এই নব্বই পার্সেন্ট মুনাফিকের দেশে…

এই নব্বই পার্সেন্ট মুনাফিকের দেশে…

  • য. সামনূন

বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ এখন পুরোই এক সার্কাস গোত্র। কুরআন শরীফে এসেছিল, “নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য”। আর আজকাল বাঙালী মুসলিমের একদলের কাছে নামায হচ্ছে বিকট চিৎকার দিয়ে আমীন বলা, আর নামাযের মধ্যে পাশের মুসুল্লীর সাথে পা দিয়ে কুতকুত খেলা। আক্ষরিক অর্থেই এটা, সিজদা থেকে উঠে পা নেড়ে খুঁজতে থাকে পাশের মুসুল্লির পা গেলো কোথায়!

কুরবানী হচ্ছে একদলের কাছে বড় গরু কিনে লোক দেখানো, আরেকদলের কাছে ‘হিন্দুদের দেবতা খাই’। এরা ব্যভিচারের মাধ্যমে চালানো ‘লাভ জিহাদ’ টাইপের একটা উদ্ভট কর্মে নিয়ে যাচ্ছে কুরবানীকে। কবে না যেন তারা মওদুদীর মত কুরবানীর লক্ষ্যই পাল্টে দেয়। বলবে, কুরবানীর উদ্দেশ্য হলো, যে অঞ্চলে যে পশুর প্রতি স্থানীয় ‘বিধর্মীদের’ টান আছে, সে অঞ্চলে সেই পশু জবাই করার মাধ্যমে ইসলামের উপস্থিতি জানাই দেয়া – এটাই হলো পশু কুরবানী দ্বারা ইসলামের উদ্দেশ্য!

প্যারাডক্সিয় যুক্তি দেবে, আরবে যেমন উঁটের প্রতি মানুষের ভালবাসা ছিল, উঁট মরুভূমির জাহাজ, এ জন্য সেখানে রাসূল-যুগে উঁট কুরবানীর নজীর পাওয়া যায় বেশি। এমনিভাবে ভারতবর্ষে গরু, ইথোপিয়া ও রাশিয়ায় ঘোড়া, আলাস্কায় কুকুর, থাইল্যান্ডের কাঞ্চানাবুরিতে ব্যাঘ্র মশাইকে জবাই করতে হবে। এভাবেই কুরবানী আদায় করা হবে।

তবে জানাযা-ব্যবসায় লোকসান দেখতে রাজি নয় কেউ

একদলের কাছে জীবনের মানে ‘আবু যায়েদ সারূজী’ এর মতো মুখোশ এঁটে থাকা, আরেকদলের কাছে আরাফাতের রোযা কত তারিখে রাখবে এ নিয়ে অযথা আরোপিত বিতর্ক তৈরী করা। তবে মৃত্যু নিয়ে বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ এক কাতারে, যে যেভাবেই মরুক, জানাযায় অন্তত হাজার দশেক লোক আমার চাই! জানাযা-ব্যবসায় লোকসান দেখতে রাজি নয় কেউ।

বাচ্চাকে গরু-খাসীর সামনে রেখে, তার হাত দিয়ে পশুটিকে খাইয়ে-নাইয়ে সেই পশুটা কুরবানী দেয়ার যে মূল মর্ম -ত্যাগ ও ভালবাসার জিনিস আল্লাহর জন্য পরিত্যাগের- সেটা রেখে এখন ফেসবুকে পক্ষ ভারী করতে আমার বাচ্চাকে জবাই দেখানো লাগবে!

যে কঠিন সে জন্মগত ভাবেই কঠিন ধাতুতে গড়া। বছরের পর বছর কঠোর সামরিক ট্রেনিং দিয়েও একজন মানুষকে দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় অপর একজন মানুষকে খুন করানো সহজ হয় না, সেখানে এই অর্বাচীনের দল বাচ্চাকে জবাই দেখিয়ে, আল্লাহই ভাল জানেন কী বানাতে চায়!

মানুষের মন নরম হওয়াই মনুষ্যত্বের পরিচয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি পুত্রশোকে কাঁদেন নাই? পুরো হাদীস ভাণ্ডার থেকে আমাকে একটা ঘটনা দেখান, যেখানে কোন মানবিকতার বিপর্যয় ঘটেছে আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবিক প্রতিক্রিয়া দেখাননি।

অস্ত্র ও রক্তের ভয় মানুষের থাকবেই, এটাই স্বাভাবিক, এজন্যই সে মানুষ। যেখানে সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম ওয়া রাদূ আনহু) যুদ্ধের ময়দানে পিছপা হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়েছেন, ‘আকবারুল কাবাইর, আল ফিরারু মিনায যাহাফ’ – এর প্রথম উদ্দেশ্য তো সেই সাহাবায়ে কেরামই ছিলেন, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট, তাঁরাও আল্লাহর প্রতি পরিতৃপ্ত। আর এর ১৪ শত বছর পরে এসে একটা বাচ্চা নাকি জবাই দেখে বিরাট সাহসী হয়ে ওঠবে!

তা, ভোঁতা ছুরি দিয়েই জবাই করুন না! এতে গরুর কষ্ট দেখে বাচ্চার মন সাহসিকতায় আরো পোক্ত হয়ে ওঠবে। প্রফেশনাল কসাইরা যেভাবে চার পা বেঁধে ফেলে যেন গরুর কষ্ট কম হয়, সেভাবে না বেঁধে কোনমতে ধরে রেখে জবাই করে ছেড়ে দিন, আর আপনার বাচ্চা দেখুক কীভাবে মৃত্যু যন্ত্রণায় একটা পশু কাতরায়, দেখে শক্ত হোক। বাচ্চার সুকোমল বৃত্তি নষ্ট হবে? হলে হোক না। বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করতে গিয়ে এখন ইসলাম গোল্লায় যাক। কেবল ঘুমের মাঝে আমার গলায় ছুরি না চালালেই হয়।

বলুন তো, ‘আল্লাহর তরবারী’ উপাধীপ্রাপ্ত হযরত খালিদ ইবন ওয়ালিদ (রা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব পেশিশক্তিতে ছিল নাকি স্ট্র‍্যাটিজি-যুদ্ধকৌশলে ছিল? মাথামোটা গোঁয়ার দিয়ে ইসলাম তো দূরে থাক, দুই কাফের শক্তির মাঝে বিরোধেও জয় পাওয়া যায় না।

কোন দুনিয়ায় বাচ্চাকে বড় করছেন সেই খবর তো নেই। সম্ভবত ২০১৭ সালে আমি টানা কয়েকমাস পত্রিকার পাতায় বিশেষ একটা খবর খুঁজেছি একটা নিবন্ধ তৈরীর মালমশলা জোগাড় করতে, ‘সন্তানের হাতে পিতামাতা খুন’।

আনুমানিকভাবে গড়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা ঘটনা এমন ঘটতো তখন বাংলাদেশে। এক ঐশীর কথা সবার কানে এসেছে, কিন্তু শত শত ঐশী পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে থাকে। কারণ, তাদের মা-বাবা কোন পুলিশ কর্মকর্তা না। বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে কিশোর শোধনাগার আছে, একবার গিয়ে খবর নিয়ে দেখুন কী ভয়ঙ্কর সব অপরাধ করে এসেছে এই বাচ্চাগুলো।

এই লোকদের কাছে কুরবানী আল্লাহর কোন হুকুম না, বরং প্রবৃত্তির তাড়না নিবারণের হাতিয়ার। ফেসবুকে তর্কে জেতা আর দুটো লাইক পাওয়ার মাধ্যম। কুরবানীর মহত্ত্ব বুঝাতে কবে যেন ছাগল জবাইয়ের মুহুর্তের প্রাণপণ চিৎকারটাকে রেকর্ড করে এই মূর্খরা মোবাইলে রিংটোন দিয়ে বসে! এতে মানুষ আরো তাদের উপর ক্ষেপবে, আর ওরা ভাববে ছাগলের আর্তরব রিংটোনে দিয়ে জান্নাত কামাই করে ফেলছে, যেহেতু এটা ‘সংস্কৃতিমনারা’ অপছন্দ করছে!

মূল দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের মাঝে কোন ফারাক নেই

জন্মসূত্রে আজ মুসলিম বলে ওরা গরু খাচ্ছে, জন্মটা কেবল সীমান্তের ওপারে হলেই এই এরাই আজকে গরুর প্রাণ রক্ষায় মানুষকে পিটিয়ে মারতো। মূল দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের মাঝে কোন ফারাক নেই। গাধা যদি ইসলাম গ্রহণ করলেই মানুষ হয়ে যেতো, তবে আর তাসাউফ বা শরীয়তের এতো বিধিনিষেধের প্রয়োজন হতো না।

এরই মধ্যে আরেক প্রকারের কলিজা-বিজ্ঞানীর আবির্ভাব ঘটেছে নতুন তত্ত্ব নিয়ে, কুরবানীর পশুর কলিজা নাকি জোড়া লেগে যায়। আচ্ছা, ধরুন একজন সাধারণ মানুষের গরুর এটা হলো না, তখন তার নিজেকে কী মনে হবে? তার আশেপাশের মানুষ তাকে কী মনে করবে? আল্লাহর যদি এটাই ইচ্ছা থাকতো যে, কার কুরবানী কবুল হলো আর কারটা হলো না সেটার আলামত দেখাবেন, তবে তো পূর্বেকার মত আসমান থেকে আগুনের হল্কা এসেই সেটা মানুষকে জানিয়ে যেতো। এটা না হওয়াটাই তো এই উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব। আশ্চর্য লাগে! খোদার উপর খোদাগীরী করার মাঝে বাঙালী মুসলমানের জুড়ি মেলা ভার।

এটা সরাসরি একটা কুদরতী ফয়সালা যে, এইদেশে এখনো মানুষ নতুন করে ইসলাম গ্রহণ করে। নইলে কোন মুসলিমকে দিয়ে বিচার করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বে মুগ্ধ হওয়ার মত মুসলিম সমাজ এইদেশে নেই।

ও আচ্ছা, ইসলাম গ্রহণের নাটকও তো এইদেশের মুসলিম সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়!

লেখক: তরুণ আলেম ( লেখাটি তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)

মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার দায় লেখকের

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *