একজন কিংবদন্তী আলেমের বিদায়

একজন কিংবদন্তী আলেমের বিদায়

একজন কিংবদন্তী আলেমের বিদায়

আমিনুল ইসলাম কাসেমী :: মুফতী সাঈদ আহমাদ পালনপুরী, শায়খুল হাদীস, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত। আলেম দেখেছি, কিন্তু দেওবন্দের পালনপুরী সাহেবের মত আলেম বিরল। মুহাদ্দিস দেখেছি,তবে সাঈদ আহমাদ পালনপুরীর মত প্রতিভাবান এবং মেধাবী মুহাদ্দিস হালজামানায় পাওয়া খুবই দুস্কর।

সেই নব্বই দশকে দেওবন্দে আমরা তিরমিজি শরীফ পড়েছিলাম শায়েখের কাছে। এক জীবন্ত গ্রন্হাগার। বে- মেছাল এক মুহাদ্দিস। তাঁর ইলমের গভীরতা যে কত আল্লাহ পাকই তা ভাল জানেন। বর্তমান জামানার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের মধ্যে অন্যতম। বলা যায় এক অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব। যার দৃষ্টান্ত, যার তুলনা সত্যি অকল্পনীয়।

সাঈদ আহমাদ পালনপুরী সাহেব তাঁর ইলমী মাকাম এবং দরসের শোহরাত ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বময়। দেওবন্দ থেকে সুনাম – সুখ্যাতি এই উপমহাদেশ পেরিয়ে আফ্রিকা , অষ্ট্রেলিয়া, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের মত জায়গাতে ও তাঁর ব্যাপক পরিচিতি দেখা যেত। তিনি এমন এক মুহাদ্দিস, তাঁর ইলমী যোগ্যতায় জগৎ বিখ্যাত হয়ে উঠে ছিলেন।

পালনপুরী সাহেবের দরস যেন এক আজীব আকর্ষণ। ছাত্রদের কে চম্বুকের মত টানত। কোন ছাত্রকে দেখিনি তাঁর ক্লাস ফাঁকি দিতে। বরং পালনপুরী সাহেবের দরস মানেই যেন ছাত্রদের উপচে পড়া ভীড়। জ্ঞান পিপাসুদের এক প্রতিযোগীতা শুরু হত তাঁর দরসে বসার জন্য।

তিনি যখন দরস দিতেন, পুরো দারুল হাদীস কানায় কানায় ভর্তি। দারুল উলুমের দাওরায়ে হাদীসের দুই তিন হাজার ছাত্র, সেই সাথে ওয়াকফ দারুল উলুমের শত শত ছাত্র, আরো উপস্হিত থাকত, শতাধিক ছামায়াতকারী, যারা ভর্তি পরীক্ষায় চান্স না পেলেও দারুল উলুমের ক্লাসে বসতে ভুল করেনা কখনো।

হযরত পালনপুরীর দরসের আকর্ষণে মৌমাছির মত ভন ভন করতে করতে যেন দারুল উলুমের দাওরায়ে হাদীসের পানে ছুটে আসত। দরসের এত আকর্ষণ, তাঁর প্রতি ছাত্রদের এত টান, খুব কমই দেখা যায়। তাঁর ক্লাসে ছাত্রদের এত উপস্হিতি যেন, আজীব এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটত।

উস্তাদদের মুখে মাদানী রহ, এবং কাশ্মিরী রহ, এর হাদীসের দরসের কথা শুনেছি। দেখিনি কোনদিন। তবে পালনপুরী সাহেবের দরস ছিল কিছুটা সেই মেজাজের।

আমাদের কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ রহ, তাঁর লিখনীতে উল্লেখ করেছেন, তিনি যখন ( কাজী সাহেব) দেওবন্দে পড়েন, তখনো কাজী সাহেব দাওরায়ে হাদীসের ছাত্র নন। মেশকাত বা জালালাইন। কিন্তু কাজী সাহেব হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ, এর দরসে গিয়ে বসতেন। শুধু তিনি নন, বহু ছাত্র, যারা অন্য ক্লাসে বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে পড়তেন, তারাও মাদানী রহ, এর দরসে শরীক থাকতেন। এমনকি কোন কোন উস্তাদও মাদানীর দরসে চুপিসারে বসে যেতেন।

ঠিক পালনপুরী সাহেবের দরস সেই সব মনিষীদের অনুসৃত রীতি- নীতির মতই ছিল বলা যায়। সে রকম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের ভীড় জমে যেত তাঁর দরসে। দারুল উলুম এবং আশ- পাশের ছাত্রদের এত ভীড়, যা অন্য কোন দরসে দেখা যায়নি।

তাঁর দরসে ছিল পিনপতন নিরবতা। যেমনটি হযরত কাশ্মিরী রহ, মাদানী রহ, এর দরসে ছাত্ররা গভীর ভক্তি ভালবাসা নিয়ে বসত, দুনিয়ার কোন খবর থাকতনা কারো। কেননা, যে মধু তারা আহরন করতেন, তাতে দুনিয়ার ওসব কিছু ছিল তুচ্ছ।

পালনপুরী সাহেবের দরসে সেরকম ভক্তি – ভালবাসা নিয়েই বসতে দেখেছি ইলম পিপাসুদের। পুরো দারুল উলুম যেন থমকে যেত। দারুল হাদীসের সামনেই যেন হাঁটা চলা বন্ধ হয়ে যেত তাঁর দরসের সময়।

এক অনন্য উচ্চতায় ছিল তাঁর মাকাম। হালজামানার সর্ব সেরা মুহাদ্দিস তিনি ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর এমন। তাঁর চেহারা দেখলে যে কেউ সমীহ করতে বাধ্য।

দরসে যারাই বসেছে, তাদের চিরদিন স্মরন থাকবে। কি এক সম্পদ ছিলেন ইলমে হাদীসের জগতে।

বেশী স্মরণ হয় তাঁর উপস্হাপনা। অত্যান্ত সাবলীল ভাষায় তুলে ধরতেন। বাচন ভঙ্গি ছিল মনমুগ্ধকর। যেভাবে তিনি বিভিন্ন ইশকালের জওয়াব দিতেন, হৃদয় ভরে যেত।

অনেক ধৈর্য এবং নিয়মানুবর্তিতার পাবন্দী ছিলেন। নিয়মিত তাঁকেই ক্লাশে পেয়েছি। কঠোর রীতি মেনে চলতেন।

তাঁর দরসের ইবারত পঠন টা ছিল অনেক কঠিন কাজ, যে কেউ সেই অসাধ্য সাধন করতে পারিনি। যেন তেন ছাত্র তাঁর ক্লাশে ইবারত পড়ার সাহস পায়নি।

দেওবন্দের শায়েখ আল্লামা নাসির খান সাহেব রহ, ইন্তিকালের পরেই তিনি শায়খুল হাদীসের পদে আসীন হন। সে পদকেও অলংকৃত করেছিলেন। সুনাম- সুখ্যাতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল।

একজন কিংবদন্তী। বে- মেছাল এক ব্যক্তিত্ব। জগৎ সেরা মুহাদ্দিস। যার অবদান ইলম পিপাসুদের পরতে পরতে। যার ইলমের ছোঁয়া লেগেছিল বিশ্ব জুড়ে।

প্রিয় উস্তাদ চলে গেলেন। মনে হল, পৃথিবিটা বিদায় নিয়েছে। এমন মানুষ আর আসবেনা ফিরে। ইলমী কানুন শুণ্য করে পাড়ি জমালেন রফিকে আলার সান্নিধ্যে।

হে দয়াময় আল্লাহ! প্রিয় উস্তাদকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান কর। আমিন।

লেখক : ফাযেলে দারুল উলূম দেওবন্দ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *