মুফতি মাহতাব উদ্দীন নোমান
কোরবানি আরবি শব্দ ‘কুরবুন; থেকে উদগত। এর অর্থ নৈকট্য লাভ করা নিকটতর হওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয় নির্দিষ্ট মাসের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট প্রাণীকে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে জবেহ করা। আর যেহেতু কোরবানির দ্বারা একমাত্র আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করাই উদ্দেশ্য হয়, এইজন্যই কোরবানিকে কোরবানি বলা হয়।
বস্তুত এটা ইসলামের অনেক বড় একটি আমল এবং গুরুত্বপূর্ণ শিআর-পরিচয় চিহ্ন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘কুরবানীর উট (ও গরু)কে তোমাদের জন্য আল্লাহর ‘শাআইর’ (নিদর্শনাবলি)-এর অন্তর্ভুক্ত করেছি। তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং যখন তা সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়ানো থাকে, তোমরা তার উপর আল্লাহর নাম নাও। তারপর যখন (যবেহ হয়ে যাওয়ার পর) তা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, তখন তার গোশত হতে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও, এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সূরা হজ, আয়াত ৩৬)
কোরবানি যেহেতু ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও শিআর, এইজন্যই কোরবানি শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন ও নৈকট্য লাভের লক্ষ্যেই করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আল্লাহর কাছে না পৌঁছে তাদের (কুরবানীর পশুর) গোশত আর না তাদের রক্ত, বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে। এমনিভাবে তিনি সেগুলো (পশুগুলো) তোমাদের জন্য বশ করে দিয়েছেন। যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। কারণ, তিনি তোমাদের পথপ্রদর্শন করেছেন। আর আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।’ (সূরা হজ, আয়াত ৩৭)
সুতরাং ইখলাস, তাকওয়া এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে না থাকলে আল্লাহ তাআলার কাছে কোরবানির পশুর কোনো মূল্য থাকবে না। কোরবানি কারিও বিন্দু পরিমান সওয়াব পাবে না। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন- ‘আপনি বলে দিন, নিশ্চয় আমার রব আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করেছেন, (যা) বিশুদ্ধ ধর্ম, ইবরাহীমের দ্বীন, যিনি ছিলেন (আল্লাহর আনুগত্যে) একনিষ্ঠ এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানী (ব্যাপক অর্থে সকল ইবাদত), আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি এরই জন্য আদিষ্ট হয়েছি। এবং আমি মুসলিমদের একজন।’ (সূরা আনআম, আয়াত ১৬১-১৬৩)
সুতরাং কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য হলো একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন করা। ইতিহাসে পাওয়া যায়, যারা এই উদ্দেশ্যেই কোরবানি করেছে তাদের কোরবানি আল্লাহ তাআলার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আর যারা এই উদ্দেশ্যে কোরবানি করেনি তাদের কোরবানির প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
কোরবানির প্রথা মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। হাবিল কাবিলের কুরবানী মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানি। কাবিল যখন তার নিজের সহোদর বোনকে বিবাহ করার জন্য হাবিলের সাথে বাকবিতণ্ডে লিপ্ত হয় তখন আদম আ. আল্লাহর নির্দেশে তাদের দুইজনকেই কুরবানী করতে বলেন। হাবিল ভেড়া দুম্বা ইত্যাদি পশু পালন করত, তাই সে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য হাসিলের জন্য একটি উন্নতমানের দুম্বা কোরবানির জন্য পেশ করল। আর কাবিল কৃষি কাজ করতো, তাই সে নিজের বোনকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে কিছু শস্য-গম ইত্যাদি পেশ করল। আসমান থেকে নিয়মানুযায়ী অগ্নিশিখা নেমে এলো এবং হাবিলের কোরবানি টি জ্বালিয়ে দিল। আর কাবিলের কুরবানী যেমন ছিল তেমনি জমিনে পড়ে রইল।
হাবিল কাবিলের এই কোরবানির ঘটনা আল্লাহ তাআলা কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অপরজনের কোরবানি কবুল হলো না। তখন একজন (কাবিল) বলল আমি তোমাকে (হাবিলকে) অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, আল্লাহ খোদাভীরুদের পক্ষ থেকেই (কোরবানি) কবুল করেছেন।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত ২৭)
আয়াতের শেষ অংশে বলা হয়েছে আল্লাহ তাআলা শুধুমাত্র মুত্তাকী ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি কারীদের কোরবানি কবুল করে থাকেন। সুতরাং যারা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করে না তাদের কোরবানি গ্রহণযোগ্য হয় না।
কোরবানির ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও কঠিন পরীক্ষার ঘটনা হলো হযরত ইব্রাহিম আ, কর্তৃক স্বীয় সন্তান ইসমাইলকে কোরবানী করা। হযরত ইব্রাহিম জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়ে দেন নিঃসন্তান অবস্থায়। অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তাআলা তাকে একটি সহনশীল পুত্র সন্তান দান করলেন। লালন পালনের দীর্ঘ কষ্ট সহ্য করার পর যখন শিশু ইসমাইল পিতার আংগুল ধরে চলার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে পুত্রকে কোরবানি করার নির্দেশ এল। ইব্রাহিম আ. নিজের প্রিয় সন্তান শিশু ইসমাইলকে নিয়ে মরুপ্রান্তরে গেলেন এবং নিজের স্বপ্নের কথা এভাবে ব্যক্ত করলেন, ‘হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। তুমি ভেবে দেখো কি করবে?’ (সুরা সাফফাত, আয়াত ১০২)
পিতা ইব্রাহিম যেমন আল্লাহর আদেশ পালনে নিঃস্বার্থবান, ঠিক সন্তান আল্লাহর জন্য কোরবানী হতে দ্ব্যর্থহীন। বাস্তব সত্য হল, এই সময়ে কোন ছেলে বাবাকে এর থেকে উত্তম উত্তর দিতে পারবে না যে উত্তর হযরত ইসমাইল আঃ দিয়েছেন। তিনি নির্ভয় বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, ‘হে পিতা ! আপনাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা আপনি পালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের মধ্যে পাবেন।’
এরপরের ঘটনা আল্লাহর কালাম থেকেই শুনুন, ‘যখন তাহারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করিল এবং ইব্রাহীম তাহার পুত্রকে কাত করিয়া শায়িত করিল, তখন আমি তাহাকে আহ্বান করিয়া বলিলাম, ‘হে ইব্রাহীম! ‘তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করিলে!’-এইভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করিয়া থাকি। নিশ্চয়ই ইহা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাহাকে মুক্ত করিলাম এক কুরবানীর বিনিময়ে।’ (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২-১০৮)
এখানেও কোরবানির মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্য পাওয়া যাওয়ার কারণেই আল্লাহ তা’আলা এই কোরবানিকে কবুল করেছেন। এই কোরবানির সূচনা হযরত আদম আঃ এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের হাতে হয়েছিল। অতঃপর তা আর বন্ধ হয়নি। হযরত ইব্রাহীম আ. ইসমাঈল আ. ইসহাক আ. ইয়াকুব আ. সহ সকল নবী কোরবানি করেছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর নিয়ম করিয়া দিয়াছি; তিনি তাহাদেরকে জীবনোপকরণস্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়াছেন, সেগুলির উপর যেন তাহারা আল্লাহ নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা হজ, আয়াত ৩৪)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা কোরবানির নির্দেশ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করে দিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা কোরবানির নিয়ম শুধু এইজন্য দিয়েছেন যাতে মানুষ আল্লাহ তাআলার দেওয়া চতুষ্পদ প্রাণীর উপর তার নাম উচ্চারণ করতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার সময় যে দোয়া পাঠ করতেন তা এই আয়াতে স্পষ্ট ব্যাখ্যা বহন করে।
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সামনে ঈদুল আযহার দিন দু’টি ভেড়া আনা হয়। তিনি ঐ দুটোকে কিবলামুখী করে পাঠ করেন-
(إنِّي وَجَّهتُ وَجْهي للذي فَطَرَ السَّمواتِ والأرضَ، حَنيفًا مُسلِمًا، وما أنا من المُشرِكينَ، إنَّ صَلاتي، ونُسُكي، ومَحْيايَ، ومَماتي للهِ ربِّ العالَمينَ، لا شَريكَ له، وبذلك أُمِرتُ، وأنا أوَّلُ المُسلِمينَ، بِسمِ اللهِ، واللهُ أكبَرُ، اللَّهُمَّ منكَ، ولكَ عن مُحمَّدٍ، وأُمَّتِه.)
অর্থাৎ আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁর দিকে মুখ ফিরচ্ছি যিনি আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমার নামায, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগত সমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি এটাই আদিষ্ট হয়েছি, অরি আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম। হে আল্লাহ! এটা আপনার পক্ষ হতে এবং আপনার জন্যে মুহাম্মাদের (সাঃ) পক্ষ হতে ও তাঁরই উম্মতের পক্ষ হতে (কুরবানী)। অতঃপর তিনি (بِسمِ اللهِ، واللهُ أكبَرُ) বলে যবাহ করে দেন। (আবু দাউদ, হাদিস নং ২৭৯৫, ইবনে মাযা, হাদীস নং ৩১২১, মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৫০২২)
কিন্তু যুগে যুগে এই কোরবানির মাঝে এসেছে অনেক বিকৃতি। বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে অনেক মানুষ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে বর্বরতার যুগের মানুষেরা আল্লাহকে ভুলে তাদের দেবদেবীর নামে করেছে অনেক অসংখ্য জানোয়ার কোরবানি করেছে। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি না থাকার কারণে এই কোরবানিগুলো বিফলে গেছে। যার বর্ণনা আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমে এভাবে তুলে ধরেছেন- ম;বাহীরাঃ, সাইবাঃ, ওয়াসীলাঃ ও হাম আল্লাহ্ স্থির করেন নাই; কিন্তু কাফিরগণ আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে এবং তাহাদের অধিকাংশই উপলব্ধি করে না।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত ১০৩)
ইসলাম জাহিলি যুগের এসব প্রথাকে বিলুপ্ত করে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘সুতরাং তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।’ (সূরা কাউসার, আয়াত ২)
মুফাসসিরগণ বলেন, এখানে নামাজের সাথে কোরবানি একত্রিত করার মূল উদ্দেশ্য হলো, নামাজ যেমন শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যই পড়া হয়, অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে নামাজ হয় না। ঠিক কোরবানিও একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে, অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে কোরবানি সঠিক হবে না। আর গাইরুল্লাহর নামে কোরবানি করা হলে ঐ কোরবানির গোশত খাওয়াও অবৈধ হবে না।
আরও পড়ুন: সন্তানের জন্মে পরিবারের দায়িত্বঃ ইসলামী দিকনির্দেশনা
‘তোমাদের জন্য হারাম করা হইয়াছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকর-মাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত জন্তু, পতনে মৃত জন্তু, শৃংগাঘাতে মৃত জন্তু এবং হিংস্র পশুতে খাওয়া জন্তু; তবে যাহা তোমরা যবেহ্ করিতে পারিয়াছ তাহা ব্যতীত, আর যাহা মূর্তি পূজার বেদীর উপর বলি দেওয়া হয় তাহা এবং জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করা-এই সব পাপকাজ।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত ৩)
অতএব কোরবানি একটি মহান ইবাদত। কোন গোস্ত খাওয়ার অনুষ্ঠান বা উৎসব না। তাই এই মহান এবাদতকে আমাদের ইখলাস ও একনিষ্ঠতা সাথে পালন করা প্রয়োজন। অন্যথায় এর ক্ষতি ও শাস্তি আমাদেরই ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে এখলাসের সাথে কোরবানি করার তৌফিক দান করুন আমিন।
লেখক: খতীব ও শিক্ষক