন কথা বলে যেটা কোরআন-হাদীসের সাথে সম্পর্ক নেই, বরং সাংঘর্ষিক। এরপরেও অবলীলায় সেসব কথা বলতে থাকে।

আজকাল কিছু আছে, মওজু হাদীস, জাল হাদীস বর্ণনা করে থাকেন। যেগুলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস নন সেগুলো হাদীস বলে চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ আজগুবি কেচ্ছাকাহিনী নিয়ে ব্যস্ত। ওয়াজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেচ্ছাকাহিনী বলে সময় পার করেন। আবার ওয়াজ মাহফিলে গানের শিল্পির ছড়াছড়ি। বাংলা সিনেমার গান, হিন্দি সিনেমার গান নকল করে সেগুলো পরিবেশন করে থাকেন। স্রোতাকে আখেরাতমুখী করার পরিবর্তে গানের সুঁড়সুড়ি তারা দেন।

ওয়াজ মাহফিলে এখন রংঢং বেশী। আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা ইখলাসপূর্ণ ওয়াজ বিদায় নিয়েছে। বক্তার ষ্টাইল, কথা বলার ভাব-ভঙ্গিমা ভিন্ন ধরনের। বডি ল্যাংগুয়েজ আপত্তিকর। কথার মধ্যে অহমিকা আর বড়াই কাজ করে। কেউ কেউ চাপাবাজি করেন বেশী। আল্লাহর ভয়, কবরের ভয়, জাহান্নামের ভয় নেই। যত্তসব বড়াই, গীবত শেকায়েত এবং অন্যের দোষ চর্চার মধ্য দিয়েই ওয়াজের ইতি টানা হচ্ছে।

আরো ভয়াবহ অবস্থা বক্তার আমল নেই। ওয়াজ করার সময় ঠিকই কেঁদে কেঁদে নসীহত করেন, কিন্তু নিজে আমল করেন না। বহু ওয়ায়েজের ব্যাপারে শোনা যায়, তারা ফরজ নামাজ তরক করেন। নামাজ প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ, কিন্তু ওয়াজ ব্যবসায়ী, ওয়াজকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, এরকম বহু বক্তা নামাজের ব্যাপারে গাফেল। গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ মাহফিল করে ফজরের নামাজ ঘুমের ঘোরে কেটে যায়। আফসোস!

মানে আল্লাহর জন্য এখন আর ওয়াজ নেই। হেদায়েতের উদ্দেশ্য নেই। এখন হলো ওয়াজকে তারা ব্যবসা হিসাবে বেছে নিয়েছে। মোটা অংকের চুক্তির মাধ্যমে ওয়াজ করতে যায়। গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ করে। এরপর চুক্তিকৃত টাকা নিয়ে সেখান থেকে চম্পট। কিন্তু নামাজ-কালামের ধার-ধারে না।

এজন্য সতর্ক হওয়া দরকার আমাদের। মূর্খ-ইলমহীন-বেআমল বক্তা থেকে সাবধান হতে হবে। যাদের ইলম নেই, আমল নেই, যারা মূর্খ এরকম বক্তাদের বয়কট করা সময়ের দাবী। কেননা ওইসব বেআমল বক্তা, ইলমহীন ওয়ায়েজ মানুষের ঈমান-আমল ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা নিজেরা গোমরাহ এবং জাতিকে গোমরাহীর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

একটু চিন্তা করে দেখুন! আজ দেখে ২০/২৫ বছর আগে ওয়াজের ময়দানটা কতো পরিচ্ছন্ন ছিল। বক্তারা আল্লাহর জন্য কাজ করেছে। নিজে আমলের পাবন্দ থেকেছে এবং মানুষকে আমলের উপরে উঠানোর কোশেশ করেছে তারা। এখন সম্পূর্ণ উল্টা। ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে ঘরে ঘরে, অলিতে গলিতে, কিন্তু মাকসাদ ভিন্ন। আয়োজকদের টাকা কালেশন আর বক্তাদের টাকা কামাই করার চিন্তা। আয়োজকগণ চিন্তা করে কীভাবে মাহফিলে বেশী টাকা আয় করা যায়। আর বক্তা ভাবে একদিনে একাধিক প্রোগ্রাম দিয়ে অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিল করা যায়। যে কারণে রুহানিয়্যাত বাকি থাকছে না।

শেষকথা, সবাইকে সজাগ হতে হবে। আয়োজক, বক্তা সকলকে আল্লাহর জন্য কাজ করতে হবে। ওয়াজ মাহফিল যতটুকু হোক, সেটা যেন ইখলাস পূর্ণ হয়। আল্লাহ তায়ালা সকলকে হেফাজত করেন। আমিন।

  • লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *