ইসলামী সামাজিকতার এই রূপ মাদরাসাগুলোরই অবদান: মুফতি সালমান মানসুরপুরী

ইসলামী সামাজিকতার এই রূপ মাদরাসাগুলোরই অবদান: মুফতি সালমান মানসুরপুরী

গত ৯ নভেম্বর’২৩ ভারতের আজমগড়ের মুবারকপুরে ইহইয়াউল উলুম মাদরসায় ইলম ও তালিবুল ইলমের ফযিলত সংক্রান্ত এক সারগর্ভ বয়ান করেন ভারতের প্রখ্যাত মুফতি, দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস মুফতি সালমান মানসুরপুরী হাফিজাহুল্লাহ। বয়ানের সারসংসক্ষেপ পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম এর পাঠকের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে-  

হযরত বলেন-

আমরা সবসময় মাদরাসার অনুষ্ঠানসমূহ এলাকাবাসীর সাথে মিলে মিশে উদযাপন করি। মাদরাসার পক্ষ থেকে যে সমস্ত অনুষ্ঠান করা হয় সেসব অনুষ্ঠান আমরা আয়োজন করি এজন্য যে, যাতে এলাকার মানুষের সাথে আমাদের এই দ্বীনি পরিবেশের সংযোগ সৃষ্টি হয়। সে সাথে আমরা  মাদরাসায় যা সবসময় শিখি ও শিখাই সেটা মহল্লাবাসীকে জানানো।  যাতে তারা এ দ্বীনকে জানতে এবং বুঝতে পারে।

আমরা মাদরাসার ছাত্রদেরকে তাদের কোরআন ও হাদিসের দরস শেষে পাগড়ী দেই এজন্য যে, প্রত্যেকটা মানুষ যাতে বুঝতে পারে যে, তারা কোরআন ও  হাদীস শিখেছে এর মর্যাদা কতখানি এবং সমাজে মানুষের মাঝে তাকে কতটুকু মূল্যায়ন করা হচ্ছে। সেই সাথে যেনো অন্যরাও মাদরাসার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং ঝোঁকে। তাদের সন্তানেরাও মাদরাসায় ইলম হাসীলের মাধ্যমে নিজেদের জীবনের সংশোধনের পথকে বেছে নেয়। এবং এখানে এলাকাবাসীর মাঝে ইসলাহী মেহনতের মেজাজ তৈরী হয়। দ্বীনি আলোচনা হয় যাতে তাদের আমল এবং তরবিয়ত  পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে।

হযরত থানবী রহ. এর একটি বক্তব্য এই যে, হাজার মানুষের সমাগমে যখন দ্বীনি আলোচনা হয় তখন তাদের মধ্য থেকে একজন মানুষও যদি তার জীবনে ইসলামের সঠিক রাস্তায় নিজের জীবনকে পরিচালনা করার জন্য নিজেকে সংশোধনের জন্য মনকে তৈরী করে ফেলে এতেই সেই সমাগমের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যায়।

আবু উমামা রাযি. তার গোত্রের একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। এবং তিনি বাইয়াতে রিদওয়ানের সময়ও উপস্থিত ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁকে সম্মান করতেন। তিনি  ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে যখন তার গোত্রের কাছে ফিরে যান তখন তার গোত্রের লোকেরা তাকে  সামান্য পানি পান করানো থেকেও বঞ্চিত করলো। তিনি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন স্বপ্নে দেখলেন এক ব্যক্তি তাকে এক পেয়ালা দুধ খাওয়ালো আর তিনি সে দুধ পান করে তৃপ্তও হলেন। যখন তার ঘুম ভেঙে গেলো। তিনি দেখলেন তার শরীরের ক্লান্তি নেই এবং তিনি পরিতৃপ্ত অনুভব করছেন। তার গোত্রের কিছু লোক যখন তাকে সাহায্যের জন্য এসে এ ঘটনা শুনলো তখন পরবর্তীতে তারা সহ পুরো গোত্র মুসলমান হয়ে গেলো।

সেই উমামা রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস, তিনি বলেন, ‘একজন আবেদের উপর আলেমের সম্মান তেমন তোমাদের সাধারণ একজনের উপর আমার সম্মান যেমন’।

এ হাদীসের প্রেক্ষাপট হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এক মজলিসে আলেম এবং একজন আবেদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তখন নবীজী এ কথা বলেন।

আমাদের বুঝার বিষয় হলো যে, আলেম এবং আবেদের মধ্যে পার্থক্য কী? আলেম তো তারা যারা এই ইলমকে জেনে বুঝে তার আমল এবং আখলাকে সেই ইলমের প্রতিফলন ঘটাবে। আর আবেদ হলো তারা, যার ফরজ পরিমাণ ইলম আছে। এবং সে ভালো মন্দ পার্থক্য বুঝে দ্বীনের পথে চলতে পারে।

আলেম তো তারা যারা এই ইলমকে জেনে বুঝে তার আমল এবং আখলাকে সেই ইলমের প্রতিফলন ঘটাবে। আর আবেদ হলো তারা, যার ফরজ পরিমাণ ইলম আছে। এবং সে ভালো মন্দ পার্থক্য বুঝে দ্বীনের পথে চলতে পারে।

এখন দ্বীনের ভিত্তি হলো ইলম। আর এই ইলম যার কাছে আছে তার জন্য কুল মাখলুকাতের সবাই রহমতের দোয়া করতে থাকে। এই ইলমের এত সম্মান আল্লাহ রেখেছেন। আর এ ইলম কারো হাতে বা ঘরে অথবা কোনো মানুষের তৈরী সংবিধানের মতো নয়। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এই ইলমকে মানুষের কাছে নাযিল করেছেন। তাই এই ইলমের যথাযথ সম্মান করাই আমাদের কর্তব্য।

দ্বীন হলো এক রশ্মি। এ আলোতেই মানুষকে তার জীবনের পথকে পরিচালিত করতে হবে। এখন যদি ইলমের ধারাবাহিকতা না থাকতো তাহলে এ দ্বীন তার নূর ও তার স্বকীয়তা হারিয়ে যেত। তাই এই মাদরাসাসমূহ এই শেখা ও শেখানোর ধারাবাহিকতাকে বজায় রেখেছে।

আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আল্লাহ তায়ালা এই ইলমকে পাঠিয়েছেন। তার তিনিই এই ইলমকে রক্ষা করবেন। তবে অবশ্যই এই ইলমের মধ্যে মনগড়া কথা ও পরিবর্তনের চেষ্টা করা হবে। এসকল অপচেষ্টাকে উম্মতের মাঝেও ছড়ানোর প্রচেষ্টাকে আল্লাহ পাক আগে প্রতিহত করেছেন এবং করবেন। এবং এই দ্বীন কেয়ামত পর্যন্ত এই ইলমের প্রকৃত রূপে তার আপন ধারায় প্রবাহিত থাকবে।

হাদীসেও এসেছে যে সমস্ত বিষয় দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয় তাকে যদি দ্বীনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা থেকে বাতিল করা হবে।

আমাদের দেশে আসল টাকার পরিবর্তে নকল টাকা ছাপানো হয়। সে টাকা বাজারেও চলে আসে। কিন্তু সেই নোট এক সময় এসে বাজেয়াপ্ত হয়। এসব নকল টাকা বাজারে সবসময়ের জন্য থাকে না। যদি সেই টাকা দেখতেও একই রকম কিন্তু এই টাকার কোনো প্রকৃত মূল্য নয়। আর সরকারের কাছে এ বিষয়ের খবর পৌঁছালে এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। ঠিক তেমনিভাবে কেউ যদি এমন কিছু বিষয় যা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয় সেসব বিষয় অথবা আমলের মূল্য আল্লাহর কাছে মাছির পাখার সমানও নয়।

সঠিক দ্বীনের উপর বাকি থাকাই আমাদের আমলের মূল ভিত্তি। আর এই ভিত্তি বহায় থাকবে মাদরাসার মাধ্যমে। এজন্য আমাদের আকাবিররা এই দ্বীনি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেছেন। এবং এই দ্বীনকে সমুন্নত করতে সকল ধরণের প্রচেষ্টা করেছেন৷ আর আমাদের সমাজে আজকে দাড়ি-টুপিওয়ালা লোক এবং ইসলামী সামাজিকতার রূপ যা আমরা দেখি তা এই মাদরাসা সমূহেরই অবদান। আল্লাহ আমাদেরকে এই দ্বীনের সাথে মৃত্যু অবধি জুড়ে থাকার তাওফিক দান করুন।

 

উর্দু থেকে ভাষান্তর: তামিম আব্দুল্লাহ

সম্পাদনা: আব্দুস সালাম ইবন হাশিম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *