উস্তাদে মুহতারাম মুফতী পালনপুরি রহ. এর সান্নিধ্যে কিছু স্বর্ণসময় | ফয়জুল্লাহ আমান

উস্তাদে মুহতারাম মুফতী পালনপুরি রহ. এর সান্নিধ্যে কিছু স্বর্ণসময় | ফয়জুল্লাহ আমান

উস্তাদে মুহতারাম মুফতী পালনপুরি রহ. এর সান্নিধ্যে কিছু স্বর্ণসময় | ফয়জুল্লাহ আমান

কয়েকদিন আগেই অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে গেলেন। এর আগে রমজানের শুরু থেকেই হযরতের বয়ান আসছিল আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। অতি চেনা সেই কণ্ঠস্বর শুনতাম মাঝে মাঝে। খুবই আশা করছিলাম দ্রুতই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আবারও তাঁর ইলম থেকে উপকৃত হবার সৌভাগ্য অর্জন করব। কিন্তু আজকে সকালে ঘুম ভাঙ্গল ফোনে হযরতের ইন্তিকালের দুঃসংবাদ শোনে। ভারত থেকেও পরিচিত জনরা যোগাযোগ করে হযরতের মৃত্যুর খবর জানাচ্ছে। সকালে আর ঘুমাতে পারলাম না। উঠে কোরআনে কারীম তেলাওয়াত শুরু করলাম। উস্তাদে মুহতারামের জন্য কিছু ইসালে সাওয়াব করতে হবে।

প্রথম দেখেছিলাম সম্ভবত মেশকাতের বছর। প্রথম যে আলোচনা তাঁর মুখে শুনেছিলাম সে স্মৃতি আজও ভুলতে পারি না। এত সুন্দর করে কথা বলতেন তিনি। বোঝানোর বিস্ময়কর এক প্রতিভা ছিল তাঁর। কোরআন হাদীসের জটিল জটিল বিষয় জলের মত সহজ করে উপস্থাপন করতে পারতেন।

দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হলাম। দারুল উলুম দেওবন্দে তালিবুল ইলম থাকা কালে পালনপুরি রহ.-এর দরস ছিল অন্যদের মত আমার কাছেও দেওবন্দের প্রধান আকর্ষণ। অন্য কোনো দরস কখনও কখনও ছুটে গেলেও পালনপুরি সাহেব রহ.-এর দরস একেবারেই ছুটত না। সারা বছরে হযরতের কয়টা দরস বাদ পড়েছে তা হাতে গুণে বলে দিতে পারব যেন।

একদিন মনে পড়ে সাহারানপুর গিয়েছিলাম শাইখ ইউনুস সাহেবের দরসে বসার জন্য। সাহারানপুরের একজন খুব অবাক হয়ে আমাকে বলল, পালনপুরি সাহেবের দরস বাদ দিয়ে তুমি এসেছ সাহারানপুরে? আমি খুবই লজ্জিত হলাম। সত্যি তার পাঠদান পদ্ধতির কোনো তুলনা ছিল না। এত গোছালো এবং সুন্দর করে তিনি উপস্থাপন করতেন। এমন ভরাট কণ্ঠ আর গাম্ভীর্যপূর্ণ দরস। এখনও স্বাদ অনুভব করি।

দরসের পর হযরত যখন বাসার দিকে যেতেন আমি পথেও প্রশ্ন করতাম। এতে তিনি বিরক্ত হলেও আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেন। দরসে একদিন বললেন, এত দীর্ঘ সময় দরস করার পর ঘরে ফেরার সময় পথে প্রশ্ন না করে অন্য সময় আসবে। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন হযরতের বাসায় যেতাম।

দেওবন্দের মাশায়েখদের ভেতর দুজনের মজলিসে সবচেয়ে বেশি বসা হতো। বাদ ফজর ফেদায়ে মিল্লাত সায়্যিদ আসআদ মাদানী রহ.-এর খানকায়। বাদ আসর মুফতী পালনপুরির মজলিসে। আসর বাদ মাঝে মাঝে অন্য মাশায়েখদের মজলিসেও যেতাম।

আমার ছিল খুব প্রশ্ন করার বদ অভ্যাস। একটা কিছু না বুঝলে যে করে হোক হল করতেই হবে এমন এক মানসিকতা ছিল। খুব সাহস করে শাইখদেরকে জিজ্ঞেস করতাম।

একবারের কথা মনে আছে। তিরমিযি শরীফের একটি হাদীসের উস্তাদে মুহতারাম যে ব্যাখ্যা করেছেন সে ব্যাখ্যায় আমার তৃপ্তি হল না। বিকেলে ভাবগম্ভীর সেই ভরা মজলিসে ইশকাল করলাম। হযরত উত্তর দিলেন। হযরতের জবাবের উপর আবার ইশকাল করলাম। তিনি ধৈর্য ধরে উত্তর দিলেন। আমি আবার ইশকাল করলাম। এভাবে দীর্ঘ সময় চললো।

অবশেষে আমাকে হার মানতে হলো। আমার যুক্তিতর্ক ফুরিয়ে গেল। তার জ্ঞানের গভীরতা দেখে বিস্ময়াভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় থাকলো না। হযরতও খুব খুশি হলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে খুব তৃপ্তির সাথে বললেন, তেরা ইলম কা উমর কেতনা হ্যায়? তোমার ইলমের বয়স ক’ বছর? বেশি থেকে বেশি পাঁচ ছ বছর? আমার ইলমের বয়স ষাট বছর। বলে মুচকি হাসলেন। তারপর আমার কৌতুহলের প্রশংসা করলেন। বললেন, ইলম হচ্ছে কূলহীন সমুদ্রের মত, মুতালা করতে থাকো।

এ ঘটনা দেওবন্দে আমার প্রথম দিককার। এরপর দুই বছর প্রায়শই যেতাম উস্তাদে মুহতারামের মজলিসে। আমাদের মুতালার জন্য উৎসাহিত করতেন। নিজের জীবনের গল্প শোনাতেন। ফারেগ হবার পর আট বছর ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন কোনো না কোনো আরবি কিতাবের ৫০০ পৃষ্ঠা মুতালা দেখতেন। এভাবে ৮ বছর প্রতিদিন মুতালা দেখেছেন।

দারুল উলুম দেওবন্দের দাওরায়ে হাদীস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলাম। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী আমার উপর। উস্তাদে মুহতারাম ডেকে খোঁজ খবর নিলেন। আমাকে দেখেই চিনলেন। বললেন, তুমি তো সব সময় ঝঝকতে রাহতে হো? জিজ্ঞেস করলেন, সেকেন্ড যে হয়েছে সে তোমার থেকে কয় নম্বর পেছনে? বললাম, দু নম্বর। বললো, তাহলে তো খুব একটা ভালো করনি। দু নম্বরের ব্যবধান তো খুব কিছু নয়।

উস্তাদে মুহতারাম প্রত্যেক বছরই দাওরায়ে হাদীসের সিরিয়ালের ছাত্রদের বিশেষ পুরস্কৃত করতেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী পুরস্কার নিবে? তোমার কি কিতাব দরকার?

দারুল ইফতার কয়েকজন বড় ভাই আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, তুমি হযরতের লেখা কিতাবগুলো পুরস্কার দিতে বলবে। আমি নির্বোধের মত বললাম, না হযরতের কিতাবগুলো নিজেই কিনে সংগ্রহ করব। তাই হযরতের কাছে ফতোয়ার কিছু কিতাবের নাম বললাম। উস্তাদে মুহতারাম কিতাবের নামগুলো লিখে রাখলেন। সেই পুরস্কারগুলো এখনও আমার সযেত্ন সংগ্রহে আছে।

দেখতে দেখতে দুটি বছর কেটে গেল। তাকমিলুল ইফতার বছরও তিরমিযির দরসে বসতাম মাঝে মাঝে। কখনও কখনও হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার দরসেও বসেছি।

সেবার রমজানের আাগেই হযরত আমেরিকা চলে যাবেন। ল-ন আমেরিকা ও কানাডায় রমজান কাটাতেন হযরত। হযরতের ছাত্রদের দাওয়াতে পশ্চিমে তিনি ইসলাহি প্রোগ্রাম করতেন। দেখা করতে গেলাম শেষ দিন। অনেক নসিহত করলেন। বিদায়ের সময় খুব কেঁদেছিলাম।

হযরত আমেরিকা যাবার কিছু দিন পরই আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম। দেওবন্দ থেকে ফিরে তাবলিগের সালে বের হলাম। উস্তাদে মুহতারাম শুনে দেওবন্দের দারুল হাদীসে তিরমিযির দরসে বসে নাকি বলেছেন, ‌‌‌‌‌‘ফয়জুল্লাহ আমান বাংলাদেশিনে সাল মে নিকলে, মাই ক্যাহ রাহাহু ও দশ সাল পিছে পড় গায়া।’

আমাদের অনেক বন্ধু সরাসরি হযরতকে একথা বলতে শুনেছেন দেওবন্দের দরসগায়। আমি সালে থাকতেই হযরতের এ কথা শুনেছি। শুনে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ মুরুব্বিদের কথা লেগে যায়। আমার ইলমি উরুজ থেমে না যায়! সালের বছরটা তাবলিগে থাকলেও প্রচুর কিতাবাদি মুতালা দেখেছি। যার কারণে তাবলিগের মেহনতে অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে।

হযরতের কথাটাও বাস্তব জীবনে উপলব্ধি করেছি। তাবলিগে গিয়ে আমল ও দাওয়াতের লাইনের অনেক ফায়দা হলেও কিতাবাদির চর্চায় পিছিয়ে গিয়েছিলাম। যে গতিটা ছাত্র যামানায় ছিল তা ফিরে পেতে অনেকটা সময় লেগে গেছে। তবু ভালো লাগত প্রিয় উস্তাদের মুখে আমার নাম উচ্চারণ হয়েছে। এটা আমার জন্য গৌরবের বিষয় ছিল।

সামান্য দুটি বছর তার সান্নিধ্য পেলেও আমার ইলমি অগ্রগতির পেছনে তার অবদান কম নয়। আমার মত এমন অসংখ্য আলেম তালেবে ইলম তার ফুয়ুজ ও বারাকত লাভে ধন্য হয়েছে।

দেখতে দেখতে একযুগ পার হয়ে গেল। কয়েক বছর আগে দারুল উলুমে গেলাম প্রায় একযুগ পর। বন্ধুবর মুফতী নুমান সিতাপুরি আমাকে হযরতের বাসায় নিয়ে গেলেন। আসর বাদ আম মজলিস হতো হযরতের বাসায়। দীর্ঘ দিন ধরে যে সব জটিল ইলমি প্রশ্ন ছিল তা তুলে ধরলাম। একেক করে হযরত উত্তর দিলেন।

পাঠকের জন্য সেই মজলিসের একটি বিষয় তুলে ধরছি। বুখারী শরীফে তারাবির নামাজের ব্যাপারে হযরত উমরের একটি উক্তি রয়েছে, হযরত উমর রা. বলেন, তোমরা তারাবির নামাজ পড়ছ খুব ভালো কথা, কিন্তু তাহাজ্জুদ নামাজ না পড়ে তো ঘুমিয়ে থাক, অথচ তাহাজ্জুদ নামাজ তারাবির চেয়ে অধিক ফজীলতপূর্ণ। আমি হযরতকে জিজ্ঞেস করলাম, হযরত তারাবি তো সুন্নাতে মুআক্কাদা, তাহাজ্জুদ হচ্ছে নফল তাহলে সুন্নাতের চেয়ে নফল শ্রেষ্ঠ হয় কী করে?

উস্তাদে মুহতারাম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, কিছু কিছু নফল ওয়াজিবের চেয়ে বেশি ফজীলতপূর্ণ হয়। এরপর সালামের দৃষ্টান্ত দিলেন। সালাম দেওয়া সুন্নত কিন্তু সালামের জবাব ওয়াজিব; অথচ প্রথম সালাম দেয় যে তার সওয়াব বেশি।

এমন সুন্দর উত্তর শুনে আমি বলে ফেললাম, হযরত! এত সুন্দর সমাধান কোনো কিতাবে তো নেই। হযরত সাথে সাথেই বললেন, সব যদি কিতাবে থাকবে তাহলে রিজালের আর কী প্রয়োজন?

এরপর বললেন, সুন্নাতে মুআক্কাদা অর্থ কী? নিজেই উত্তর দিলেন- যে আমল রাসূল সা. সবসময় তাকিদের সাথে করেছেন। তারাবির নামাজ এ অর্থে সুন্নাতে মুআক্কাদ নয়, কারণ রাসূল সা. সারা জীবনে কয়েকদিন তারাবি পড়েছেন মাত্র। তারাবির নামাজ মুআক্কাদা উম্মতের আমলে মুতাওয়ারিসার কারণে।

সেদিন আসর থেকে মাগরিব ইলমি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছিলেন। মাগরিবের পর আবারও বসতে বললেন। মেহমানদারিও করিয়েছিলেন। এশার সময় যখন বিদায় নিব তখন বললেন, দেওবন্দ যে কদিন আছ এখানে এসো। মুফতী নুমান ভাই বললেন, কাল সকালেই চলে যাবেন ফয়জুল্লাহ ভাই। শুনে বিদায় দিলেন।

এরপর গত বছর আবার দেওবন্দ গিয়েছিলাম। এবার তিনি অসুস্থ থাকায় বেশি সময় কথা বলার সুযোগ হয়নি। সালাম করেই চলে আসতে হয়েছিল।

আমার পাসপোর্টে ভিসা লেগে আছে। ইচ্ছা ছিল করোনার দিন শেষ হলেই আবারও ভারত সফর করব। হযরতুল উস্তাদের সান্নিধ্য সন্তর্পণে ধন্য হবো। আহ, সেই সৌভাগ্য আর হবে না। ভাবতেই পারছি না ইলমের সাগর এই মহান মনীষীকে আর কখনও দেখতে পাব না। আর কষ্ট লাগছে, হয়ত তার কবর যিয়ারতেরও সুযোগ হবে না আমাদের।

দারুল উলুম দেওবন্দ তো আমাদের যেতেই হয়। মাকবারায়ে কাসেমির যিয়ারত করা হয় দেওবন্দ গেলে। দুঃখজনক হচ্ছে হযরতের কবর দেওয়া হচ্ছে বোম্বে। যেখানে মৃত্যু সেখানেই কবর দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব কঠোর। ফেদায়ে মিল্লাত রহ.-এর দাফনের সময় হযরত পালনপুরি তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। দিল্লি থেকে স্থানান্তর না করে দিল্লিতেই কবরস্থ করার কথা বলেছিলেন।

শরিয়াতের বিষয়ে হযরত রহ. সবসময় কঠোর ছিলেন। কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন মত তো সব আহলে ইলমেরই থাকে কিন্তু প্রিয় উস্তাদ মুফতী সাইদ আহমাদ পালনপুরি দারুল উলুম দেওবন্দের তরজুমান ছিলেন। আকাবিরে দারুল উলুম দেওবন্দের ইলম ও ফিকরের হামেল ছিলেন। দীর্ঘ সময় দেওবন্দের ইলমি পরিবেশের সজীবতা বৃদ্ধি করে গেছেন। জানি না তাঁর শূন্যস্থান পুরণ হবে কি না। বাহ্যিকভাবে সেরকম কাউকে দেখি না।

ইলম আমল ও রুহানিয়াতের যে উচ্চতা তিনি স্পর্শ করেছেন তা সত্যি অতুলনীয়। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হযরত রহ.-এর কবরকে নুর দ্বারা ভরপুর করে দিন। সন্তান সন্ততি পরিবার পরিজন ও ঘনিষ্ঠজনদের সবর করার তাওফিক দান করুন। মুম্বাইয়ের ওশিভরা কবরস্থানের সব মৃতদের গোর আজাব হযরতের উসিলায় মাফ করে দেন। আমীন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *