একটি কৃতঘ্ন জাতির গল্প || পর্ব ১

একটি কৃতঘ্ন জাতির গল্প || পর্ব ১

  • ফাহমিদা মুন্নী

 ২রা জানুয়ারী, ১৪৯২ সাল। এদিন আনুষ্ঠানিক ভাবে খ্রিষ্টান রাজা ফার্দিনান্দ আর রাণী ইসাবেলার হাতে স্পেনে প্রায় ৮০০ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটেছিল।

এদিন মুসলিমরা স্বভাবতই বিপর্যস্থ ছিল। কিন্তু স্পেনে মুসলিমদের এই দীর্ঘ শাসনের অবসানে মুসলিমদের থেকেও বেশি বিপর্যস্থ হয়েছিল আর একটি জনগোষ্ঠী। যারা মুসলিম শাসনের নীচে সম্মান, মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে নিশ্চিন্তে আর নির্ভরতায় শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছিল। আর তারা হল ইহুদী জনগোষ্ঠী।

ইহুদীদের চিন্তিত হবার সঙ্গত কারণ ছিল। কারণ, মধ্যযুগে শত শত বছর যাবত ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চলে খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীদের হাতে ইহুদীরা ভয়ঙ্কর ভাবে নির্যাতিত হয়েছিল।

বস্তুত, খ্রিষ্টানরা ইহুদীদের যীশু খ্রিষ্টের (ঈসা আঃ) হত্যাকারী আর শয়তানের অনুসারী মনে করতো।

তাই তারা তাদের চিত্রশিল্প, সাহিত্য, নাটক সবকিছুতে ইহুদীদের অত্যন্ত ঘৃণ্য ভাবে চিত্রায়িত করতো। যা সমাজে ব্যাপক ভাবে ইহুদী বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতো।

“এন্টিসেমিটিজম” বা “ইহুদী বিদ্বেষ” এর ধারণাটি খ্রিষ্টানদের দ্বারাই প্রবর্তিত হয়েছিল। আর অগণিত ইহুদী এই ভয়াবহ ধারণার নির্মম স্বীকার হয়েছিল।

ধর্মান্ধ খ্রিষ্টানরা ১৩৪৯ সালে ইউরোপের ভয়াবহ প্লেগ মহামারীকে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র বলে দাবী করে এবং এ অপরাধে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে তারা হাজার হাজার ইহুদীকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে।

এছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময় ইহুদীদের গণহারে বিতাড়িত করা হয়। ১২৯০ সালে ইংল্যান্ড থেকে, ১৩০৬ সালে ফ্রান্স থেকে ও ১৩৪৮ সালে সুইজারল্যান্ড থেকে এবং ১৩৯৪ সালে জার্মানী থেকে ইহুদীরা বিতাড়িত হয়।

৭১১ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খিলাফতের আর্মি জেনারেল তারিক-বিন-যিয়াদ স্পেনে মুসলিম শাসনের সূচনা করেছিল। এরপর স্পেনে মুসলিম শাসনের নীচে ইহুদীদের জন্য রচিত হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ।

রেমন্ড পল শাইন্ডলিন তার “দ্যা জিউস ইন মুসলিম স্পেন” বইতে লিখেছেন,

“(স্পেনে খ্রিষ্টান শাসনামলে) ইহুদীরা বারে বারেই নির্যাতনমূলক আইন ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের স্বীকার হয়েছিল…..(কিন্তু) ইসলামী শাসনে ইহুদীদের প্রতি আচরণটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।”

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময় ইহুদীদের গণহারে বিতাড়িত করা হয়।

“কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তেরশত শতাব্দী পর্যন্ত ইহুদীরা সামগ্রিক ভাবে, খ্রিষ্টান শাসন থেকে ইসলামী শাসনের নীচে বহুগুনে উত্তম জীবনযাপন করেছিল।”

“যদিও (স্পেনে) মুসলিমদের জয়যাত্রার শতবর্ষ পূর্ব থেকে (খ্রিষ্টান) ভিসিগথ সাম্রাজ্যে ইহুদীরা বসবাস করছিল। কিন্তু মুসলিম শাসনের নীচে বসবাস করাটাকে তারা অধিকতর শ্রেয় মনে করেছিল।”

“এটা এমন পর্যায়ে ছিল যে, স্পেনে মুসলিম সেনাদের অগ্রযাত্রায় তারা কেবল উল্লসিত হয়েছিল। ইহুদীরা তাদের শহরগুলোকে স্বেচ্ছায় আক্রমণরত মুসলিম সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল।”

ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে কিভাবে মুসলিম স্পেনে ইহুদীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ব্যবসাবাণিজ্যে ব্যাপক অগ্রসরতা লাভ করেছিল।

তারা গণিতবিদ্যা, জোর্তিবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র, রসায়ন ও ভাষাবিদ্যায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল এবং মুসলিমদের তত্ত্বাবধানে ইহুদীরা হিব্রু গ্ৰামারের নিয়ম-কানুনকেও বিন্যস্ত করেছিল।

খ্রিষ্টান শাসনের নীচে যেখানে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, সেখানে মুসলিম শাসনামলে, ইহুদীরা মূলধারার রাজনীতি ও অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে সম্পৃক্ত ছিল।

শুধু তাই নয় মুসলিম স্পেনের আর্থিক প্রাচুর্যের ভাগিদারও তারা হয়েছিল। তারা মার্বেল, সোনা-রুপা, লোহা ও কপার রপ্তানী করতো। আর সেইসাথে কারুশিল্পী ও চিকিৎসক হিসেবেও তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো।

বস্তুত, মুসলিম শাসিত স্পেনে ইহুদীদের আহলে কিতাব হিসাবে বিবেচনা করা হত এবং তাদের ইসলাম প্রদত্ত সকল অধিকার প্রদান করা হত।

কিন্তু স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান হবার সাথে সাথে ইহুদীদের উপর আবারও নেমে আসে ইহুদী বিদ্বেষী খ্রিষ্টানদের নৃশংস নির্যাতনের খড়গ।

রাজা ফার্দিনান্দ আর রাণী ইসাবেলা “আলহামরা ডিক্রী” নামে ইহুদী বিদ্বেষী ভয়ঙ্কর এক ডিক্রী জারি করে স্পেন থেকে সকল ইহুদীকে নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা করে।

আর, তাদের এ ঘৃণ্য পরিকল্পনা থেকে ইহুদীদের রক্ষা করতে সে সময় আবারও মুসলিমরাই এগিয়ে এসেছিল। তবে, লক্ষ লক্ষ ঐসব অসহায় ইহুদীদের রক্ষা করতে যে মুসলিমরা এগিয়ে এসেছিল – তারা এসেছিল পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে।

(চলবে)

১৫/১১/২০২৩ ইং।

লেখক, আরবী ভাষা শিক্ষক ও সৌধশিল্পী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *