ঈদ অন্বেষণ | আব্দুর রহমান রাশেদ
মোস্তফা সাদিক রাফেঈ। সিরিয়ায় জন্ম নেওয়া বিংশ শতাব্দীর মিশরীয় এক কিংবদন্তী কথাসাহিত্যিক ও দার্শনিক। কুরআনে কারীমের আলঙ্কারিক রহস্য উদঘাটনে বিখ্যাত এক নাম। তার সাহিত্যে শৈলীর অনুকরণে গড়ে ওঠেছে ইরাক, সিরিয়া ও মিশরের অসংখ্য লেখক। রাফেঈর বিখ্যাত প্রবন্ধ সমগ্র ‘ওয়াহইউল কলাম’ থেকে ‘ইজতিলাউল ঈদ’ নামক প্রবন্ধটির অংশ বিশেষ অনুবাদ করেছেন, সাহিত্যানুরাগী আব্দুর রহমান রাশেদ। প্রবন্ধটি পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পাঠকদের জন্য তোলে ধরা হলো—
দীর্ঘ একটি কালাতিবাহিত পর অতি সল্প সময়ের জন্য চলে এসেছে ঈদের দিন। মাত্র একটি দিন। মেয়াদটা যদিও খুব সামান্য, কিন্তু এই স্বল্প মেয়াদটাই মানব অন্তরে কত সুন্দর আনন্দ ও ভালোবাসার জাগিয়ে তোলে। ঈদ মানব অন্তরে শান্তি, আনন্দ, হাসি, বিশ্বস্ততা ও ভ্রাতৃত্বের পয়গাম ফেরী করে। মানুষ একে অপরকে উদ্দেশ্য করে বলে সুখী হও। নতুন পরিচ্ছদে সুসজ্জিত হওয়ার দারুণ সকলের চেহারায় নতুনত্বের এক অভিনব রঙ খেলে যায়।
আচ্ছা, সবাই নতুন পোষাক পরিধান করে কেন জানেন? দুটি কারনে। এক. সুসজ্জার ভালো প্রভাবটা যাতে নিজ অন্তরের উপরেও পড়ে। দুই. সকলেই যাতে আনন্দময় ও ভালোবাসাময় একটি ক্ষণ অতিবাহিত করে। ঈদের দিন সবাই একে অপরকে মিষ্টিমুখ করায়। কেন জানেন? যাতে এর মিষ্টতায় আচার-ব্যাবহার ও মিষ্টিময় হয়ে ওঠে। জীবন কোলাহলের ঊর্ধ্বে গিয়ে, জীবনের সব ঝগড়া-বিবাদ ভুলে গিয়ে, একে অপরকে উদ্যেশ্য করে উচ্চারণ করে দোয়া আশির্বাদ ও অভিভাধনের সব শব্দমালা।
এই দিনে মানুষ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী হিসেবে বিবেচনা করে। বিশাল বিশাল অট্টালিকার চাইতে নিজের ছোট্ট ঘরটিই তার কাছে প্রিয় হয়ে উঠে।বাবা-মা, ভাই-বোন সকলকেই আনন্দে মাতিয়ে রাখে। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি ভালোবাসাময় ও এক বন্ধুত্বপরায়ণ দৃষ্টিতেই অবলকন করে।এর ফলে শত-সহস্র ক্লেষের বিদ্যমানেও পার্থিব এই জীবনটা তার প্রিয় হয়ে যায়।এই জীবন সে আর হারাতে চায় না। সাধের এই পৃথিবী ছেড়ে মন যে যেতে চায় না।
পিতা-মাতা তাদের গায়ে নতুন পোষাক না দেখলে যেন সেই সব সুন্দর পোষাকের সৌন্দর্য পরিপূর্ণতা লাভ করে না।
ঈদটা আসলে কেমন তা জানতে হলে এইসব কচি কচি বাচ্চাদের আমোদ-প্রমোদ দেখুন। যদি ঈদের প্রকৃত রুপ দেখতে চান তাহলে নিষ্পাপ চেহারার শিশুদের ছেলেপনার প্রতি লক্ষ করুন। এই বাচ্চাদের দিকে লক্ষ করুন যারা বিশ্বকে তাদের মায়াবী চাহনীতে জয় করার স্বপ্নে বিভোর,যাদের অশ্রুবিন্দুতে কোন ভারত্ব নেই। ছোট্ট ছোট্ট মুখাবয়বের অধিকারী বাচ্চা শিশু, যারা ভেঙে ভেঙে মাতৃভাষা উচ্চারন করে,তাদের সেই জড়ানো শব্দে ভালোবাসা ও স্নেহে হৃদয়টা পরিপুর্ণ হয়ে যায়। তাদের মাঝেই আমি প্রকৃত ঈদ খুঁজে পাই। এই সমস্ত নিস্পাপ শিশুদের মাঝেই ঈদের প্রকৃত আনন্দের সন্ধান পাই, যারা কেবল হাসি দিয়েই অবস্থার বিচার করে। প্রত্যেকটি শিশু একেকটি রাজ্যের রাজা। আর তাদের রাজ্যের দরবারী বিষয় কেবলই হাসি।বাচ্চারা যখন রঙ বেরঙয়ের কাপড় পরিধান করে একসাথে মিলিত হয়, মনে হয় দিগন্তে রংধনু সাত রঙে দেখা দিয়েছে। পিতা-মাতা তাদের গায়ে নতুন পোষাক না দেখলে যেন সেই সব সুন্দর পোষাকের সৌন্দর্য পরিপূর্ণতা লাভ করে না। নতুন পোষাক পরিধান করার পর মনে হয় যেন এই বাচ্চারাই পৃথিবীর জন্য নতুন এক পোষাকে পরিণত হয়েছে। খুব ভোরেই ওদের ঘুম ভেঙে যায়। যেন ঈদের দিনটি একটি ছোট্ট শিশু যে তাকে খেলার জন্য ডাকছে।এই দিনের ভোর দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের অন্তরে টিকে থাকে। নিষ্পাপ স্বভাবের কারণে জীবনের মিথ্যা কোলাহল থেকে অতি দূরে তাদের বাস।তারাই জীবনের প্রকৃত সুখের সন্নিকটে। ওরা পরোক্ষভাবেই নিয়তি নিয়ে গবেষণা করে। নিয়তির ভিতরে ঢুকে যায় না, যাতে পরে কষ্ট পেতে না হয়।
বাস্তবতা হলো সন্তুষ্ট থাকতে হয় নেয়ামতের প্রশস্ততার দ্বারা, নেয়ামতের পরিমান দ্বারা নয়।
তাদের ধর্ম হলো বস্তুকে নিজদের জন্য সাব্যস্ত করা, নিজেদেরকে বস্তুর জন্য নয়। ওরা অল্পেতুষ্ট, ফল নিয়েই সন্তুষ্ট। গাছ উপড়ে ফেলবার ব্যার্থ প্রচেষ্টা করে না। ওরাই জানে বাস্তবতার মানে কী। বাস্তবতা হলো সন্তুষ্ট থাকতে হয় নেয়ামতের প্রশস্ততার দ্বারা, নেয়ামতের পরিমান দ্বারা নয়। তাদের নিজস্ব একটি বিজ্ঞান আছে,তা হলো ‘উন্নত চিন্তা হলো আনন্দ-উল্লাসকেই ধ্যান-ধারনা হিসেবে নির্ধারণ করা। এবং কাজের সময়ও আনন্দ-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ করা।
ওরা দার্শনিক।আপন কর্মে তাদের দর্শনের উপস্থিতি থাকে।তাদের দর্শন হলো প্রশান্ত চিত্ত বেশি কিছু চায় না’। অন্তরে বেশি জিনিষের চাহিদা না থাকলে অল্পতেই বেশি সুখ অনুভব হয়। যেমন একটি শিশু তার আশেপাশে কত শত সুদর্শনী নারী অবলোকন করে,তবু তার মাকেই সবচেয়ে বেশি আপন মনে করে।যদিও তার মা কুৎসিত হোক না কেন। তার মা-ই তার সবচেয়ে আপন। মায়ের পর এই হৃদয়েই দ্বিতীয় কোন মহিলার স্থান নেই। এতো বেশি মায়ের প্রয়োজন নেই।
এটি একটি গোপন ভেদ। বড়োরা! শিশুদের কাছে তোমরা বিষয়টা শিখো। শিশুদের পরস্পরের মাঝে কখনো কখনো লড়াই ও হয়, সেখানে কোন কিছু ধ্বংস হয় না। কেবল খেলার মধ্যেই সেটা সীমাবদ্ধ থাকে। আর বড়োরা! হাড় মাংসের নরম শরীরকে ধ্বংস করতে লোহা দিয়ে বিরাট বিরাট কামান তৈরী করে।হে চতুষ্পদ জন্তুরা! একদিনের জন্য হলে তোমাদের লাগাম খুলে ফেলো। একটি বছর গর্ভ ধারন করে, অতপর শিশুদের জন্য ঈদের দিনটিকে প্রসব করে, শিশুরা ও নবজাতকের মতন ঈদকে সংবর্ধ্বনা জানায়। ওইদিকে ঈদের দিনটিও যেন এইসব বাচ্চা শিশুদের মিলনে উন্মুখ হয়ে ছিল। হায়!আমাদের বড়োদের জন্য সমবেদনা। আমাদের পাপের বোঝার দরুন আমরা সৃষ্ঠির নিগুঢ় রহস্য থেকে কতই না দূরে। একমাত্র এই মিথ্যা প্রভৃতির কারনেই,যা কিনা কেবলই বস্তুর উপর বিশ্বাসী। আফসোস আমাদের বড়োদের জন্য!আমরা প্রকৃত আনন্দ-উচ্ছাস থেকে কতই না দূরে।
আল্লহর শপথ! আমাদের পাপগুলো একদিন আমাদের আনন্দের সময় লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক