এদেশের মসজিদগুলোর দরজা নারীদের জন্য কবে উম্মুক্ত হবে?

এদেশের মসজিদগুলোর দরজা নারীদের জন্য কবে উম্মুক্ত হবে?

(পর্ব – ১)

  • ফাহমিদা মুন্নী 

এখন থেকে প্রায় বিশ বছর আগের কথা। কর্মজীবনে আমি তখন বেশ নতুন। প্রফেশনাল কাজে একদিন আমি দুপুরবেলায় হাতিরপুল গিয়েছিলাম। ঘড়ি দেখে বুঝলাম দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। তাই, ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে বাসায় গিয়ে জোহরের নামায পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই ভাবলাম, এলাকার একটি মসজিদে গিয়ে অন্তত ফরজ নামাযটা পড়ে নেই।

এরপর আমি ওই এলাকায় বেশ বড় একটি মসজিদ খুঁজে বের করলাম। মসজিদের একজন খাদেমকে বললাম, ভাই! আমাকে কি একটু নামায পড়ার ব্যবস্থা করে দেবেন?এক কোণায় একটু জায়গা দিন। আমি ফরজ নামাযটা পড়েই চলে যাব।

মসজিদের খাদেম খুব বিরক্ত নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই মসজিদে মেয়েদের নামাজের কোন ব্যবস্থা নেই। আপনি অন্য কোথাও যান।

আমি অনেক অনুনয় করে বললাম, ভাই! আমার এই মূহুর্তে অন্য কোথাও যাওয়ার অবস্থা নেই। আর বাসায় যেতে যেতে নামাজের ওয়াক্ত পার হয়ে যাবে।

সে উত্তরে বলল, সেটা আমার জানার বিষয় না। আপনি এখানে নামাজ পড়তে পারবেন না।

হতাশ হয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার নামাজ যদি এখন কাজা হয় তার জন্য কে দায়ী থাকবে? এত বড় একটা মসজিদ! আমাকে কোণায় একটুখানি জায়গা দেয়া যায় না?

ওই মসজিদে আমার সেদিন নামাজ পড়া আর হয়নি। আমি শুধু বুক ভরা কষ্ট নিয়ে সেদিন সেখান থেকে চলে এসেছিলাম।

তখন আমি বিশৃঙ্খলার জীবন পার করে কেবলই ধর্ম-কর্ম মানতে শুরু করেছি। তাই মসজিদের একজন খাদেমের এই ব্যবহার সেদিন আমার মনে ইসলাম সম্পর্কে বিরাট প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম, ইসলাম কি তবে নারীদের মসজিদে প্রবেশাধিকার দেয়নি?

আকেটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। প্রায় আট-দশ বছর আগের কথা। আমার বাবার বাড়ির পরিবারের সবাই মিলে বিশাল এক বাস ভাড়া করে সেদিন আমরা খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। গন্তব্য মংলাবন্দর হয়ে সুন্দরবন।

আমরা রাতে রওনা হয়েছিলাম, যেন সকালবেলায় মংলা বন্দর পৌঁছাতে পারি। মংলা বন্দর যখন প্রায় একঘন্টারও বেশি দূরত্বে, সেই সময় ফজরের আজান দিল। আমরা হিসেব করে দেখলাম, এখানেই কোথাও কোন মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে নিতে হবে। তা না হলে মংলা বন্দর পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য উঠে যাবে।

তাই, পথেই হাইওয়ের উপর একটি মসজিদে আমরা গাড়ি থামালাম। গাড়ি থেকে পুরুষেরা একে একে বাস থেকে নেমে মসজিদে নামাজ পড়তে চলে গেল। কিন্তু আমরা এতগুলো নারী কোথায় নামাজ পড়বো তার কোন ব্যবস্থা তারা করে গেল না। অথচ গাড়ির বেশির ভাগ যাত্রীই মহিলা ছিল।যাদের উপর নামাজ আদায় করা পুরুষদের মতই ফরজ ছিল।

আমাদের ওজু করারও প্রয়োজন ছিল। কারণ, গাড়ির মধ্যে আমরা অনেকেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। তখন আমি খুব চিন্তিত অবস্থায় গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। মসজিদের গেটে গিয়ে একজন খাদেমকে বললাম, ভাই! এই বাসে অনেক মহিলা যাত্রী। আমাদের ফজরের নামাজ আদায় করতে হবে। আপনি আমাদের মসজিদের এক কোণায় নামাজ পড়ার ব্যবস্থা করে দিন।

বহুদিন পর তার মুখে আমি সেই বিশ বছর আগে হাতিরপুল এলাকায় মসজিদের খাদেমের মুখে শোনা কথার প্রতিধ্বনি শুনলাম। লোকটি বলল, এই মসজিদে মহিলাদের নামাজ পড়ার কোন ব্যবস্থা নেই।

তখন ফজরের সময়। চারিদিক অন্ধকার। মসজিদে আমাদের গাড়ির পুরুষ মুসল্লীরা ছাড়া আর মাত্র কয়েকজন মুসুল্লী ‍উপস্থিত। পুরো মসজিদ খাঁ খাঁ করছে। কিন্তু এতগুলো নারীর নামাজ আদায়ের কোন ব্যবস্থা নেই।

আমি তখন মরিয়া হয়ে বাসে বসে থাকা নারীদের বললাম, তোমরা সবাই গাড়ি থেকে নামো। আমরা এখানেই নামাজ পড়বো।

তাদের অনুমতির তোয়াক্কা না করে, আমরা মসজিদে ঢুকে গেলাম। তারপর ওযুখানায় ওযু করে সবাই মিলে মোটামুটি জোর করেই সেই মসজিদে নামাজ আদায় করলাম।

নামাজ একজন মু’মিনের জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবন করার পর গত বাইশটি বছরে আমাকে জীবনে অসংখ্যবার, ঘরের বাইরে সালাত আদায় করতে গিয়ে এধরণের বিব্রতকর ও অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ সময়গুলোতে বেশির ভাগ সময়েই আমি জীবনের স্বাভাবিক প্রয়োজনে ঘরের বাইরে ছিলাম।

কখনো হয়তো আমি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটার জন্য বাইরে ছিলাম, কখনো বা ছিলাম ডাক্তারের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষারত, কখনো বা সন্তানদের সাথে কোচিং সেন্টারে, কিংবা কখনো প্রফেশনাল কাজে বিভিন্ন স্থানে।

কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে দিনের বেলায় যখনই আমি বাইরে গিয়েছি একরাশ উদ্বেগ নিয়ে বাইরে গিয়েছি এমনকি এখনো যাই।

উদ্বিগ্ন মনে ভেবেছি, আচ্ছা! জোহরের নামায পড়তে পারবো তো? কিবা আছর অথবা মাগরিবের নামায মিস হয়ে যাবে না তো?

মসজিদের শহর খ্যাত ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকাগুলোতে মসজিদ যে কম ছিল তা নয়। কিন্তু শুধু সেগুলোতে একজন মুসলিম নারী হিসেবে আমার প্রবেশাধিকার ছিল না।

(চলবে)

লেখক : গবেষক ও স্থপতি

[মতামত বিভাগের লেখার দায়ভার সম্পূর্ণ লেখকের। পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ এর সাথে যুক্ত নয়।] 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *