একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে যুদ্ধংদেহী পরিবেশ

একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে যুদ্ধংদেহী পরিবেশ

একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে যুদ্ধংদেহী পরিবেশ

মা ন জু ম  উ মা য়ে র

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল হরতাল, সভা এবং শোভাযাত্রা। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ভাষা সৈনিক গাজীউল হক কর্মসূচি শুরুর আগের অবস্থার স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে, ‘রাত সাড়ে তিনটার সময় বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেশিয়াম গ্রাউন্ডের মধ্য দিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ভেতরে ঢুকি। পাঁচিল টপকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকি এবং রাতের শেষ সময়টুকু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে দিই। ভোর হলো- সূর্য উঠলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম যিনি বিশ্ববিদ্যালয় গেট পার হয়ে ভেতরে ঢুকলেন, তিনি হলেন মোহাম্মদ সুলতান। তাঁর সঙ্গে এস এ বারী এ টি এবং আরো দুজন।’

‘আমরা দুজন টুকরা কাগজ, সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে কিছু চিঠি লেখা শুরু করলাম বিভিন্ন স্কুলে এবং কলেজে। চিঠিতে লেখা হয়েছিল ‘ছোট ভাইয়েরা, সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তোমরা দুজন দুজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসো।’ গাজীউল হক ও মোহাম্মদ সুলতান এমনি ধরনের চিঠি লিখে পাঠালেন ঢাকা কলেজে, জগন্নাথ কলেজে। মেডিক্যাল কলেজের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করলেন আমাদের আরেক বন্ধু। নাম মঞ্জুর- ডাক্তার মঞ্জুর। বাড়ি ছিল নওগাঁ। এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৈনিক ছিলেন তিনি।

পূর্ব প্রস্তুতি অনুয়ায়ী সেদিন সকাল ৮টার পর থেকেই বিভিন্ন হল, স্কুল-কলেজ থেকে দুজন দুজন করে ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জমা হতে শুরু করে। সাড়ে নয়টার দিকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বক্তব্য জানানোর জন্য কালো শেরওয়ানী এবং মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ পরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন শামসুল হক। ১৪৪ ধারা যে ভাঙ্গা ঠিক হবে না এটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি।

সেদিনের সকালের প্রস্তুতি সম্পর্কে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতানের স্মৃতিচারণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার কথায় উঠে এসেছে সেদিনের আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তের কথা। তিনি বলেছেন, একুশে ব্রেুয়ারির সকালে নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহ কায়সার এবং মোহাম্মদ তোয়াহা আসেন, এদেরকে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে যাচ্ছি একথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিই। আধঘণ্টা পর তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাবেন বলে জানান তারা। ইতিমধ্যে রাতভর বহু পোস্টার লেখা হয়। শহীদুল্লাহ কায়সার এবং তোয়াহা সাহেব ফিরে এসেছিলেন এবং তারা বললেন, কমিউনিস্ট পার্টি মনে করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা ঠিক হবে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিয়েই নেয় তাহলে যেন তা সত্যাগ্রহীর আকারে করা হয়। অর্থাৎ আমরা যে মিছিল করতে যাচ্ছি, সে মিছিল ১০ জন ১১জন করে এক একটি দল করে যেন একে একে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়। ১৪৪ ধারা জোর করে ভেঙ্গে সমস্ত আন্দোলনটি যাতে বিশৃংখল-বিক্ষিপ্ত রূপ না নেয় তার জন্যই আমরা এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়েছিলাম।’

এরইমধ্যে পুলিশ বহু ট্রাক বাস বিশ্ববিদ্যালয়ে কাছাকাছি জমা করে রেখেছে দেখলাম। সমগ্র এলাকাটিতে একটি যুদ্ধংদেহী পরিবেশ বিরাজ করছিল। এই যুদ্বংদেহী পরিবেশের মধ্যেই রচিত হলো মহান ভাষা আন্দোলন তথা বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নতুন অগ্নিঝরা ইতিহাস।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *