একটি কুকুরের অপেক্ষা

একটি কুকুরের অপেক্ষা

আব্দুর রহমান রাশেদ

আমার কখনোই কোনো পোষা প্রাণী ছিল না। না কুকুর, না পাখি, না বিড়াল। এগুলো শখের বসে মানুষ করে। যারা প্রাণী পুষতে পছন্দ করে, তাদের কাছে প্রাণীগুলো কোনো ভয়ের না। এইসব পোষা প্রাণী তাদের অনেক বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। এজন্য ইউরোপে কুকুরের নামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লিখে দেয়ারও ঘটনা আছে।

বাংলাদেশে আগে এতো বড় পরিসরে কুকুর পোষা হতো না। আগেও আমাদের দেশের লোকজন কুকুর পালত, কিন্তু কুকুরকে থাকতে হতো ওই বারান্দাতেই, ধুলোবালি আর আর আবর্জনায়। কেউ কেউ মাঝে মাঝে কুকুরকে গোসল করাতেন। তবে ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। যত বিশ্বস্ত কুকুরই হোক না কেন?

কী সুন্দর লাগে! যখন দশ বারোটা কুকুরছানা একে অপরের সাথে খেলা করে। ছোট ছোট চোখ, ছোট ছোট পা, ছোট ছোট লেজ নাড়ানোর দৃশ্য আমার অনেক মন কাড়ে।

কিন্তু ইদানিং আমাদের দেশের ধনীরা ইউরোপিয়ান-আমেরিকান লাইফষ্টাইল বেছে নিয়েছে। এখন আমাদের দেশের ধনীরা কুকুর পোষে, বিড়াল পোষে, শুধু যে পোষে তাই না, পোষা কুকুর ও বিড়াল স্থান পায় একই বিছানায়। এটাকে গৃহপালিত পশুর উন্নতি বলবো নাকি মানুষের অবনতি বলবো। আমি কনফিউজড!

ছোটবেলায় আমি কুকুর অনেক ভয় পেতাম। যে রাস্তায় কুকুর থাকতো সেই রাস্তা দিয়ে যেতাম না। একবার একটা কুকুর আমাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করেছিল, ভয়ে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করলাম। সেটা ছিল বৃথা চেষ্টা। কুকুরটিও আমাকে দৌড়ে অনুসরণ করলো, আর তার ঘেউ ঘেউ ডাকে মুহুর্তেই আশেপাশের আরো দশ-বারোটি কুকুর এসে পড়ল। আমি বুঝলাম, আমি হেরে গেছি, তাই অসহায়ের মত আত্নসমর্পণ করলাম। যাই হোক, ভাগ্য ভালো ছিল আমার, আশেপাশের কয়েকজন এসে সে যাত্রায় আমাকে উদ্ধার করলো। তখন থেকে আমার কুকুর ভীতি বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন: ঈদ অন্বেষণ | আব্দুর রহমান রাশেদ

কুকুরছানা আমার অবশ্য বেশ ভালো লাগে। কী সুন্দর লাগে! যখন দশ বারোটা কুকুরছানা একে অপরের সাথে খেলা করে। ছোট ছোট চোখ, ছোট ছোট পা, ছোট ছোট লেজ নাড়ানোর দৃশ্য আমার অনেক মন কাড়ে। কুকুর শীতকালে বাচ্চা প্রসব করে। কুকুরছানাদের ঘিরে গ্রামে অন্যরকম আনন্দ খেলা করে শিশুদের মাঝে। দেখাশুনার সুবিধার্থে শিশুরা কুকুরছানাগুলোকে নিজেদের মাঝে ভাগাভাগি করে নেয়। সবাই খুব যত্ন করে বাচ্চাগুলোকে। দোকান থেকে রুটি কিনে দেয়। কুকুরছানাগুলো ছোট ছোট মুখ দিয়ে ছিড়ে ছিড়ে খায়। খুবই আবেগপ্রবণ দৃশ্য এটি। কেন যে কুকুর ছানাগুলো বড় হয়!

দেখলাম, কুকুরটি যেভাবে ছিল সেইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। যেন সে আমার কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে।

মানুষ ও কুকুরের মাঝে একটা মিল পাওয়া যায়। মানুষ তার শৈশবের জীবনটা মিস করে। বারবার শৈশবে ফিরে যেতে চায়। শৈশবে সবাই তাকে কতো আদর করে, বড় হলে সেই আদর-সোহাগ, মায়া-মমতা হারিয়ে যায়। ঠিক সেইভাবে কুকুরছানাগুলোও অনেক আদর পায়। আর বড় হলে মানুষের লাথি খায়!

আমি একটা ছেলেকে জানতাম, তার কুকুর পোষার অনেক শখ ছিল। সে ঘুরে ঘুরে কুকুরছানা সংগ্রহ করতো। মাঝে মাঝে সে অন্য এলাকা থেকে বস্তায় ভরে কুকুরছানা চুরি করে আনতো। আমি দেখেছি, তার পিছন পিছন সবসময় চার-পাঁচটা কুকুর ঘুরঘুর করতো।

একবার গ্রীষ্মের এক দুপুরে একটা কুকুর আমাদের বাসার পিছনের দরজার সামনে এসে জিহ্বা বের করে খাবারের সন্ধান করছিল। খুবই নোংড়া ছিল তার শরীর। সারা গায়ে আবর্জনা লেগে ছিল। নিশ্চয় খাবারের সন্ধানে ময়লা পানিতে নেমেছিল। কুকুরটি আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমি কখনো কোন প্রাণীর সাথে কথা বলিনি, কিন্তু সেইদিন কুকুরটিকে বললাম, ‘দাঁড়া! দেখি, তোর জন্য কিছু আনতে পারি কি না’। অনেক খোঁজাখুঁজি করে আটার রুটি নিয়ে আসলাম। দেখলাম কুকুরটি যেভাবে ছিল সেইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। যেন সে আমার কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে।

তারপরের কয়েকদিন সে নিয়মিত আসতে লাগলো। আমারও ভালো লাগলো। আমি কাজের সন্ধানে বাড়ি ত্যাগ করলে কুকুরটিও আসা বন্ধ করে দেয়। আমি এখনো বাসায় আসলে কুকুরটির অপেক্ষা করি। বাসার পিছনের দরজা খুলে ঘন্টার ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকি তার জন্য। কিন্তু সে আর আসে না। মনে হয়, আমার উপর রাগ করেছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *