এ বি পার্টির আত্মপ্রকাশ ও আমাদের মূল্যায়ন

এ বি পার্টির আত্মপ্রকাশ ও আমাদের মূল্যায়ন

ফয়জুল্লাহ আমান ❑ কট্টরপন্থা টিকে থাকতে হলে তার বেশভূষায় পরিবর্তন আনতেই হয়। ইতিহাসের শুরু থেকেই আমরা বিষয়টি দেখে আসছি। যারা কঠোরতাকেই তাদের আদর্শ বানিয়ে নিয়েছে সংস্কারহীন তারা খুব বেশি দূর চলতে পারে না। একসময় তাদের গতি রোধ আবশ্যক হয়ে পড়ে।

পৃথিবীতে যারাই কোনো দল বা সংগঠন করে তাদেরই থাকে কিছু নীতি ও আদর্শ। সে হিসেবে মাওলানা মওদূদী প্রবর্তিত জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ মূলত কী? জামায়াতে ইসলামি কি সুন্নি বা আহলুস সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত? এ প্রশ্নটি নতুন করে সবার সামনে রাখছি। এর উত্তর দেওয়ার আগে আপনাকে জানতে হবে আহলুস সুন্নাহ বলতে মূলত কী বোঝায়? আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ হলো ইসলামের প্রথম যুগের মুসলিমদের যারা আইডল মেনে চলেন। রাসূলের সাহাবিদের যারা তাদের জীবনাচারে অনুসরণ করেন। তো এ অর্থে জামাত বা মৌদুদিপন্থীদের কি সুন্নি মুসলিম বলা চলে? তাদের বলা যায় কি যায় না তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে খোদ মাওলানা মওদূদি কি কখনও নিজেকে সুন্নি দাবি করেছেন? এখনও যারা জামাতে ইসলামির আইডিয়ালোজি ফলো করেন তারাও কি এমন সুন্নি হবার দাবি করেন? এর সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে, না, তারা নিজেদের সুন্নি মুসলিম হিসেবে দাবি করেন না।

আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত শব্দটির ব্যবহার আপনি দেওবন্দি বা আরবের ঐতিহ্যবাদী শেখদের রচনা বক্তব্যেই পাবেন। জামাতি ও ইখওয়ানি স্কলাররা খুব সতর্কতার সাথে এ শব্দটির ব্যবহার থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলেন। তারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেন। সুন্নি খারেজি শিয়া বলে ভাগ করার যেন তারা পক্ষপাতি নন। তাদের এ সরলতার নেপথ্যের কথাটি হচ্ছে তারা আহলুস সুন্নাহকে মন থেকে অপছন্দ করেন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের খুটিয়ে খুটিয়ে দোষ বের করার চেষ্টা করেন। আপনি যে বক্তব্যই দেন না কেন তার বিপরীতে তাদের বক্তব্য দিতে হবে। আহলুস সুন্নাহর আলেমদের তারা সত্যিকারার্থে প্রতিপক্ষ জ্ঞান করেন।

দেওবন্দের যারা তার চরম বিরোধিতা করেছে তাদের বিরোধিতার কারণও আপনার কাছে পরিষ্কার হবে।

মাওলানা মওদূদির খেলাফত মুলুকিয়াত পড়ে আপনার মনে হতে পারে তিনি শিয়াদের সাহিত্য থেকে তার উপাত্য সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে শিয়া নয়, খারেজিদের কিতাবাদি থেকেই তার সব ইলমের মূল খোঁজে পাওয়া যাবে। অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে আপনি খারেজিদের কিতাবপত্রের সাথে মাওলানা মওদূদির রচনাগুলি মিলিয়ে দেখুন; এর সত্যতা আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।

সমস্যাটা এখানেই। তিনি যদি নিজেকে ঘোষণা দিয়ে খারেজি ইসলামের পক্ষে কাজ করতেন তাহলে তাদের সহ্য করা সম্ভব হতো। কিন্তু তিনি নিজের পরিচয় গোপন করে সংগঠন করেছেন। আর এ গোপনীয়তা এজন্য যে, তিনি নিজেকে খারেজি হিসেবে পরিচয় দিলে সুন্নিদের ভেতর কাজ করা তার জন্য দুষ্কর হয়ে পড়ত। কাজের সুবিধার্থে তিনি এ স্ট্রাটেজি গ্রহণ করেছেন। দেওবন্দের যারা তার চরম বিরোধিতা করেছে তাদের বিরোধিতার কারণও আপনার কাছে পরিষ্কার হবে।

মাওলানা মওদূদি যদি রাখঢাক না রেখে আহলুস সুন্নাহ থেকে সরাসরি সম্পর্কচ্ছেদের কথা বলতেন তাহলে তার বিরোধিতায় এত বেশি কাঠখড় পোড়াতে হতো না। অনেকেই যে বলেন, ইতিবাচক কাজ না করে দেওবন্দি অনেক আলেম তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কর্মপন্থা গ্রহণ করেছেন, এ আপত্তি সত্য। কিন্তু এর বাস্তব কারণ যা বললাম তাই। অর্থাৎ অনেকটা কসরৎ করতে হয়েছে মুখোশ উন্মোচন করতে।

মূল কথায় ফিরে আসি। প্রকৃতির এটাই নিয়ম। কট্টরপন্থাকে টিকিয়ে রাখা মোটেও সোজা কথা নয়। ইসলামের আগের অবস্থা থেকেও এর বাস্তবতা বুঝতে পারবেন। ইয়াহুদ ও নাসারাদের ভেতর ইয়াহুদ হচ্ছে কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত। খৃস্টানরা অতি শিথিলতা দোষে দুষ্ট। দুই দলই বিভ্রান্ত। কিন্তু ইয়াহুদ খৃস্টবাদের তুলনায় অনেক প্রাচীন হওয়া সত্ত্বেও তাদের কোনো রাষ্ট্রিয় স্থিতিশীলতা হয়নি। এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার নয় কি, তাদের উদ্ভবস্থল ইজরায়েলেও তাদের হাতে থাকেনি রাষ্ট্রক্ষমতা? সেই নবী সুলাইমানের পর থেকেই তারা রাষ্ট্রছাড়া। পক্ষান্তরে খৃস্টানরা জন্মের কয়েকশ বছরের ভেতরই বিরাট রাষ্ট্র ব্যবস্থার কর্তৃত্ব দখল করতে পেরেছে। এবং আধুনিক কাল পর্যন্ত অসংখ্য বাদ বিবাদের ভেতর দিয়েও খৃস্টানদের হাতে শক্তিশালি একটি রাষ্ট্রকাঠামো থেকেছে।

এর কারণ হচ্ছে এই যে, অতি কঠোরতা স্বাভাবিকভাবেই সমাজের সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারে না। বিকারগ্রস্ত কিছু মানুষ কঠোরতাকে গ্রহণ করতে পারলেও সমাজের অন্য সব মানুষ যে করে হোক চরমপন্থাকে রোধ করতে মরিয়া হয়ে যায়। যদি ভালো নেতৃত্ব থাকে তাহলে চরমপন্থি সংগঠনগুলো অবস্থা বুঝে মৌলিক কট্টরপন্থা অবশিষ্ট রেখেও কিছু বিষয় সংস্কার করে। এভাবে কট্টরপন্থি সংগঠনগুলোও টিকে থাকতে পারে বুদ্ধির জোরে।

একটা মশার রক্ত লাগলেও কাপড় নাপাক হয়ে যাবার ফতোয়া দিত এরা।

আরেকটু সহজ করে বলি। কট্টরপন্থাকে টিকিয়ে রাখতে উদারতার প্রকাশ আবশ্যক। ইসলামের অতীত ইতিহাসে খারেজি সম্প্রদায় এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। খারেজিরা প্রতিটি বিধানের ক্ষেত্রেই কত কঠিন ছিল তা যারা ফেরকা বিষয়ে পড়াশোনা করেন তারা বুঝতে পারবেন। একটা মশার রক্ত লাগলেও কাপড় নাপাক হয়ে যাবার ফতোয়া দিত এরা। কেউ ছোট খাটো পাপ করলেও তাদের দৃষ্টিতে কাফের হয়ে যেত। সমস্ত গুনাহ তাদের দৃষ্টিতে কবিরা। সগিরা গুনাহ বলে কিছু নেই তাদের মতাদর্শে। আর কোনো গুনাহ কেউ করল তো সে কাফের হয়ে গেল।

এমন চরম মতাদর্শ নিয়ে কোনো সমাজে টিকে থাকা মুশকিল। তাই তাদেরকে পুরো শরিয়ত অনেক সহজ করে নিতে হয়েছে। পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলেই তাদের মাজহাবে চার রাকাত নামাজ দু রাকাত পড়ার বিধান। চার রাকাতেই সুরা ফাতিহা পড়লেই চলবে। অন্য কোনো সুরা মিলানো লাগবে না। দু ওয়াক্ত নামাজ একসাথে পড়া যাবে যে কোনো কারণ ছাড়াই। এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেখানো যাবে খারেজিদের ফিকাহ থেকে।

এসব মাসআলা দেখে সমাজের সাধারণ মানুষ তাদেরকে ভাবে খুব উদার। তাদের এই বাহ্যিক উদারতা দেখে অনেকেই তাদের ফাঁদে পা দেয়। মূল আইডিয়ালোজি যে কী ভয়াবহ তা সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারে না। এসব খারেজি মতাদর্শের লোক এখনও আছে। পাঠক হয়ত এধরনের খারেজিদের সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। তাই আমরা আরেকটি উদহারণ টানতে পারি।

বর্তমান বিশ্বের খুবই পরিচিত এক ইসলামি স্কলার হচ্ছেন ইউসুফ কারজাভি। নব্বই বছর বয়স হয়েছে ভদ্রলোকের। মিসরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা কিন্তু অবস্থান করেন কাতারে। প্রথম বিয়ে করেছেন মিসরে পঞ্চাশের দশকে। দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন আশির দশকে এক টিভি উপস্থাপিকাকে। ব্রাদারহুডের ভাবগুরু হিসেবে অধিক পরিচিত। তার ফতোয়াগুলো দেখুন। নাচ গান হালাল। ছবি অঙ্কনও হারাম নয়। মেয়েদের হেজাব পরতে হবে না। মিউজিকে কোনো সমস্যা নেই। এসব ফতোয়া দেখে আপনি হয়ত ভাববেন তার মত উদার মানুষ আর হয় না। আলেম হলে এমন উদার হওয়া উচিত। কিন্তু আপনি অবাক হবেন, এই কারজাভিই আবার আত্মঘাতি বোমা হামলা বৈধতার ফতোয়া দিয়েছেন। বহু স্বীকৃত হারাম কাজকে হালাল ফতোয়া দিয়ে নিজের উদারতা প্রকাশ করেছেন, আবার মূল আদর্শ যে কট্টর পন্থা তা ঠিক রেখেছেন। মূলত এ কৌশল ছাড়া চরমপন্থাকে পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখা যাবে না।

দেওবন্দি ধারার আলেমরা রক্ষণশীল হলেও ব্যক্তিগত জীবনাচারে তাদের রক্ষণশীলতা। মূল চিন্তায় তারা খুবই উদার।

জামাত শিবিরের রাজনীতি থেকে উদভ্রান্ত তরুণদের ফিরিয়ে রাখা মুশকিল। কারণ তাদের বোঝানো যায় না যে, তাদের যে উদারতার প্রকাশ তা শাখাগত বিষয়ে। তাদের মূলে সেই পুরনো চরমপন্থা। দেওবন্দি ধারার আলেমরা রক্ষণশীল হলেও ব্যক্তিগত জীবনাচারে তাদের রক্ষণশীলতা। মূল চিন্তায় তারা খুবই উদার। আর জামাতি খারেজি চক্র মন মননে খুবই কঠোর কিন্তু ব্যবহারিক বিষয়াদিতে উদার বলে ভ্রম হয়। এই ভ্রান্তি থেকে ভালো ভালো শিক্ষিত ছেলেমেয়েও রেহাই পায় না।

আরেকটু সহজ করে বলি। মনে করুন একজন প্রকৃত দেওবন্দি আলেম খুব নামাজ রোজা ইবাদত করবে। সমাজের মানুষকে প্রেম ভালোবাসা দিয়ে ধর্মের পথে আনার চেষ্টা করবে। কিন্তু কারো ওপরে জোর জবরদস্তি করবে না। নিজের ধর্মপালন দেখিয়ে বেড়াবে না। এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করবে না।

পক্ষান্তরে একজন জামাতি আইডিয়ালোজির লোক নামাজ কালামের ধার ধারবে না। খুব একটা ইবাদত বন্দেগিও করবে না। কারণ রাজনীতি করাই তাদের মতাদর্শে ইবাদত। তো তারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করবে। এছাড়া তাদের করার মত কিছু নেই। এজন্য ধর্মের ব্যাপারে রক্ষণশীলতার কোনো প্রয়োজন নেই। চরম উদার হতে তাদের বাধা নেই মাসআলা মাসায়েলের ক্ষেত্রে। তারা নিজেদের ছাড়া অন্য সবাইকে অমুসলিম ভাবে। ধর্ম কর্ম না করেও নিজেদেরকে মুসলিম ভেবেই তারা সীমাহীন সুখ অনুভব করে। মুখে ইসলামের কথা বলতে বলতে তাদের ফেনা বের হয়ে যায়। প্রকৃত মুসলিমদের চেয়ে ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে কথা বলার ক্ষেত্রে তাদেরকে অগ্রসর দেখা যায় সবসময়।

উদারতার প্রকাশ ছাড়া যে টিকে থাকা যাবে না তা মাওলানা মওদূদিও বুঝতে পারতেন। সেভাবেই তিনি নিজের আদর্শ থেকে ছাড় দিতে দিতে অনেক দূর নিচে নেমেছেন। তারপরও তার মূল কট্টরপন্থা এখনও অটুট রয়েছে। যার কারণে বর্তমান সমাজে এর উপযোগ আর বাকি থাকছে না। তার মানে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তারা আদর্শের সংস্কার করতে পারেননি।

এই পুরো প্রেক্ষাপট সামনে রেখে এবি পার্টির উত্থানকে মূল্যায়ন করা উচিত। এবি পার্টি জামাতের সংস্কারপন্থিদের তৈরি। মৌদুদির চরমপন্থা থেকে তারা নিজেদেরকে বিরত রাখার ঘোষণা না দিলেও তাদের সম্পর্কে এমন একটি সুধারণা সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। যদি বাস্তবে এমনটি হয় তাহলে অবশ্যই তাদের এই স্ট্রাটেজির প্রশংসা করতে হয়। কথা হচ্ছে আদর্শগত বিষয়ে এবি পার্টির নেতৃবৃন্দ কতটুকু বুঝেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

মাওলানা মওদূদি যে দক্ষতার সাথে দল গঠন ও পরিচালনা করেছেন সেখানে মৌলিক পরিবর্তন আনার জন্য সদিচ্ছার সাথে সাথে প্রয়োজন যথেষ্ট যোগ্যতা। তা না হলে প্রথমত আদর্শিক পরিবর্তন সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত সম্ভব হলেও জামাতের ফলোয়ারদেরকে তা গেলানো কঠিন হয়ে পড়বে। এদেশে চার পাঁচ পার্সেন্ট যে অনুসারী জামাতের রয়েছে তাদেরকে এ বি পার্টি কতটা পরিতৃপ্ত করতে পারবে তা সময়ই বলে দিবে। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদি কোনো পরিবর্তন না এনেই স্ট্যান্টবাজি বহাল রাখে তাহলে জামাত সংশ্লিষ্টতার কারণে বাঙালি সাধারণ সমাজে যেমন কখনওই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, জামাতের অনুসারীদের সাড়া পাওয়াও বেশ দুষ্কর হবে বলেই মনে হয়।

লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও সমাজ বিশ্লেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *