ঈমান না থাকলে মানুষ হয়ে জন্মানোই বৃথা: মাওলানা মাহমুদ মাদানী

ঈমান না থাকলে মানুষ হয়ে জন্মানোই বৃথা: মাওলানা মাহমুদ মাদানী

রাজধানী ঢাকার আফতাব নগরের আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া ইদারাতুল উলূম মাদরাসা মসজিদে তিন দিন (১-৪ রমজান) নফল ই’তিকাফে বসেছেন জানেশীনে ফিদায়ে মিল্লাত, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপিত, ভারত উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক রাহবার, মাওলানা সায়্যিদ মাহমুদ আসআদ মাদানী।
বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) তৃতীয় রমজানে তারাবিহর পর নফল ইতিকাফরত আলেম-উলামা ও সাধারণ মুসল্লিদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেন তিনি। পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পাঠকদের জন্য বয়ানের সারাংশের অনুবাদ তুলে ধরা হলো–

ঈমানের দৌলত সমস্ত নেআমতের পরিপূরক

সম্মানিত উপস্থিতি ও সুপ্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ!
আল্লাহ তাআলা তাঁর অগণিত মাখলুকাতের মধ্যে কেবল আমাদেরকেই মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। এমনকি মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করার মধ্যেও কোনো অসম্পূর্ণতা রাখেননি। দেখার জন্য চোখ, শোনার জন্য কান, বলার জন্য যবান দিয়েছেন। এতো এতো নেআমত দিয়েছেন যা গণনা করে শেষ করা যাবে না।

সবশেষে ঈমানের দৌলত দিয়ে সেই নেআমতকে পরিপূর্ণ করেছেন। যদি ঈমান না থাকতো, তাহলে আমাদের মানুষ হয়ে জন্মানো বৃথা যেতো। আমরা যদি গাধা, ঘোড়া, কুকুর বা অন্য কোনো জন্তু হতাম, তাহলে কোনো প্রশ্নই ছিলো না। কিন্তু মানুষ হিসেবে সৃষ্টি হওয়ার পর ঈমান না থাকলে বিরাট প্রশ্ন রয়ে যায়। আমাদের চেয়েও অনেক মেধাবী ও প্রতিভাবান মানুষ আছে যাদের ঈমান নেই। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের ঈমানের মতো দৌলত আছে। এছাড়া আমাদের আর বেশি কিছু নেই।

মুমিনের চূড়ান্ত তামান্না ঈমানের উপর মরণ

ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকবো এবং ঈমানের সাথে ইন্তেকাল করবো—ব্যস, এতুটুকুই আমাদের চাওয়া। প্রত্যেক মুমিনের এটাই আকাঙ্খা হওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা নিজ দয়ায় আমাদেরকে ঈমানের মতো দৌলত দিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা যেন তার অনুগ্রহেই ঈমানের সাথেই আমাদের মৃত্যু দেন—এটাই প্রতিটি মুমিনের চূড়ান্ত তামান্না হওয়া উচিত।

বলা হয়ে থাকে, জীবন যেমন হবে মৃত্যু তেমনি হবে, আর মৃত্যু যেমন হবে আখিরাত তেমনি হবে। যদি সঠিকভাবে জীবন যাপন করে থাকেন, তাহলে মৃত্যুও সুন্দরভাবে হবে।

ভুল তো মানুষই করে

ভুল করে ফেলা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব, কিন্তু গুনাহের সাথে আঠার মতো লেগে থাকা, তওবা না করা শয়তানের স্বভাব। এটাই মানুষ আর শয়তানের মাঝে পার্থক্য। মানুষ হলে সে অবশ্যই ভুল করবে। কেবল আম্বিয়ায়ে কেরাম গুনাহ থেকে মুক্ত। তারা নিষ্পাপ। তাদেরকে আল্লাহ তাআলা নিজ গুণে হেফাজত করেছেন।

মানুষের কাছ থেকে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ভুল থেকে ফিরে আসার চেষ্টা না করা, তওবা না করা খারাপ বিষয়। তওবা করার আগে আল্লাহর কাছে একজন গুনাহগার বান্দার যে অবস্থান থাকে, তওবা করার পর আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। তাই গুনাহ করে ফেললে কখনো নিরাশ হয়ে যাবেন না। চেষ্টা করে যাবেন। আল্লাহ তাআলা মাফ করে দিবেন।

আরো পড়ুন:শরীর নয়, রূহ-ই হলো আসল মানুষ : মাওলানা মাহমুদ মাদানী 

পরবর্তী প্রজন্মের ঈমান বাঁচাই

আমাদের বংশধরদের ঈমান বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। যদি আমরা আমাদের বংশধরদের ঈমান বাঁচাতে না পারি, তাহলে আমরা নিজেরা কি ঈমানের উপর ইন্তেকাল করতে পারবো কি পারবো না এটারও নিশ্চয়তা নেই।

আমি এটা বুঝি যে, জীবন যেমন হবে, মৃত্যু তেমনি হবে। কিন্তু জীবন কেমন হবে তার জন্য কিছু নীতিমালা আছে। সেগুলোর মধ্যে সবার প্রথম নীতি হলো আপনি আপনার বংশধরদের ব্যপারে কী ভেবেছেন, কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? তারা কী আল্লাহ কে মানে কি মানে না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মানে কি মানে না?

বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুকে দীন শিখার ব্যাবস্থা করুন

মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা ফরযে কিফায়া। বুখারী শরীফ পড়ানো ফরযে কিফায়া। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুকে দীনের ইলম শেখানো ফরযে আঈন। ভালো করে শুনুন, বুঝুন। যদি আমরা নিজেদেরকে নবীর ওয়ারিস হিসেবে দাবী করি, তাহলে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুকে ফরযে আঈন পরিমাণ দীনের ইলম শেখানো আমাদের জন্য ফরযে আঈন। সেজন্য প্রয়োজনীয় কার্যপদক্ষেপ গ্রহণ ও সে মোতাবেক প্রচেষ্টা করাও ফরযে আঈন। একজন মুসলমানের জন্য দীনের যে পরিমাণ ইলম শিক্ষা গ্রহণ ফরযে আঈন, আলেম হিসেবে সে পরিমাণ ইলম শিখানোও আমাদের জন্য ফরযে আঈন। তারচেয়ে বেশি পড়ানো ও পড়ানোর ব্যবস্থা করা ফরযে কিফায়ার পর্যায়ে।

যারা মক্তবে পড়ান তারা আল্লাহর পছন্দের মানুষ

যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেননি, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা ফরযে কিফায়া ছিলো। কিন্তু যখন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন, তখন মাদ্রাসাকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করা ফরযে আঈন হয়ে যায়। ফরযে কিফায়া কী কারণে ফরযে আঈন হয়ে যায়? কারণ যাতে এমন লোক তৈরী হতে পারে যারা ফরযে কিফায়া অর্থাৎ মক্তবের শিক্ষাকে পরিচালনা করতে পারে। আমি দাবি করে বলতে পারি, যারা মক্তবে পড়ান, যারা মক্তব পরিচালনা করেন, যারা মক্তবের জন্য জানমাল দিয়ে চেষ্টা করেন, তারা সকলেই আল্লাহর পছন্দনীয় লোক। যারা হাদীস পড়ান তাদের ব্যপারে সম্ভাবনা আছে তারা আল্লাহর পছন্দনীয় ব্যক্তিদের মধ্যে হবেন, কিন্তু যারা মক্তবে পড়ান, তাদের ব্যপারে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তারা অবশ্যই আল্লাহর পছন্দনীয়। তারা লোকদের মুরতাদ হওয়া থেকে বাঁচান। তারা এমন কিছু শেখান যা সকলের জন্য শেখা আবশ্যক। হাদীসের জ্ঞান অর্জন কিন্তু সকলের জন্য আবশ্যক নয়।

দীনের যে পরিমাণ জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুমিনের জন্য ফরজ, সে পরিমাণ দীনের ইলম অন্যকে শেখানোও প্রত্যেক মুমিনের উপর ফরজ। কতো বড়ো দায়িত্ব আমাদের উপর! কেউ আপনার এই দায়িত্ব পালন করে দিবে না। আপনি যদি এই দায়িত্ব পালণ না করেন, তাহলে আপনার জন্য রয়েছে শাস্তি। অন্যরা এই দায়িত্ব পালণ না করলে সাজা পাবে না। কিন্তু আপনি যদি আলেম হোন, আপনি যদি এসব নিয়ে চিন্তা না করেন, তাহলে অন্যরা চিন্তা করবে না আপনার হয়ে। মুমিন হলে নিজের পরিবার-পরিজনকে দীনের প্রয়োজনীয় ইলম শেখানো ফরজ। না করলে শাস্তি। আর আলেম হিসেবে পুরো জাতি নিয়ে চিন্তা ও প্রচেষ্টা করতে হবে। না করলে শাস্তি।

আরো পড়ুন:  জিকিরে অহঙ্কার দূর হয়, হৃদয় হয় পরিশুদ্ধ : মাওলানা মাহমুদ মাদানী

সফল হতে হলে চাই সুবিন্যস্তভাবে কাজ করা

সফল হওয়ার জন্য যেকোনো কাজ সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে করতে হবে। তাহলে কাজের সুফল ভোগ করা যায়। আর আল্লাহ তাআলা সেই কাজ বেশি পছন্দ করেন যেই কাজ সুচারূভাবে সম্পাদিত হয়।

যারা মনে করে, আলেমগণ বেতনের জন্য কাজ করেন তারা ভ্রান্তিতে আছে। তারা যেন নিজেদের ঠিক করে নেয়। আমরা কাউকে বেতন ছাড়া কাজ করতে দেবো না। এ পথেই চলবো আমরা। মূলত, আলেমগণ বেতনের জন্য কাজ করেন না। আলেমনগণ তো আম্বিয়ায়ে কেরামের মিশন পূরণের জন্য কাজ করেন।

মক্তব শিক্ষার ধারাকে সুন্দরভাবে সাজাতে হবে। বাচ্চাদের তারবিয়াত করার কাজ উত্তমভাবে আঞ্জাম দিতে হবে। পুরোদস্তুর সিলেবাস বানাতে হবে।

বাংলাদেশের আলেমদের প্রতি আহবান

বাংলাদেশের আলেমদের মাঝে অনেক সম্ভাবনা আছে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের আলেমগণ ইচ্ছা করলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে শতভাগ শিশুকে দীনের ইলম শেখানো সম্ভব। এই সূদূর প্রসারী কাজ আঞ্জাম দিতে প্রয়োজনে আমরা আপনাদের সাহায্য করতেও রাজি আছি। আমরা আমাদের দেশে যেভাবে কাজ করে থাকি, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় তিন-চার’শ আলেমকে সেভাবে ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা আমরা করতে পারি ইনশাআল্লাহ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *