একজন শুদ্ধ মানুষের প্রতিকৃতি

একজন শুদ্ধ মানুষের প্রতিকৃতি

  • ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

আমার বাবা, আমার গুরু, একজন শুদ্ধ মানুষকে ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ রবিবার চিরদিনের জন্য সমর্পণ করেছি আল্লাহ পাকের অনন্ত রহমত ও মাগফিরাতের ক্রোড়ে। যে মাটি থেকে সাতন্নব্বই বছরের জীবনে সর্বক্ষেত্রে শুদ্ধ চর্চাই ছিল যার ব্রত। সর্বত্র শুদ্ধচারী ছিলেন তিনি। চলনে, বলনে, উঠা বসায়, আচার আচরণে ছিলেন শুদ্ধতার প্রতীক। সুরুচির ছাপ ছিল মূর্ত।

পাঠান আমলে প্রাশাসনিক প্রধানকে বলা হতো সদরূস সুদুর আর রাজস্ব প্রধানকে বলা হতো সদরে আলা। সদরে আলা সদরূদ্দীনের বনেদি রক্তে তাঁর জন্ম। বনেদিয়ানার একটা স্নিগ্ধ ছাপ ছিল এই শুদ্ধ মানুষটির অবয়বে। ইয়াতিম হিসেবে মায়ের তত্ত্বাবধানেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। মা ছিলেন সাধ্বী মহিলা হিসেবে সমাদৃতা৷ অল্পেতুষ্ট ও অতি ধৈর্যশীল ছিলেন শরীয়তের নির্দিষ্ট কয়েকটা নিষিদ্ধ দিন বাদে সারা বছরই রোজা রাখতেন। তিনি রাউতীর খাঁ বাড়ির মেয়ে ছিলেন। তাদের সম্পর্কে জনশ্রুতি ছিল দুধের মইল (ময়লা) থাকতে পারে কিন্তু খাঁদের রক্তে কোনো মইল নেই। গায়ের রঙ অসম্ভব সুন্দর ছিল তার। আমার ছোট বেলায় দেখেছি শ্বেতশুভ্র শাড়ী পরে কাঠের বৌল খরম পায়ে যখন মৃদু হাঁটতেন তখন কাপড় ছেদ করে যেন বর্ণ আভা ছড়িয়ে পড়ত চৌদিকে।

অনেক কারামত ছিল তাঁর। বিখ্যাত বার ভূঁইয়াদের এক অধঃস্থ পুরুষ নায়েবের বাপ ভূঁইয়া ছিলেন সম্পর্কে তার দেবর। ইয়া বিশাল পাঠানী বপু ছিল তার। সাতফুটের মতো লম্বা। আমরা দুই হাতেও তার কব্জির বের পেতাম না। খেতে পারতেন প্রচুর। খাইয়ে মানুষ হিসেবে খ্যাতি ছিল তার। দুই ইয়াতীম ছেলে ও এক বিধবা মেয়েকে নিয়ে ছিল দাদীর সংসার। সামান্য মাটির পাত্রে তিনি ভাত রাধতেন। কৌতুক করে নায়েবের বাপ একদিন চ্যালেঞ্জ করে বসল, ভাবী খাওয়াতে হবে আমাকে। তিনি তৎক্ষণাৎ বললেন, হাত ধুয়ে এসো। নায়েবের বাপের মনে মনে ধারণা ছিল হারাব আজ ভাবীকে। হাত ধুয়ে খেতে বাপ বসলেন তিনি। দাদী বেড়ে খাওয়াচ্ছিলেন। নায়েবের বাপ বলেন আমি খেতে খেতে বেসামাল হয়ে গিয়েছিলাম। আর খেতে না পেরে হার মানলাম। পরে দেখি ডেগে আগে যে ভাত ছিল তাই আছে। এত খাওয়ার পরেও কমেনি কিছুই।

দাদীর স্বভাবের বেশ প্রভাব পড়েছিল বাবার মাঝে। জাওয়ার স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। অগ্রজসম ইসমাইল মাস্টার ছিলেন তার সহগামী। বাবা ছিলেন এত ছোট যে তিনি বলতেন ইসমাইল ভাইয়ের কাঁধে হাত চেপে আমি বাড়ি থেকে দেড় মাইল দূরে স্কুলে যেতাম। ভয়ে তার কাঁধ ছাড়তাম না। এতে তার কাঁধের কাপড় ছিঁড়ে যেত। প্রাথমিক শিক্ষার পর তার ফুফু তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন নেত্রকোনা। তৎকালীন মহকুমা শহরে। সেখানে তার ফুফা ছিলেন তৎকালের একজন খ্যাতনামা আইনজীবী। নেত্রকোনার প্রসিদ্ধ স্কুল আঞ্জুমান স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রাস পাস করেন। বাবা বলতেন, তার ফুফু বলতেন, প্রয়োজনে আমির বাপের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও আমির ভাইপোকে পড়াব। আল্লাহর মর্জী, কিছু দিনের ভিতর এই স্নেহময়ী ফুফু মারা যান। শিক্ষা অর্জনের প্রচন্ড আগ্রহ তার বাধাগ্রস্ত হয়। তৎকালীন শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নরমাল ট্রেনিং একাডেমিতে ভর্তি হন। কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ‘পণ্ডিত’ উপাধি লাভ করেন। ‘পণ্ডিত’ সাহেব নামে তিনি পরে ব্যাপক পরিচিতি পান।

মেধা ছিল বাবার বংশানুক্রমিক। পাঠাগ্রহ ছিল প্রবল। আমাদের বাড়িতে কবি মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যের প্রাচীন সংস্করণ, কালিদাসের মেঘদূতের পুরনো কপি ছিল। বিভিন্ন ধরনের ইতিাহস ও কিংবদন্তি নখদর্পনে ছিল তার। এমন কী গীতা, বেদ, উপষেদের বহু রেফারেন্স তিনি আমাদের দিতেন। রবীন্দ্র সাহিত্য ও রবীন্দ্র সংগীত তো ছিল তার ঠোঁটস্থ। আমার প্রথম জীবনে তিনি আমাকে নিজে মেঘদূত ও মেঘনাদ বধ পড়িয়েছেন। রামায়ণের কাহিনী বা উজুয়নী নগরীর পথঘাট অলি গলি যেন ছবির মতো ভাসতো তখন। জাওয়ার স্কুলেই তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে প্রধান শিক্ষকও হন তিনি। সফল শিক্ষক হিসেবে খুব খ্যাতি ছিল তার।

সেই প্রাথমিক পাঠ যারা নিয়েছিল তারাও পরে সফলজীবনেও ভুলতে পারেনি তার কথা। তার প্রিয় ছাত্র লব্ধ প্রতিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক বনেদি পত্রিকা ইত্তেফাকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রাহাত খান আমাকে বলেছিলেন, স্যারের পড়ানোর ভঙ্গি এত মনোহর এত হৃদয় কাড়া ছিল যে তখন অন্য কোনো দিকে চোখ ফেরানোর কথা মনেও আসতো না। মুগ্ধ নেত্রে তার দিকেই তাকিয়ে থাকতে হতো। তৎকালীন সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ মুসলমান রায়ত শ্রেণি ও নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের মাঝে তিনি শিক্ষা বিস্তারের ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষা বিস্তারের প্রতি তার এই আগ্রহ তার রক্তে ছিল। তার পিতা সদরে আলা মুন্সি সৈয়দ উদ্দীন সাহেব এলাকার প্রথম যে সামান্য কয়জন মুসলিম আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন তাদের মাঝে ছিলেন একজন। বহু দরিদ্র ও নিম্ন শ্রেণির মানুষকে তিনি গাঁটের পয়সা খরচ করে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। অত্যন্ত খোলামেলা হৃদয়ের দানশীল মানুষ ছিলেন তিনি। এখনও তা মানুষের মুখে মুখে। এমনকি এই মাত্র একজোড়া পছন্দসই জুতো কিনে এনেছেন বা শীতের দিনে একটা শাল পরে বেরিয়েছেন, কেউ হয়তো বললো, মিঞা জুতোটা বড় সুন্দর বা মিঞার চাদরটা বড় উমের, সঙ্গে সঙ্গে তিনি পা থেকে জুতো খোলে দিয়ে খালি পায়ে বাড়ি ফিরতেন বা গায়ের শালটা অকাতরে দিয়ে নিজে শীতে কাঁপতে কাঁপতে চলে আসতেন। দুঃখী মানুষের সঙ্গে সব সময় থাকতেন তিনি।

যা হোক, বাবা প্রথমে দরিদ্র ও নিম্ন শ্রেণির লোকদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগগ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষাকে উন্নয়ন ও মনুষ্যত্ব অর্জনের মূল স্তম্ভ বলে মনে করতেন। অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীর তিনি নিজ বাড়িতে রেখে পড়াতেন। ছাত্রদের সাথে নানা শিক্ষামূলক আলোচনা করতে করতে দেড় মাইল দূরে স্কুলে প্রতিদিন হেঁটে যেতেন আবার বিকেলে একইভাবে আলোচনা করতে করতে বাড়ি ফিরতেন। ফলে সব সময় ছাত্রদের বিরাট একটা জটলা তার সাথে থাকতো। শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যিক চিন্তা ছিল তার কল্পনারও বাইরে। ছাত্রদের প্রতি তার আপত্য স্নেহ ছিল অপরিসীম। অনেকের বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও তিনি খোঁজ খবর নিতেন। তার অন্যতম ছাত্র ডা. আইনুল ইসলাম চৌধুরী বলতেন, স্যার যে কী স্নেহ করতেন তা ভাষায় বলা সম্ভব নয়। কেবল মায়ের স্নেহের সঙ্গেই তার উপমা দেয়া যায়। আমাদের এলাকার যারা বর্তমানে শিক্ষিত ও সফল তারা সবাই তার অবদানের কথা কুণ্ঠাহীনভাবে মনে করেন।

পরিণত বয়সে অবসর জীবনেও আমরা দেখেছি ছাত্র ছাড়া তিনি থাকতে পারতেন না। যতদিন শক্তি ছিল কোনোরূপ বিনিময় ব্যতিরেকে একে ওকে তিনি নিজে বাংলা সাহিত্য পড়াতেন। শিক্ষা বিস্তারের প্রতি তার যে কমিটম্যান্ট ছিল তার একটি উক্তিতেই তা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তিনি যখন প্রথম জীবনে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলিম রায়ত প্রজাদের মাঝে শিক্ষা বিস্তারের কর্মসূচী নেন তখন ঐ এলাকার বড় এক জোতদার পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি রোহিনী বিশ্বাস তাকে বলেছিলেন, রশিদ মিঞা, হিন্দু মুসলিম দুই জাত। আর আমরা তোমরা [জমিদার- তলুকদার] একজাত ৷ এই যে, রায়তদের বড় করে তুলছ এরা একদিন তোমার বিরুদ্ধেই দাঁড়াবে । বাবা উত্তরে বলেছিলেন, আমাদের পক্ষে যাবে না বিপক্ষে সে কথা নয় তবে অশিক্ষিত রেখে দীর্ঘকাল কাউকে দাবিয়ে রাখা যায় না। সুশিক্ষিত করাই সব সমস্যার সমাধান।

রায়ত প্রজাদের প্রতি তিনি অত্যন্ত সহমর্মী ও সদয় ছিলেন। নিজে সংসার নির্বাহে টানাটানি সহ্য করেও দরিদ্র রায়তদের কেবল খাজনাই মাফ করে দিতেন না। নানাভাবে তাদের সাহায্যও করতেন। সে সময় বেশ কয়েকটি গ্রাম আমাদের রায়তভুক্ত ছিল। এর সাথে একটা গ্রামে দরিদ্র হিন্দু জেলে সম্প্রদায় বাস করতো। মাছ বেচে কায়ক্লেশে জীবন চালাতো। ছোট সময় দেখেছি কোনো কোনো সময় সামান্য কিছু মাছ দিয়েই মাফ পেয়ে যেত তারা। অথচ সেই কালে আমাদের এলাকার লোকের আহারের জন্য মাছ কিনে খেতে হবে বলে ধারণাও করতো না। যে কোনো জলায় জাল টেনে দিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। তখনকার সময়ে আমাদের এলাকার লোকেরা মাছের সঙ্গে কোনো তরকারি ব্যবহার করতো না।

সাথে সাথে তিনি নিজেকে নানা ধরনের সামাজিক ও জন কল্যাণমূলক কাজে সম্পৃক্ত করেন। সাধারণ লোকেরা তাকে এত ভালোবাসতো, তার প্রতি এত আস্থা ছিল যে, সেই ব্রিটিশ আমলে তাকে সবাই ধরে ইউনিয়ন বোর্ড কমিশনের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। আমাদের ইউনিয়নের যতটুকু উন্নতি হয়েছিল তা তারই প্রচেষ্টার স্বাক্ষর ছিল। আমাদের এলাকাটি ছিল নিম্নাঞ্চল এবং বন্যা প্রবণ। বর্ষায় অথৈ জলে পুরো এলাকা ধারণ করতো এক মহাসমুদ্রে। বছরে প্রায় পাঁচ মাসই পানির ভেতর। বর্ষায় সারা পাড়া-মহল্লা হয়ে যেত বিচ্ছিন্ন এক একটা দ্বীপের মতো। যাদের নিজেদের নৌকা রাখার মতো স্বচ্ছলতা ছিল না তাদের চলাফেরায় খুবই অসুবিধায় পড়তে হতো।

সাতরে বা কলা গাছ কেটে ভেলা বানিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি যাতায়াত করতে হতো । বিচ্ছিন্নতার কারণে চটজলদি একে অপরের বিপদে সাহায্য করাও হত দুষ্কর। এ সুযোগে চুরি ডাকাতি বেড়ে যেত । নৌকা ভেলা জোগাড় করে আসতে আসতে সব শেষ হয়ে যেত। এই সময় যোগাযোগের জন্য তিনি অভিনব ব্যবস্থা করেন। বাঁশের পুল বানিয়ে পুরো এলাকাটিকে পরষ্পর যুক্ত করে দিয়েছিলেন। এতে মানুষ যেমন উপকৃত হয়েছিল তেমনি চমৎকৃতও হয়েছিল খুবই । এলাকার পরিকাঠামোগত উন্নয়নে তার অঞ্চলও প্রকৃতি হিসেবে একটা আলাদা ধারণা ছিল।

তিনি আমাদের বলতেন, প্রাকৃতিক অবস্থার অনুকুলে থেকে প্রত্যেক এলাকার পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা দরকার। আমাদের এই দেশ যেহেতু নদীমাতৃক আর খাল-বিল নির্ভর হাউরে-সমাজ। আর পানির স্রোত এখানে সাধারণত উত্তর থেকে দক্ষিণ মুখি । সুতরাং রাস্তাঘাট এভাবে করা দরকার যাতে স্বাভাবিক গতিস্রোত যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। ইংরেজ বেনিয়ারা এ দেশের পরিকাঠামোগত পরিকল্পনা নিজেদের বেনিয়া চিন্তাকে সামনে রেখে করেছে। গণ মানুষের কল্যাণ ও প্রয়োজনকে সামনে রেখে নয় ৷ তাই রাজনৈতিক সুবিধার্থে তাড়াতাড়ি কাঁচামাল কাঙ্ক্ষিত বন্দরে পৌঁছানোর জন্য তারা রাস্তাঘাট রেল লাইন করেছে পূব-পশ্চিমমাত্রায়। যা ছিল দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর কুফল আজ আমাদের সামনে স্পষ্ট।

আমাদের দেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে এর প্রভাব অস্পষ্ট নয়। এলাকাভিত্তিক ভূপ্রকৃতি আবহাওয়ার গুরুত্ব দিতেন বেশী। আমাদের এলাকা যেহেতু বন্যা প্রবণ। প্রতি বছরই বর্ষায় ডুবে যায় সবকিছু। তাই তিনি বলতেন, এখানে উঁচু করে রাস্তা করে লাভ নেই। এমন ভাবে রাস্তা করতে হবে যাতে বর্ষায় পানির নিচে থাকবে। এতে রাস্তাও প্রতি বছর ঢেউয়ে ভাঙবে না এবং পানির স্বাভাবিক স্রোতও বাঁধাগ্রস্ত হবে না। কিন্তু হায়, এলজিউডি-এর বিদেশী তকমাধারী বাঘা বাঘা ইঞ্জিনিয়াররা বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় বর্তমানে রাস্তাঘাট উঁচু লেভেল করার ফলে প্রতিবছরই ভাঙে আবার প্রতি বছরই তা মেরামত করতে হয়। তদুপরি রাস্তার স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হওয়ায় বর্ষাকাল চলে গেলে পানির জন্য গভীর নলকূপ ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না ফল-ফসলের ক্ষেতের। খাল-বিল শুকিয়ে কাঠ। ফলে মৎস সম্পদেরও জীবন বিলুপ্তি ঘটছে। ফসল ফলাতে ব্যয় হচ্ছে অনেক বেশী। ক্রমে পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে অসুবিধায় পড়তে হবে আরো ভীষণভাবে। তবে হ্যাঁ, ইঞ্জিনিয়ার কন্ট্রাক্টার আর কিছু আমলা মেম্বারদের পকেট ভারি হচ্ছে, এর ফল ভোগ করতে পারছে প্রতি সনেই।

তিনি তার জনহিতকর কার্যক্রম ও বিচক্ষণতার ফল স্বরূপ জুরি বোর্ডের সদস্য হিসেবেও বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন। তা ছাড়া এই এলাকার বড় পাকা, জুমা মসজিদ, পাঁচ গ্রামের ঈদগাঁহ ও গোরস্তান প্রতিষ্ঠা ছিল মূলত তারই প্রয়াসে।

অত্যন্ত সুরেলা ও মাধুর্যময় কণ্ঠ ছিল তাঁর। এত বিশুদ্ধভাবে সুরেলা কণ্ঠে কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করতে আলেমদের মধ্যেও খুব কমজনকে তেমন দেখেছি। শুনেছি প্রথম জীবনে গান বাজনার প্রতি অনুরাগ ছিল। নানা রকম বাদ্যযন্ত্র ছিল তার ব্যবহারে। দাদাজানও সংস্কৃতিপ্রেমী ছিলেন। মৃত্যুর আগে বছর খানেক শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন আখেরাতের চিন্তা তার অন্তরে এত প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, যেখানেই আলেমের সংবাদ পেতেন তাকে দাওয়াত দিয়ে এনে তওবা করতেন। আল্লাহ মেহেরবান, সূচিময় অন্তর নিয়ে তিনি জান্নাতবাসী হয়েছিলেন। শুনেছি বাবার সেই কালে একদিন পেয়ারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদর করে চুমু দিয়েছিলেন তার ডান হাতের তালুতে। ঘুম থেকে উঠেই মন তার আল্লাহ ও দীনের দিকে প্রবল অনুরাগী হয়ে উঠে। সবকিছু ভেঙেচুরে মহকুমা শহর কিশোরগঞ্জে চলে আসেন। যেখানে ছিলেন হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রহ.-এর খলিফা বিশিষ্ট আলেম ও আল্লাহ’র ওলী হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ.। তার হাতে তিনি বায়আত হন। পুরো জীবনটাই দীনের জন্য উৎসর্গ করেন। এখন থেকে কুরআন মজীদের তেলাওয়াতেই ঢেলে দিয়েছিলেন তার কণ্ঠ মাধুর্যকে। এর মাঝেই তিনি প্রশান্তি পেতেন অপার্থিব সৌম্যতায়।

রবিন্দ্র কাব্য ও সংগীতে তিনি আনন্দ পেতেন। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, সোনার তরী, বলাকা, দেবতার গ্রাস, পুরষ্কারপ্রভৃতি কবিতা খুবই ছন্দময় কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন। আমাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতেন । অনেক সময় গীতাঞ্জলির গানের কলি আবৃত্তি করতেন, বহুবাসনায় বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে, এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভরে । বলতেন, কৃপা আবার কঠোর হয় কি করে, বুঝেছ। এরপর বিস্তৃত ব্যাখ্যা করতেন, যার বহু কঠোরতার পেছনের সন্তানের প্রতি তার অপরিসীম করুণা প্রচ্ছন্ন থাকে তেমনি মহামহিম দয়াময় আল্লাহ পাকের অনেক কাজ বান্দার জন্য আপাত দৃষ্টিতে কঠোর ও কষ্টকর মনে হয় কিন্তু এসবের পেছনেও তাঁর অনন্ত অসীম দয়া মেহেরবানী ক্রিয়াশীল থাকে। বাহ্যত কঠোর হলেও মূলত তার কৃপাই। তাই রবিন্দ্রনাথ এখানে কৃপা কঠোর শব্দটির ব্যবহার করেছেন। তিনি বলতেন, রবিন্দ্র সাহিত্যে এ ধরনের বহু নতুন নতুন শব্দের আবিষ্কার ও ব্যবহার রয়েছে। প্রকৃত সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক দার্শনিক কখনও শব্দের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেন না। ভাষায় না কুলালে তিনি নয়া শব্দের জন্ম দেন।

খুব নিষ্ঠাবান ধার্মিক ছিলেন তিনি। সাথে সাথে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উচ্ছল ছিল তার বোধ। সাম্প্রদায়িক হীনতায় আক্রান্ত হতে তাকে দেখিনি কখনো। আমাদের পাশের গ্রামে ছিল হিন্দু জোতদার বিশ্বাসদের বসবাস। এদের ময়মুরব্বীদের নিঃশঙ্কোচে আমাদের এখানে যাতায়াত করতে দেখেছি। বাবার এক সহকর্মী ছিলেন হরিপদ বাবু। প্রায়ই দেখতাম, দুপুরে আমাদের এখানে খেয়ে কাচারীতে গড়াগড়ি করতেন। ছোটবেলায় আমাদের অন্য ধারণা তো দূরের কথা মনে হতো ইনি আমাদের আত্মীয় কেউ। আমরা একযোগে তাকে ফরীদ কাকা বলে ডাকতাম। বড় হয়ে অনেকদিন পর জেনেছিলাম তার নাম হরিপদ। হরিপদ আমাদের উচ্চারণে ফরীদের মতো শোনাত।

ছোট বেলায় বাবার ছিল মুখ ভরা সুন্দর কালো কুচকুচে ঈষৎ কোঁকড়া দাড়ি। বনেদি চেহারায় তাকে আরো বেশী সুন্দর লাগত এই দাড়িতে। জাওয়ার স্কুলের যাতায়াতের পথেই ছিল বিশ্বাসদের বাড়ি। হরিপদ বাবুর বৃদ্ধা মা বাবাকে দেখলেই ডেকে নিতেন। বলতেন, রশিদ মিয়া একটু দাড়াও, তোমাকে বড় সুন্দর লাগে, এত সুন্দর দাড়ি তোমার একটু দেখে নিই। আমাদের পরিবারে বর্তমানে ধর্মভীরুতার সাথে সাথে অসাম্প্রদায়িক চেতনার লালন বাবা দাদা পূর্বপূরুষদের থেকে ঐতিহ্যসূত্রে গ্রোথিত। আমাদের পেয়ারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধর্মরাজিক ছিলেন সত্য সাথে সাম্প্রদায়িক নিচতার কোনো স্থান ছিল না তার মাঝে, আর তাঁর নৈতিকতার শিক্ষায় ।

পরে বাবা তার পীর-মুর্শিদের ডাকে কিশোরগঞ্জ চলে আসেন। হযরত মাওলানা আতহার আলী রহ. তখন একদিন উন্নতমানের এবং সাধারণ শিক্ষার সাথে সমন্বয় করে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বর্তমানে তা জামিআ ইমদাদিয়া নামে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পরিচিত। সেটি গড়ার কাজে বাবাকে সহযোগী হিসেবে শরীক করলেন। এর প্রিন্সিপাল ছিলেন জনাব মাওলানা আহমদ আলী খান রহ., প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন ও আতহার আলী রহ.-এর খলিফা। হযরত মাওলানা আতহার আলী তখন রাজনীতিতে খুবই ব্যস্ত । প্রায় সময়েই নানা কাজে কিশোরগঞ্জের বাইরে থাকতেন। আর হযরত মাওলানা আহমদ আলী খান রহ. ছিলেন খুবই আন্তর্মুখী মানুষ। তাই গোটা বিষয়টা বস্তুত বাবাকেই সামলাতে হতো।

খুবই বিশ্বস্ততা ও বিচক্ষণতার সাথে তিনি আঞ্জাম দিয়েছিলেন সব কিছু । ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন। প্রায় আড়াই দশক ধরে তিনি নিষ্ঠার সাথে স্বীয় পীর মুর্শিদের সোহবতে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। জামিআ ইমদাদিয়ার ত্রয়ী স্তম্ভের তিনি ছিলেন একজন । লাখ লাখ টাকা তার হাত হয়েই ব্যয় হয়েছে কিন্তু কেউ কোনো দিন কিছুমাত্র সন্দেহের অবকাশ দেখেনি তার মাঝে। আমানতদার হিসেবে সারা অঙ্গনে তাঁর প্রসিদ্ধি ছিল। পাই পাই করে হিসাব দেখতেন তিনি। হিসাবে এত পাকা ছিলেন যে, বাংলাদেশের অন্যতম মুহাদ্দিস শীর্ষ আলেম হযরত মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ দামাত বারাকাতুহুম বলেন, অনেক সময় দেখতাম, পুরো পৃষ্ঠায় লেখা বিভিন্ন সংখ্যা। ওপর থেকে নিচে এক নজর বুলিয়ে সঠিক হিসাব কষে ফেলতেন। পরে আমরা তীক্ষ্ণভাবে হিসাব করেও কোনো গরমিল পেতাম না। স্বাধীনতার পর যাত্রাবাড়ি দারুল উলূম মাদানিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রিন্সিপাল মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহর আবদারে ঢাকায় চলে আসেন এবং প্রায় বছর খানেক এখানে অতিবাহিত করেন।

মাদরাসাজীবনের বহু ছাত্র বর্তমানে লব্ধ প্রতিষ্ঠ ও সুবিখ্যাত। মাওলানা আতাউর রহমান খান, মাওলানা আনওয়ার শাহ, তাবলীগী মারকাজের মাওলানা জমিরুদ্দীন, মুফতি উবায়দুল্লাহসহ আরো অনেক সফল ব্যক্তির নামে এ তালিকা সমৃদ্ধ ।

শিক্ষক জীবনে সাধারণ ও সনাতন দীনি দুটো ধারায়ই অবদান রাখতে পেরে অত্যন্ত তৃপ্ত ছিলেন তিনি। জাওয়ারের জমিদার মুরতোজা মিঞা ছিলেন বাবার খুবই গনিষ্ঠ ও অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি বলতেন, মাস্টার সাব, আপনি বড়ই ভাগ্যবান। পাতলুন টাই পড়ে এসে অনেকেই আপনাকে স্যার বলে সালাম করে। আবার পাগড়ি সুশোভিত বহু বড় বড় মাওলানাও আপনাকে হুযূর বলে সালাম জানায়। বাবা খুবই তৃপ্তির সঙ্গে এই কথনের স্বাদ নিতেন।

খুবই শান্ত ও ধীর স্থির ছিল তার স্বভাব। প্রচণ্ড উত্তেজনার পরিস্থিতিতেও তাকে অস্থির বা উত্তেজিত হতে দেখিনি। শান্ত ধীরভাবে মুকাবেলা করতেন পরিস্থিতির। চেঁচামেচি করা, গালি গালাজ করা ছিল একেবারেই তার স্বভাবের বিরপীত। কারো এমনকি শত্রুরও কোনো রূপ দোষচর্চা করতে পাইনি কোনো দিন। খুবই শান্ত কিছুটা ধীর গলায় কথা বলতেন সব সময়। সব বিষয়ে পরিমিতিবোধ ছিল অসম্ভব পর্যায়ের। যৌবন থেকেই দেখেছি পেট ভরে গেলে বা পেট ভরা থাকলে এক লোকমাও আর অতিরিক্ত খাওয়াতে পারতো না কেউ তাকে। যৌবনে তো নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। পরবর্তীতে সকালে ফজরের পর কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে বন্ধুবর নুমান সাহেবকে নিয়ে হাঁটতেন অনেকক্ষণ। তাই বার্ধক্যেও প্রেসার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি ধরনের কোনো কঠিন রোগে ভুগতে হয়নি তাকে। অলেখা রুটিন তিনি অনুসরণ করতেন সব সময়ই ।

মায়ের সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবন ছিল সুদীর্ঘ পাঁচ দশকেরও উপরে। ২০০২ জান্নাতবাসী হয়েছেন তিনি। মা ছিলেন সায়্যিদযাদী নম্র স্বভাবের মহিলা। একটা সূচীতা ও অপার্থিব পবিত্রতার আবেষ্টনি ছিল তাঁর। আমরা এগার ভাই ও তিন বোন ঘিরে সংসার। পিঠেপিঠি সবাই। শৈশবের তাণ্ডবে কত কিছুই না করেছি আমরা। কিন্তু বাবা বা মা কোনোদিন আমাদের মারধোর করেননি বা বকাঝকা করেননি। এমন কি এই দীর্ঘ জীবনে পরস্পরে কোনো কলহ বা কথা কাটাকাটি করতে দেখিনি বাবা মাকে। যদি কোনো দিন হয়েও থাকে তা আমাদের অগোচরেই হয়তো সমাধা করে ফেলেছেন তারা। আমাদের ব্যাপারে, সন্তানদের মানসিক আচার গঠনে খুবই সতর্ক থাকতেন তারা ।

ধৈর্যের পাহাড় বলা যায় বাবাকে। চরম বিপদকালেও তাকে ধৈর্যহারা হতে দেখা যেত না। কঠিন কষ্টেও কোনো অভিযোগ মুখে ফুটত না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করায় আমাদের খুবই পেরেশানি উঠাতে হয়েছিল। কিন্তু বাবা ছিলেন অচঞ্চল। বহুবার আর্থিক পেরেশানিতেও দেখা গেছে কিছুই যেন হয়নি তার। বিরাট সংসার ছিল আমাদের। হাজার অনটনের মাঝেও কোনো দিন অভাব টের পেতে দেননি। কয়েকবারই খুব ঋণগস্ত হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু আমরা টেরই পাইনি কিভাবে সামলেছেন তা । আল্লাহর মেহেরবানীতে এমন অবস্থায় তিনি দুনিয়া থেকে গিয়েছেন যে কারো কোনো হক পাওনা ছিল না তার কাছে। গত ২০০৫ সালে আলেম নামধারী কথিপয় দুস্কৃতকারীর ইন্ধনে জামাত- শিবিরের চক্রান্তে জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িয়ে আমাকে লন্ডন যাওয়ার পথে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তখন কিছু দিন কারাগারে কাটাতে হয় ৷ বাবার বয়স ও স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে বাবাকে এ খবর দিতে সতর্কতা অবলম্বন করেছিল পরিবারের লোকজন। দীর্ঘ দিন হয়ে যাওয়ায় বাবা যেন কি করে বুঝে ফেলেছিলেন আমার প্রকৃত অবস্থা। সকল আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন তিনি। শুধু নিজেই ধৈর্য ধরেননি তিনি অধিকন্তু আমার সন্তানদের উল্টো সান্ত্বনা দিয়েছেন। পুত্র বধূকে বলতেন, মা চিন্তা করো না। কিছুই হবে না আমার ছেলের। দেশে-বিদেশে আল্লাহ তাআলা তার সম্মান আরো বাড়িয়ে দেবেন। নিজেকে দুআয় আরো নিবেদিত করে তোলেন। আরো বহু সঙ্কটে তিনি ধৈর্য ধরে এবং আল্লাহর প্রতি নিবেদিত থেকে অতিক্রম করেছেন সেই বৈরীকাল ।

সবার সাথে অতি নম্র ও ভদ্র ব্যবহার ছিল তার। মিষ্টিমুখে সবার সাথে কথা বলতেন। এমনকি যারা চাকর বাকর ছিলেন তাদের সাথেও আত্মীয়ের মতো ব্যবহার করতেন। তার দেখাদেখি আমরাও তাই করতাম। এমন কি বুবু, কাকা, মামা ভেদানুসারে, এই ভাবেই সম্বোধন করতাম আমরা। এমনকি এরা যে আত্মীয় নয় বড় হওয়ার পরই কেবল টের পেয়েছিলাম ।

বড় একটা শুদ্ধতা তার মাঝে আমরা দেখেছি তা ছিল কোনো মানুষের প্রতি কোনো হিংসা দ্বেষ বা ক্ষোভ ছিল না তার অন্তরে। প্রত্যেকের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতাময় এবং বিদ্বেষমুক্ত কল্যাণকামী এক হৃদয় ছিল তার। তার চেহারা দেখেই অন্তরের ছবি পাওয়া যেত।

শায়খে কামিল হযরত মুফতি নূরুল্লাহ রহ. বলেন, অনেক দিন এক সঙ্গে কাজ করেছি কিন্তু হাসিমুখ ছাড়া কখনো সাক্ষাৎ হয়নি তাঁর। জীবনের এই দীর্ঘ পথে অনেকেই অনেক সময় তার ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করেছে বা অনভিপ্রেত আচরণ করেছে কিন্তু সব সময় তিনি ক্ষমা করে দেয়ারই প্রাধান্য দিয়েছেন। সুযোগ পেয়েও কখনোও প্রতিশোধ নিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। তিনি প্রায়ই বলতেন, দুনিয়া থেকে জালিম হয়ে যাওয়ার চেয়ে মাজলুম হয়ে যাওয়াই ভালো ।

অনেকের উপরই নানাভাবে তার ইহসান ছিল। অনেকের তিনি উপকার করেছেন কিন্তু এর জন্য কোনো বদলা পাওয়ার চিন্তা করেননি। কাউকে কোনো বিষয়ে লজ্জা দিয়ে কথা বলতেন না। প্রায়ই আমাদের বলতেন, আমি কাকে কি উপকার করলাম তা মনে রাখি না। কিন্তু আমাকে কে উপকার করলো তা সব সময় খেয়াল রাখি। তার জন্য দুআ করি। সুযোগ পেলে তার বদলা দেয়ার চেষ্টা করি। তোমরাও তাই করবে। খুবই বিনয়ী ছিলেন। নম্র ছিলেন। কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। তবে এই ক্ষেত্রেও ভদ্রতার সীমা ছাড়াত না তার। সুশীলতার ছাপ থাকতো স্পষ্ট।

ধর্মনিষ্ঠা ও ইবাদত বন্দেগী ছিল তার চরিত্রের ভূষণ। যাত্রাবাড়ি মাদরাসা থেকে চলে আসার পর আর কোনো নির্ধারিত কাজে নিজেকে ব্যাপৃত করেননি ৷

রুটিনমাফিক সুশৃঙ্খল জীবন, যেমন আগেও পরিচালনা করেছেন, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সেইভাবেই কাটিয়ে গেছেন। সারা দিন নামাজ, রোজা, , জিকির-আজকার কুরআন তিলাওয়াতে কাটাতেন। তিনি বলতেন, নাবালেগ অবস্থা থেকে রোজা রেখেছেন। কোনো রোজা কাযা করেননি। তবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যাওয়ায় জীবনের শেষ দু’বছর রমজানের রোজা প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাখতে সক্ষম হননি। তিনি বলতেন, জীবনের শুরুতে হয়তো কিছু নামাজ কাযা হয়ে থাকতে পারে তবে তা-ও পরে হিসেব করে কাযা আদায় করেছি। এমনকি জীবনের শেষ অসুস্থতার সময়ও আমরা দেখেছি যে কয়দিন কোমায় ছিলেন সে কয়দিন ছাড়া নামাজের ওয়াক্ত হলেই আগে তা আদায় করে নিতেন। মৃত্যুর প্রায় ঘন্টাখানেক আগে তার হুঁশ ফিরে এসেছিল, বিছানা থেকে উঠতে পারতেন না। এমনকি এপাশ ওপাশও করতে পারতেন না। পেশাব-পায়খানা বিছানাতেই করতে হতো। নলের সাহায্যে তরল খাবার গ্রহণ করতেন। সে অবস্থায়ও শুয়ে শুয়ে তিনি নামাজ আদায় করে নিতেন। ছোট বেলা থেকেই দেখেছি কোনোরূপ পেরেশানী বা অস্থিরতার সম্মুখীন হলে অজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আর পেরেশানী দূর না হওয়া পর্যন্ত নামাজ পড়তে থাকতেন ।

আমার একমাত্র চাচা তিনি বাবার অনেক ছোট ছিলেন। তার পড়াশোনা ইত্যাদি বাবা করিয়েছিলেন। তার এক বছর বয়সের সময় দাদার ইন্তেকাল হয়েছিল। ভৈরব পাটকলের চিফ একাউন্ট অফিসার রূপে অবসর গ্রহণ করেছিলেন এবং বেশ কয়েকবছর আগেই তিনি জান্নাতবাসী হোন। তার বিয়ের সময় বিয়ের দিন কেন জানি তিনি বেঁকে বসেছিলেন। বাবা ভীষণ পেরেশানিতে পড়েন। একমাত্র ভাই, আজ বিয়ের দিন, সব কিছু ঠিকঠাক, কী হবে? কিন্তু আমরা দেখলাম, তিনি অযূ করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। আর নামাজ পড়তেই থাকলেন। দুআ করতেই থাকলেন। শেষে চাচার সুমতি হলো। বিয়ের কাজ ঠিকঠাক মতোই সমাধা হয় এবং সুন্দর দাম্পত্য জীবন হয়েছিল তাদের। স্নেহাষ্পদ হযরত মাওলানা সদরুদ্দীন মাকনুন সাথে থাকতো। অনেকদিন শেষ রাতে ডেকে উঠাতেন। দেখতেন আমার সূরা ইয়াসিন ঠিক আছে কি না। পরে মুখস্থ গড়গড় করে শোনাতেন ।

উদার হস্ত ছিলেন। খুবই দানশীল ছিল তার মন। অক্ষম না হলে কিছু না কিছু দিয়ে বিদায় করতেন প্রার্থীকে।

দুনিয়া বিমুখতা ছিল যেন তার মজ্জায় মজ্জায়। কোনো অর্থ সম্পদ তিনি জমা করে যাননি। নিজের জন্য বা ছেলে মেয়েদের জন্য বলতে গেলে কিছুই করেননি, রেখে জাননি কিছু। কিশোরগঞ্জ শহরের শহরতলীতে সামান্য কয়েক কাঠার একখণ্ড জমিন খরিদ করেছিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন সন্তানদের মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হবে। কিন্তু তখন নির্দিষ্ট সময়ে জামিয়া ইমদাদিয়ার একটা সরকারি অনুদান লেন্স হয়ে ফেরত যাচ্ছিল। পীর ও মুর্শিদ আতহার আলী রহ. তাকে বললেন, দ্বীধাহীন অকুণ্ঠায় তিনি জায়গাটি দিয়ে দিয়েছিলেন মাদরাসাকে। সেই পয়সায় সেখানে দালান ওঠে, যা আজো রশিদ মঞ্জিল নামে প্রসিদ্ধ। ভাবেননি ছেলে মেয়েরা কোথায় থাকবে। এমন কি গ্রামের বাড়িতে বন বাঁশের একটা ঘরও তুলেননি। কখনও আফসোস করতেও পাওয়া যায়নি তাকে। উদ্বেগও ছিল না তার। তৃপ্তি নিয়ে বলতেন, ছেলে মেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছি আল্লাহ চাহেন তো তারাই নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে পারবে।

কয়েক মাস আগে আমেরিকা প্রবাসী দুই ছেলে নতুন করে দালান বাড়ি তোলার ইট নিয়েছিল বাড়িতে। কিন্তু আল্লাহরই মর্জী, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও অহেতুক কিছু বাধায় তা আর হয়ে ওঠেনি। আল্লাহ পাকের হয়তো মর্জী ছিল বাবাকে তার সান্নিধ্যে এই অবস্থাতেই নিয়ে যাবেন দুনিয়া থেকে। সব সময় একটা বিষয়ে তার প্রখর সচেতনতা ছিল যে তার জন্য অন্য কারো কোনো কষ্ট যেন না হয়। এভাবেই নিজেকে রাখতেন হামেশা। হজের সফরে আমিও সঙ্গী ছিলাম তার । সাধারণ সুস্থ ও বলিষ্ঠ তরুণরাও হজের সময় কোনো কোনো ক্ষেত্রে খিটখিটে হয়ে ওঠে। বাবা বার্ধক্য সত্ত্বেও থাকতেন শান্তসমাহিত। গোটা সফরেই খুব লক্ষ রাখতেন তার জন্য অন্য কারো যেন অসুবিধা না হয়। মসজিদে নববীতে, হারাম শরীফে তাকে যেখানেই রেখে যেতাম অন্যান্য তওয়াফ ইবাদত বন্দেগী করে ফিরে এসে সেই জায়গায় তাকে বসা পেতাম।

মীনায় অজু করতে যেয়ে একবার হারিয়ে ফেলেছিলেন বাসা। ভুক্তভোগীরা জানেন, মীনায় তাঁবু হারিয়ে ফেললে তা পাওয়া কত কষ্টের। আরবী না জানা মানুষের জন্য তা হয়ে যায় আরো দুর্ভোগের। খুঁজতে খুঁজতে অনেকেই হারিয়ে যায় সেখানে। আমরা যখন টের পেলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। যা হোক, সাথীরা সবাই মিলে দু’জন দু’জন করে টিম করে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লাম তাঁকে খুঁজতে। আমরা স্বাভাবিকভাবেই দূর দূর উপত্যকায় খুঁজতে লাগলাম। আমাদের এক টিম কাছেই এক জায়গায় তাকে পেয়ে গেলেন। তিনি নিরুদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন। এক ছায়ায় বসে তাসবীহ পড়ছেন। যা হোক, নিয়ে আসার পর, আমাদের উদ্বিগ্নতা দেখে বললেন, আমি যখন বুঝতে পারলাম যে আমি হারিয়ে গেছি তখন ভাবলাম, এক জায়গাতেই বসে থাকি । আল্লাহকে ডাকি । ছোটাছুটি করলে আবার এমন হয় যে তোমরা এ দিকে গেলে আর আমি অন্য দিকে সরে পড়লাম। আর এক জায়গায় থাকলে অবশ্যই তোমরা আমাকে পাবে। আমার বিশ্বাস ছিল তোমরা আসবে খুঁজতে।

তাই এক জায়গায় বসে আসল কাজ আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকলাম। ঘটনাটি তার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতারও পরিচয় বহন করে । এমনকি অস্তিম অসুস্থতার সময়ে, যখন হুঁশ আসত তখনও দেখতাম এই চেষ্টা করতেন যে কারো যেন তার জন্য কষ্ট পোহাতে না হয়। বিপরীত কিছুতেও কোনো ধরনের বিরুক্তি প্রকাশ করতেন না, খিটমিট করতেন না।

বাবার পরিবারে অনেকেই কুরআনে হাফিজ ছিলেন। কনিষ্ঠ পুত্র মারুফ, দৌহিত্র হুসাইনুল বান্না, নাতি মাকনুন, মাকতুম, সামনুন, নাতনী তীনা এরা সবাই হাফিজ। বাবা এই কিছু দিন আগেও এদের এক একজনকে বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ নাতি মাকনুনকে ডেকে বলতেন, (আর সেই বাবার খেদমত করেছে সবচে বেশী) এই একজন হাফিজ কতজনকে বেহেস্তে নিতে পারে? কম পক্ষে দশজন। শুনে আল্লাহর শোকর করতেন। আর আল্লাহর রহমতে বুক উঁচু করে বলতেন, আমার আর চিন্তা কি? আমার পরিবারে এতজন হাফিজ। ইনশাআল্লাহ আমার বেহেস্তে কোনো অসুবিধা হবে না। অপার এক আশান্বিত সুর ঝংকৃত হতো তার কণ্ঠে । আবার হয়তো কিছুক্ষণ পরে আমাকেও ডাকতেন। কুরআন করীমের এই আয়াত তেলাওয়াত করতেন, অর্থাৎ বলুন, হে নবী, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছো অবশ্যই এর সম্মুখীন হতে হবে। তোমাদের পরে সেই মহান গায়েব অধিপতি অদৃশ্য ও দৃশ্য সব কিছু সম্পর্কে যিনি পরিজ্ঞাত সে সত্তার দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। তোমরা দুনিয়াতে যা করেছ সে বিষয়ে তিনি তোমাদের খবর দিবেন।

এই আয়াত তেলাওয়াত করে বলতেন, একবার মাওলানা আতহার আলী রহ. এই আয়াতের এমন তাফসীর শহীদী মসজিদে আমাদের সামনে করেছিলেন যে তিনি নিজেও কেঁদে আকুল হয়ে পড়েছিলেন এবং যারা সামনে ছিল সবাই আখিরাতে জবাবদিহির ভয়ে কেঁদে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। এরপর তিনি এই তাফসীর আমাদের শুনাতেন যা তার স্মরণে ছিল এবং আখিরাতের ভয়ে কাঁদতে থাকতেন৷

হাদীসে আছে খাওফ ও রাজা আশা ও ভয়ের নাম ঈমান। কখনও তাকে দেখতাম একেবারে ভয়ে কুঁকড়ে যেতেন আবার কখনও আশায় বুক বেঁধে উজ্জীবিত হয়ে উঠতেন। অনেক সময় গুনগুন করে গাইতেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটা কলি। কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে ভ্রমিব, দেখা কি পাব না? দেখা কি পাবো না, গাওয়ার সময় কি যে এক অপার্থিব আর্তি মনোহর সুরে বেজে উঠতো। অনন্তময়ের দিদারের, তাঁর মহা সান্নিধ্যের আকুতি নিয়েই তিনি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে মহামহিমের কুদরতী কাননে কাননে, বেহেস্তের শান্তিময় উদ্যানে উদ্যানে প্রজাপতির ন্যায় ছুটে বেড়ানোর অনন্ত আকাঙ্ক্ষায় দেখা কি পাব না, দেখা কি পাব না গাইতে গাইতে চলে গেলেন। ২০০৯ সালের ২৪ মার্চ রবিবার বাদ যুহর ইন্তেকালের আগে শেষ শব্দ ছিল ‘আল্লাহ’। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

হে পিতা মোর, অনন্ত দয়াময় ডেকে নিলেন তোমাকে, অনন্ত জান্নাতে পরমতমের রহমতী ক্রোড়ে হোক তোমার ঠিকানা।

ওগো দয়াময়, সেই আলা ইল্লীন মহাসুখ ধামে পৌঁছে দিও আমাদের হাজারো সালাম। পৌঁছে দিও আমাদের নেক আমলের ছোঁয়া। আমীন, আমীন, ছুম্মা আমীন। ইয়া আর হামার রাহিমীন।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের সাড়া জাগানো সীরাত গ্রন্থ ‘আল্লাহর পরে শ্রেষ্ঠ যিনি’ রকমারী থেকে সংগ্রহ করতে ছবিতে ক্লিক করুন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *