ঈদ পর্যবেক্ষণ : মুস্তফা সাদিক আর-রাফিঈ

ঈদ পর্যবেক্ষণ : মুস্তফা সাদিক আর-রাফিঈ

• • •

এলো ঈদের দিন। সময়ের একটি আবর্ত থেকে বের হয়ে আরেকটি আবর্তে প্রবেশের দিন। যে দিনটি এক দিনের বেশি স্থায়ী হয় না।

মেয়াদটা যদিও সামান্য, তবুও তা কত আনন্দ-উল্লাসে ভরা! ধর্ম এই বিধান জারি করেছে মনুষ্য সমাজের উপর। যেন, নিজ গতি-প্রকৃতি থেকে ছিটকে পড়া এই জীবন-সংসার মাঝে মাঝে একটু প্রকৃতিস্থ হতে পারে। ফিরতে পারে তার আদিম অকৃত্রিমতায়।

এটি অভিবাদনের দিন, হাসি-আনন্দ, ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বস্ততার দিন। একে অপরকে বলার দিন— ‘আপনি সুখী হোন।’ এই দিন নতুন আবরণে সজ্জিত হওয়ার দিন। যেন বুঝা যায়, মনুষ্য ‘রূপের’ আজ ঘটেছে নবায়ন।

এই দিন সজ্জার দিন। এই সজ্জার উদ্দেশ্য, এর চিহ্নটা যেন নিজ আত্মার মাঝেও প্রতিফলিত হয়। ফলে মানুষে মানুষে এক ভালোবাসাময় দিবসে উপনীত হয়।

ঈদের দিন মানুষ একে–অপরকে মিষ্টিমুখ করায়। যেন এর মিষ্টতায় মানুষের মুখের ভাষা ও আচার-ব্যবহারও মিষ্টিময় হয়ে ওঠে। জীবন-কোলাহলের ঊর্ধ্বে গিয়ে, জীবনের সব ঝগড়া-বিবাদ ভুলে গিয়ে, একে অপরকে উদ্যেশ্য করে উচ্চারণ করে দোয়া, আশির্বাদ ও অভিবাদনের সব শব্দমালা।

এই দিনে মানুষ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী হিসেবে বিবেচনা করে। বিশাল বিশাল অট্টালিকার চাইতে নিজের ছোট্ট ঘরটিই তার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। বাবা-মা, ভাই-বোন সকলকেই আনন্দে মাতিয়ে রাখে। সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের প্রতি ভালোবাসাময় ও এক বন্ধুত্বপরায়ণ দৃষ্টিতেই অবলোকন করে। এর ফলে শত-সহস্র ক্লেষের হাজিরিতেও পার্থিব এই জীবনটা তার প্রিয় হয়ে যায়। এই জীবন সে আর হারাতে চায় না। সাধের এই পৃথিবী ছেড়ে মন নাহি যেতে চায়।

এই দিনের ভোর, দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের অন্তরে টিকে থাকে

ঈদটা আসলে কেমন তা জানতে হলে এইসব কচি কচি বাচ্চাদের আমোদ–প্রমোদ দেখুন। যদি ঈদের প্রকৃত রুপ দেখতে চান, তাহলে নিষ্পাপ চেহারার শিশুদের ছেলেপনার প্রতি লক্ষ করুন। এই বাচ্চাদের দিকে লক্ষ করুন, যারা বিশ্বকে তাদের মায়াবী চাহনীতে জয় করার স্বপ্নে বিভোর। যাদের অশ্রুবিন্দুতে কোন ভারত্ব নেই। ছোট্ট ছোট্ট মুখাবয়বের অধিকারী বাচ্চা শিশু, যারা ভেঙে ভেঙে মাতৃভাষা উচ্চারন করে, তাদের সেই জড়ানো শব্দে ভালোবাসা ও স্নেহে হৃদয়টা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তাদের মাঝেই আমি প্রকৃত ঈদ খুঁজে পাই।

এই সমস্ত নিস্পাপ শিশুদের মাঝেই ঈদের প্রকৃত আনন্দের সন্ধান পাই, যারা কেবল হাসি দিয়েই অবস্থার বিচার করে। প্রত্যেকটি শিশু একেকটি রাজ্যের রাজা। আর তাদের রাজ্যের দরবারী বিষয় কেবলই হাসি।

বাচ্চারা যখন রঙ-বেরঙয়ের কাপড় পরিধান করে সম্মিলিত হয়, মনে হয় দিগন্তে রংধনু সাত রঙে উদিত হয়েছে। পিতা-মাতা তাদের গায়ে নতুন পোষাক না দেখলে যেন সেই সব সুন্দর পোষাকের সৌন্দর্য পরিপূর্ণতা লাভ করে না। নতুন পোষাক পরিধান করার পর মনে হয় যেন এই বাচ্চারাই পৃথিবীর জন্য নতুন এক পোষাকে পরিণত হয়েছে।

খুব ভোরেই ওদের ঘুম ভেঙে যায়। যেন ঈদের দিনটি একটি ছোট্ট শিশু, যে তাকে খেলার জন্য ডাকছে। এই দিনের ভোর, দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের অন্তরে টিকে থাকে। নিষ্পাপ স্বভাবের কারণে জীবনের মিথ্যা কোলাহল থেকে অতি দূরে তাদের বসবাস। তারাই জীবনের প্রকৃত সুখের সন্নিকটে। ওরা পরোক্ষভাবেই নিয়তি নিয়ে গবেষণা করে। নিয়তির ভিতরে ঢুকে যায় না, যেন পরে কষ্ট পেতে না হয়।

বাস্তবতা হলো, সন্তুষ্ট থাকতে হয় নেয়ামতের প্রশস্ততার দ্বারা, নেয়ামতের পরিমান দ্বারা নয়

শিশুদের ধর্ম হলো বস্তুকে নিজের জন্য সাব্যস্ত করা, নিজেকে বস্তুর জন্য নয়। ওরা অল্পেতুষ্ট। শুধু ফলটি পেলেই সন্তুষ্ট। গাছ উপড়ে ফেলবার খারাপ প্রচেষ্টা তারা করে না।

ওরাই কেবল জানে বাস্তবতার মানে কী। বাস্তবতা হলো, সন্তুষ্ট থাকতে হয় নেয়ামতের প্রশস্ততার দ্বারা, নেয়ামতের পরিমান দ্বারা নয়। তাদের নিজস্ব একটি দর্শন আছে,তা হলো— ‘উন্নত চিন্তা হলো, আনন্দ-উল্লাসকেই ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে নির্ধারণ করা, এবং কাজের সময়ও আনন্দ-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।

ওরা দার্শনিক। আপন কর্মে তাদের দর্শনের উপস্থিতি থাকে। তাদের দর্শন হলো ‘প্রশান্ত চিত্ত বেশি কিছু চায় না।’ অন্তরে বেশি জিনিসের চাহিদা না থাকলে অল্পতেই বেশি সুখ অনুভব হয়। যেমন একটি শিশু, তার আশেপাশে কত শত সুদর্শনা নারী অবলোকন করে,তবু তার মাকেই সবচেয়ে বেশি আপন মনে করে। যদিও তার মা কুৎসিত হয় না কেন। তার মা-ই তার সবচেয়ে আপন। মায়ের পর এই হৃদয়ে দ্বিতীয় কোনো মহিলার স্থান নেই। একাধিক মায়ের প্রয়োজন নেই।

এটি একটি গোপন ভেদ। বড়রা! শিশুদের কাছে তোমরা বিষয়টা শিখো। শিশুদের পরস্পরের মাঝে কখনো কখনো লড়াইও হয়, তবে সেখানে কোন কিছু ধ্বংস হয় না। কেবল খেলার মধ্যেই সেটা সীমাবদ্ধ থাকে। আর বড়রা! হাড়-মাংসের নরম শরীরকে ধ্বংস করতে লোহা দিয়ে বিরাট বিরাট কামান তৈরী করে।

হে চতুষ্পদ জন্তুরা! একদিনের জন্য হলেও তোমাদের লাগাম খুলে ফেলো। বছর গর্ভ ধারণ করে, অতঃপর শিশুদের জন্য ঈদের দিনটিকে প্রসব করে। শিশুরাও নবজাতকের মতো ঈদকে সংবর্ধনা জানায়। ওদিকে, ঈদের দিনটিও যেন এইসব শিশুদের মিলনে উন্মুখ হয়ে ছিল।

হায়! আমাদের বড়দের জন্য সমবেদনা। আমাদের পাপের বোঝার দরুন আমরা সৃষ্টির নিগূঢ় রহস্য থেকে কতই না দূরে। একমাত্র এই মিথ্যা প্রভৃতির কারনেই, যা কিনা কেবলই বস্তুর উপর বিশ্বাসী। আফসোস আমাদের বড়দের জন্য! আমরা প্রকৃত আনন্দ-উচ্ছ্বাস থেকে কতই না দূরে।

আল্লাহর শপথ! আমাদের পাপগুলো একদিন আমাদের আনন্দের সময় লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

 

লেখক : মিশর ও তিউনিসিয়ার জাতীয় সংগীত রচয়িতা

অনুবাদক : প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

সম্পাদক : আরবী ভাষা ও সাহিত্যালয় ‘আত তুরাস একাডেমী’–এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *