- ফাহমিদা মুন্নী
আমার ছেলেবেলায় আমি একটি ইসলামী মূল্যবোধ সম্পন্ন পরিবারে বড় হয়েছি। আমার বাবা এককালে সেক্যুলার রাজনীতির সমর্থক হলেও পরবর্তীতে ইসলাম নিয়ে রীতিমত পড়াশোনা করে জীবনের মধ্যগগণে জেনে বুঝে তার জীবন পরিবর্তন করেছিলেন।
সুতরাং, একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, তিনি সমাজের প্রচলিত ইসলামী রীতিনীতির অন্ধ অনুসারী ছিলেন না। বরং, আল্লাহ তাআলা যা বলেছেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন বা করেছেন, তা তিনি সমাজের বিরুদ্ধে গিয়েও অবলীলায় বলতেন।
এ কারণেই, ছেলেবেলা থেকেই ইসলামের মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের সব ভাইবোনেরই মোটামুটি স্বচ্ছ একটি ধারণা ছিল। আমরা সেই ছেলেবেলা থেকে তাওহীদের গুরুত্ব ও শিরকের ভয়াবহতা যেভাবে বুঝতাম, আবার, একই ভাবে সালাত ও সওম কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেটাও জানতাম।
কিন্তু, সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় হল, ইসলাম সম্পর্কে আমার বাবার এত সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, আমি আমার ছেলেবেলায় মসজিদে নারীদের অধিকার সম্পর্কে কোনকিছুই জানতাম না। কারণ, এ সম্পর্কে আমি আমার বাবার মুখে কখনো কিছু শুনিনি।
প্রতি শুক্রবার আমার দুই ভাইকে নিয়ে আমার বাবা জুমার সালাত আদায় করতেন। প্রতি রামাদানে আমার দুই ভাই আমার বাবার সাথে তারাবীহ সালাত আদায় করতো। আর, দুই ঈদের দিন সকালে আমার বাবা তার দুই পুত্র সন্তানকে নিয়ে ঈদের সালাত আদায় করতেন।
তাই, আমি সবসময়ই জানতাম যে, মসজিদ সম্পর্কিত সকল ইবাদত একচ্ছত্র ভাবে শুধুমাত্র পুরুষজাতির জন্য সংরক্ষিত, যার সাথে নারীজাতির কোন প্রকার কোন সম্পর্ক নেই।
যাই হোক, পরবর্তীতে, বহু বছর পরে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করার পর, আমি আমার ধর্ম ও বিশ্বাসকে নতুন ভাবে জানার চেষ্টা করি। সেটা ছিল ২০০০ সালের কথা। তখন ইন্টারনেট বা স্মার্ট ফোনের যুগ ছিল না। তাই, এদেশে প্রকাশিত ইসলাম সম্পর্কিত হাতেগোনা কিছু বই-ই ছিল আমার একমাত্র সম্বল।
মনে আছে, তখন “রাসুলের যুগে নারীদের মসজিদে গমনাগমন” নামের একটি বই পড়ে আমি রীতিমত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।
আমি তখন বইটি পড়েছি আর শুধু অবাক হয়ে ভেবেছি, কোন কারণে, এ দেশের লক্ষ-কোটি নারী যুগ যুগ ধরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা:) প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে?
কোন কারণে, নারীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অধিকারকে দীর্ঘ সময় ধরে অবেহেলা করা হয়েছে?
কী উদ্দেশ্যে, নারীদের মসজিদে সালাত আদায়ের অনুমতি সংক্রান্ত, কিংবা, রাসুল (সা:) এর যুগে নারী সাহাবীদের মসজিদে গমনাগমন সম্পর্কিত অসংখ্য সহীহ হাদিসকে আড়াল করে রাখা হয়েছে?
আমি জানি, এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে বিভিন্ন মানুষ তাদের নিজস্ব যুক্তিতর্ক, কিংবা, দলিল-প্রমাণ নিয়ে হাজির হবেন। কিন্তু, আমি এই মূহুর্তে এ বিষয়ে কারো সাথে তর্কে যাবো না।
শুধু যারা নারীদের মসজিদে সালাত আদায়ের বিপক্ষে, তাদের আমি গভীর ভাবে এই মুসলিম অধ্যুষিত সমাজের দিকে লক্ষ্য করতে বলবো।
একটু ভেবে বলুন তো, আপনাদের মা, বোন কিংবা কন্যাদের যখন আপনারা মসজিদে থেকে বিতাড়িত করে দিয়েছেন, তখন তারা কাদের সহজ শিকারে পরিণত হয়েছে?
উত্তরটা বোধকরি খুব কঠিন না। অবশ্যই তারা সেক্যুলার ও ইসলাম বিদ্বেষীদের সহজ শিকারে পরিণত হয়েছে।
ইসলাম বিদ্বেষীরা তাদের বুঝিয়েছে, “দেখ! ইসলাম তো নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছে।”
কারণ, ইসলাম সম্পর্কে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী এই সমাজ ইসলামের দৃষ্টিতে এই পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্ট স্থান “বাজারে” নারীদের অবাধ যাতায়াতের অনুমোদন দিয়েছে, কিন্তু, সেই একই সমাজ এই পৃথিবীর সবচাইতে উৎকৃষ্ট স্থান “মসজিদে” নারীদের প্রবেশাধিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করার পর, গত বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি এই যুক্তি অব্যাহত ভাবে শুনে আসছি যে, নারীরা মসজিদে আসলে নাকি ফিতনার সৃষ্টি হবে।
নারীদের মসজিদে আসার সুফল সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে থেকে দুটো অভিজ্ঞতা আমি বলতে চাই।
প্রতি রামাদানের মতো এবারের রামাদানেও আমি তারাবীহ সালাত মসজিদে জামায়াতে আদায় করেছি। রামাদান মাসের ৭/৮ দিন পার হবার পর, একদিন এক নারী আমার পাশে এসে বসলেন।
আমি সাধারণত তারাবীহ সালাতের বেশ আগে মসজিদে যেতাম, আর, বসে বসে কোরআন পড়তাম। সেদিনের পর থেকে সে প্রতিদিন আমার পাশে বসতো, আর, আমি তাকে কোরআনের আয়াতের অর্থ বুঝিয়ে দিতাম।
উনার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিল না। কিন্তু, উনার পোশাক দেখে আমি উনাকে একজন প্র্যাকিটিসিং মুসলিম বলেই ধারণা করেছিলাম।
পরবর্তীতে উনি নিজেই একদিন আমাকে বললেন, “আপা, আমি একজন সংগীত শিল্পী। আমার স্বামী আমাকে গায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। কিন্তু, আমি আর গান গাইতে চাই না। আমি আপনার মত করে আরবী ভাষায় কোরআন বুঝতে চাই। আর, আমি আমার জীবন পরিবর্তন করতে চাই।”
বলতে পারেন, তার মনমানসিকতার এই পরিবর্তনের পেছনে কোন বিষয়টি মূখ্য ছিল?
মসজিদের দরজাগুলো যদি আমরা সেক্যুলার জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নারীদের জন্য বন্ধ করে দেই, তাহলে, তাদের সত্যের আহবান শোনার জন্য তারা কোথায় যাবে?
আপনারা কি আশা করেন যে, নাটক, সিনেমা কিংবা সংগীতানুষ্ঠানের পরিচালকেরা তাদের ইসলামের দিকে আহবান করবে?
এবারের রামাদানের শেষ জুমার দিনের ঘটনা। সেদিন আমি বেশ আগে মসজিদে গিয়ে কোরআন তিলওয়াত করছিলাম। কিছুক্ষণ পর, আমার পাশে সালোয়ার-কামিজ পরিহিত তরুণী এক নারী এসে বসলো। সে তার মাথা ও শরীর সুন্দর করে বড় একটি ওড়না দিয়ে ঢেকে এসেছিল।
আমার কোরআন পড়া শেষ হবার পর সে আমাকে বলল, “আপা, আমি এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে আপনার কোরআন পড়া শুনছিলাম। আমার খুব ভালো লাগছিল।”
তারপর সে বলল, “আপা, আমি একজন জিম ট্রেইনার। পুরুষ ও নারী সবাইকেই ট্রেনিং দেই। প্রতি জুমার দিন আমি এই মসজিদে আসার চেষ্টা করি। আমি জানি যে, আমার পেশা, আর, যে সমস্ত পোশাক আমি পড়ি তা ইসলাম সম্মত নয়। কিন্তু, আমি কি করবো তা বুঝে উঠতে পারি না। কারণ, এই চাকরীটা আমার প্রয়োজন।”
আমি তখন বললাম, “আপনি যাই করুন না কেন, মসজিদে আসা কখনও ছেড়ে দেবেন না। আর, সেইসাথে, আল্লাহ’র দরবারে অন্তর থেকে দোয়া করতে থাকুন। আল্লাহ অবশ্যই আপনার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।”
বলতে পারেন, সেক্যুলার জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত একজন জীম ট্রেইনার কিভাবে জানলো যে, তার পেশা আর পোশাক ইসলাম সম্মত নয়?
প্রতি জুমায় মসজিদে এসে জুমার খুতবা শোনা কি তার এই চিন্তার পেছনে বিরাট এক ভূমিকা পালন করেনি?
প্রতি জুমায় এসে জুমার খুতবা শোনা কি তাকে তার জীবন নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেনি?
প্রখ্যাত দায়ী নোমান আলী খান নারীদের মসজিদে গমনাগমন সম্পর্কিত তার এক লেকচারে একবার বলেছিলেন,“কিছু আলেমরা বলেন, নারীরা যদি আরো ভালোভাবে পোশাক পরিধান করতো, তাহলে তাদের মসজিদে আনা সহজ হত। কিন্তু, আমরা জানি যে, পোশাক পরিধান করাটা একজন ব্যক্তির কাজ। আর, ব্যক্তির কাজ সবসময়ই তার বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত।
আমাদের (ধর্মীয়) বিশ্বাস যখন দৃঢ় হয়, তখন আমাদের কাজগুলোও ইসলামসম্মত হয়। হিসাবটা খুব সহজ। আর, বিশ্বাসকে দৃঢ় করার সবচেয়ে উত্তম স্থান হচ্ছে মসজিদ। সুতরাং, তাদের সূত্র অনুযায়ী তারা যদি বলতে চান যে, নারীদের কর্মকান্ড শুদ্ধ নয়, তাই তাদের মসজিদে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাহলে, প্রশ্ন হল, যে বিশ্বাস তাদের কর্মকান্ডকে পরিবর্তন করবে, সেই বিশ্বাসকে দৃঢ় করার জন্য নারীরা কোথায় যাবে?” (চলবে…)
লেখক : গবেষক ও স্থপতি
[মতামত বিভাগের লেখার দায়ভার সম্পূর্ণ লেখকের। পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ এর সাথে যুক্ত নয়।]