একজন মুজতাহিদের ব্যবসায়িক জীবনের গল্প

একজন মুজতাহিদের ব্যবসায়িক জীবনের গল্প

  • আব্দুস সালাম ইবনু হাশিম

একই সাথে যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ও যুগসেরা ব্যবসায়ী হিসেবে ইতিহাস যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছে তাদের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা রহ. অন্যতম। ইমাম আবু হানিফা জন্মেছিলেন কূফার এক ধনী পরিবারে। তাঁর পূর্বপুরুষ ‘খজ্জ’ নামক এক ধরণের সিল্ক ফেব্রিকস এর ব্যবসা পরিচালনা করতেন। কূফা নগরী যদিও তৎকালে ফিকহ, হাদীস, কালাম ইত্যাদি জ্ঞানচর্চার উর্বরভূমি ছিলো; তথাপি তিনি সেসব শাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের ইলমী হালাকায় যোগ না দিয়ে অর্থ উপার্জনকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য রক্ষার্থে নয়, বরং ব্যবসাকে তিনি নিজের অভিলাষ ও জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ব্যবসায় যখন সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠলেন তখনই ফিকহ, হাদীস ও কালাম চর্চায় তিনি মনোযোগী হন।

জ্ঞান চর্চার উপর তেজারতী কারবারকে প্রাধান্য দেওয়ার এই বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত ইমাম আবূ হানিফাকে আজীবন এগিয়ে রেখেছে। মাযহাব নির্মাতা হিসেবে তাঁর পথকে পরিষ্কার করেছে। ফিকহ চর্চা ও মুজতাহিদ হয়ে ওঠার গল্পে তাঁকে কখনো অর্থকষ্ট ভোগ করতে হয়নি। বরং হাজারও আলেম ওলামাকে তিনি আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন।

জ্ঞানীগুণীদের জন্য তিনি তার অর্থকড়ি অবারিত করে দিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে পুরো বছরের লাভের টাকায় শহরের সব আলেম উলামাকে বাজার-সদাই করে দিতেন। একবার তিনি এই ঘোষণা দেন যে, “আপনারা আপনাদের প্রয়োজনে এই সম্পদ থেকে খরচ করুন। এগুলো আমার সম্পদ নয়, আল্লাহর দেওয়া অনুগ্রহ মাত্র যা তিনি আমাকে দান করেছেন”।

একজন বিত্তবান আবূ হানিফা না হয়ে কর্পদকহীন আবূ হানিফা হলে তাঁর মাযহাবই বিপন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল ছিল

জনমানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে হলে ধনশালী হওয়ার সুবিধা অস্বীকার করা যায় না। জ্ঞান দিয়ে মানুষকে কেবল উপকৃত করা যায় কিন্তু অর্থ দিয়ে মানুষের মনস্তত্ত্বকে বশ করে নেয়া যায়। একজন বিত্তবান আবূ হানিফা না হয়ে যদি কপর্দকহীন আবূ হানিফা হতেন, তাহলে তাঁর মাযহাবই বিপন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব প্রবল ছিলো।

সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, যদি আমাদের কাছে দিনার-দিরহাম না থাকতো, তাহলে ওরা আমাদেরকে হাতের রুমাল হিসেবে ব্যবহার করতো। সুফিয়ান সাওরীর এই কথা সর্বাংশে সত্য। আলেম-উলামাদেরকে বিত্তবানদের হাতের রুমাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে সে যুগেও দেখা গিয়েছে, এ যুগেও দেখা যাচ্ছে। কাজেই আলেমদের ইলমে ধনী হওয়ার সাথে সাথে অর্থেও ধনী হওয়া অনিবার্য।

ইমাম আবূ হানিফা ফকীহ ও মুজতাহিদ হওয়ার পরবর্তী সময়েও তাঁর ব্যবসা রমরমা ছিলো। আমৃত্যু তিনি ব্যবসার সাথে নিজেকে জুড়ে রেখেছেন। অন্যদের ক্ষেত্রে যদি বলা হয়, ‘ব্যবসা তার ইলম চর্চাকে ব্যাহত করতে পারেনি’ তবে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর ক্ষেত্রে বলা হবে, ‘ইলম চর্চা তাঁর ব্যবসায়িক গতিকে রোধ করতে পারেনি।’

এমন না যে, ইমাম আবু হানিফা কেবল কর্মচারী মারফত ব্যবসা পরিচালনা করেছেন, বরং নিজেও বাজারে বসে বেচাকেনা করতেন। এমনই একদিন এক মহিলা আসলো তাঁ রকাছে কিছু থান কাপড় বিক্রি করতে। আবু হানিফা জিজ্ঞেস করলেন, কতো করে বেচবেন? মহিলা বললো, ‘একশ’। তিনি বললেন, এর যেমন মান এটা তো একশ’র চাইতে বেশি হওয়ার কথা! ভেবেচিন্তে বলো কতো দামে বেচবে? মহিলা কয়েক বারে চারশ’ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি করলো। আবূ হানিফা বললেন, এটা এর চাইতেও দামী! মহিলা বললো, আপনি কি তামাশা করছেন আমার সাথে? তিনি বললেন, তবে আপনি অভিজ্ঞ কাউকে নিয়ে আসুন যে এর মূল্য ঠিক করে দিবে।

মহিলা একজন ব্যবসায়ীকে ডেকে আনলো। পন্যটি যে পাঁচ’শ দিরহামে কিনে নিলো।

এই ঘটনায় ইমাম আবু হানিফার সশরীরে ব্যবসা করার যেমন প্রমাণ পাওয়া যায়, তেমনি তাঁর সততারও প্রকাশ ঘটে। যে কারণে তাঁকে ব্যবসায়ীক সততার দিক দিয়ে হযরত আবূ বকর রা. এর সাথে তুলনা করা হয়।

ভেজাল পন্যের ব্যাপারে তিনি সর্বোচ্চ সতর্কতা দেখাতেন। তাঁর বাণিজ্যিক সহকারীকে একবার কিছু পন্য দিয়ে এক শহরে পাঠালেন। এটাও বলে দিলেন, কিছু কাপড়ে খুঁত আছে, বিক্রয়ের সময় যেন এ কথা উল্লেখ করে দেয়। ঘটনাক্রমে সে ক্রেতাকে খুঁতের কথা জানাতে ভুলে গিয়েছিলো। এটা জানতে পেরে ইমাম আবু হানিফা পরে পুরো টাকাটাই দান করে দিয়েছিলেন।

ফিকহ চর্চার চেয়ে ব্যবসা পরিচালনার প্রতি তাঁর মনোযোগ কোনো অংশে কম ছিলো না

আগেই বলেছি, ব্যবসাটা তিনি নামকা ওয়াস্তে করতেন না। ফিকহ চর্চার চেয়ে ব্যবসা পরিচালনার প্রতি তাঁর মনোযোগ কোনো অংশে কম ছিলো না। তাই ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি ছিলেন সফল ও সার্থক। তাঁর চালচলন ও জীবনাচারেও আর্থিক স্বচ্ছলতার ছাপ পরিস্ফুট হয়ে উঠতো। তারঁ পরিধেয় পোষাকের মূল্য ৩০ দিনারের কম হতো না, যা বর্তমান বাজারে ১১ লক্ষ টাকার সমান। তিনি বাজারের সেরা ও দামি সব সুগন্ধি ব্যবহার করতেন।

ইমাম আবু হানিফা রহ. তাঁর জীবনের ৫২ বছর কাটিয়েছেন উমাইয়া শাসনামলে। বাকি ১৮ বছর পার করেছেন আব্বাসীয় যুগে। ইসলামী শাসনব্যবস্থা দুটির উত্থান-পতনের স্বাক্ষী হয়েছেন। ইমাম যায়েদ ইবনে আলী, যয়নুল আবেদীন যখন হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের সাথে বিদ্রোহ ঘোষোণা করে রাজপথে নেমে এসেছিলেন তখন আবু হানিফা তাঁকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই মিছিল যেনো বদরের ময়দানে রাসূল সা. এর মিছিল।’ আবু হানিফা যদিও তাঁর সাথে রাজপথে নামতে পারেননি কিন্তু তাঁর সাহায্যার্থে ১০ হাজার দিরহাম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

ইমাম আযম আবু হানিফার বিপুল ব্যাবসা ও অর্থসম্পদ তাঁর জ্ঞান চর্চা, তাকওয়া ও খোদাভীতি একটুও কমাতে পারেনি। ফিকহ চর্চায় তিনি নিজ যুগের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, ‘মা র’আইতু ফিল ফিকহি মিসলাহু’ ( ফিকহে তাঁর মতো কোনো পণ্ডিত আমি দেখেনি ) আহমাদ বিন হাম্বল বলতেন, আবু হানিফার উপর আল্লাহ রহম করুন, তিনি জ্ঞানে, তাকওয়ায় ও পরকালমুখিতায় এমন স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন; তাঁর নাগাল পাওয়া আমি আহমাদের জন্য কখনোই সম্ভব নয়।

ইমাম আবূ হানিফাই প্রথম হাদীসকে ফিকহী অধ্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন

সে যুগে লেখালেখির খুব একটা প্রচলন ছিলো না। তবুও তিনি লিখেছেন বেশ কিছু গ্রন্থ। আল ফিকহুল আকবার ছাড়াও তিনি লিখেছেন, ‘আল ফিকহুল আওসাত’, ‘আল আলিম ওয়াল মুতা’আল্লিম’, ‘মুকাতিল ইবনু সুলাইমানের প্রতি খোলা চিঠি’, ‘ উসমান আল বাত্তি’র প্রতি খোলা চিঠি’। হাদীস শাস্ত্রেও তাঁর ছিলো অগাধ পাণ্ডিত্য। অসংখ্য মুহাদ্দিস থেকে তিনি হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, আমার কাছে কয়েকটি সিন্ধুক ভর্তি হাদীসের ‘যাকিরাহ’ (ডায়েরী) রয়েছে। সেখান থেকে কেবল প্রয়োজনীয় হাদীসগুলোই আমি বের করেছি। সতেরটি মুসনাদে তাঁর হাদীসগুলো সংকলিত হয়েছে। ইমাম আবু হানিফাই প্রথম ব্যক্তি যিনি হাদীসকে ফিকহী অধ্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন।

ইমাম আবু হানিফার ক্ষমতা কিংবা পদ-পদবীর বিন্দু মাত্র লোভ ছিলোনা। আব্বাসী খলীফা আবু জা’ফর মানসুর তাঁকে বিচারকের দায়িত্ব দিতে চাইলে তিনি বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখান করেছিলেন। ফলে তাঁর উপর নেমে আসে নির্যাতনের পাহাড়। এই পৃথিবী বহুবার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখেছে, পদ-পদবীর জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম দেখেছে, কিন্তু ক্ষমতার মসনদকে বর্জন করার অপরাধে মরতে দেখেছে কেবল একজনকেই, তিনি হলেন ইমামে আযম আবু হানিফা নূমান ইবনু সাবিত- রাদিয়াল্লাহু আনহু।

 

লেখক : পরিচালক আত তুরাস একাডেমী ও ইমাম শাইবানী ফিকহ একাডেমী। সাবেক মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *