ওয়াজের নামে চলছে বিনোদন

ওয়াজের নামে চলছে বিনোদন

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী 

সুবিশাল প্যান্ডেল। আলোকসজ্জা। ওয়াজের প্যান্ডেলের আধা কিলোমিটার বা এক কিলোমিটার দুর থেকে লাইটিং। বিশাল বড় বড় গেট। কখনো দু-চার কিলোমিটার দূরেও মাহফিলের গেট দেখা যায়। এছাড়া নজরকাড়া ডেকোরেশনের মধ্য দিয়ে যেভাবে সাজগোজ করা হয় তাতে লক্ষধিক টাকা প্যান্ডেল আর গেটের পিছনে ব্যয় হয়। এমনিভাবে লাইটিং বা আলোকসজ্জাতে অর্ধ লক্ষাধিক টাকা খরচ হচ্ছে। এরপর রয়েগেল আমন্ত্রিত ওয়ায়েজ। ঢাকা থেকে এখন প্রথমসারির ওয়ায়েজদের পেছনে ৬০-৮০ হাজার টাকা গুনতে হয়। আজকাল প্রথমসারির ওয়ায়েজদের ৫০,০০০ (পঞ্চাশ) হাজারে কুলাচ্ছেনা। রেট এখন বেড়ে গেছে। আবার কোনো কোনো বক্তাকে ওয়াজে আসার আগে এ্যাডভান্স দিতে হয়। অগ্রীম টাকা না পেলে তিনি ওয়াজে আসেন না। দাওয়াত দেওয়ার সময় মোটা অংকের টাকা। ওয়াজের মঞ্চে ওঠার আগেই চুক্তিকৃত সকল টাকা পরিশোধের পরে তিনি মঞ্চে ওঠেন। নতুবা ঠুনকো অজুহাতে মাহফিল ক্যান্সেল করে দিয়ে অন্য জায়গাতে বেশী টাকার কন্ট্রাক্টে চলে যান।

সেদিন আমাদের জেলাতে একজন ক্বারি সাহেব ওয়াজ করতে এসেছিলেন। উক্ত ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকদের একজন বললেন, তিনি ৫৫০০০ (পঞ্চান্ন) হাজার টাকার কন্ট্রাক্টে দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। আরেকজন মাদ্রাসার পরিচালক জানালেন ঢাকার একজন ওয়ায়েজকে ৫০.০০০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা হাদিয়া দেওয়ার পরেও তিনি নাখোশ। তার চাহিদা আরো বেশী। মোটকথা, আজকাল গ্রাম-গঞ্জে সাধারাণ ওয়াজ মাহফিল দিতে গেলেও ৫-৬ লক্ষ টাকা বাজেট নিয়ে নামতে হয়।

কিন্তু কথা হল, ওয়াজের নামে এসব কী হচ্ছে? ওয়াজ তো আখেরাত পাওয়ার জন্য। তবে এই কন্ট্রাক্ট ওয়ায়েজ বা চুক্তিবাদী ওয়ায়েজদের মাধ্যমে যেসকল বেশরা কাজ হচ্ছে, এটা কী আখেরাতের পথ? এটা মানুষের হেদায়েতের রাস্তা?

ওয়াজের নামে যেন বিনোদন। আনন্দ- ফুর্তি আর ভুরিভোজ। বক্তা আসেন কন্ট্রাক্ট করে। আর ষ্টেজে উঠে সুর আর কান্নার কন্ঠে ওয়াজ করে মানুষকে কাঁদিয়ে চলে যান। মঞ্চে বয়ান করেন দুনিয়া ত্যাগের কথা, নবী- সাহাবিদের দুনিয়া বিমুখতার ইতিহাস। আর মঞ্চ থেকে নেমে টাকার বান্ডেল ছাড়া আর কিছু বোঝেন না। এটা যেন অভিনয়ের নামান্তর। মানুষকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে ফেলেন। আর আয়োজকগণ ডেক চড়িয়ে বিশাল খানার আয়োজন। বিরিয়ানী আর খিচুড়ির ঘ্রাণে পুরো এলাকাতে মুইমুই।

এভাবে প্রায় ৯৯ ভাগ ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। সবই টাকার খেলা হচ্ছে। বক্তারা কিছু গদবাঁধা ওয়াজ মুখস্থ করে আসেন। কিছু স্পর্শকাতর ঘটনাবলী। ওগুলো মঞ্চে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে বয়ান করেন। ঢাকার প্রথম সারির ওয়ায়েজ বলেন আর মফস্বলের ওয়ায়েজ। সকলেরই দু-চারটে ওয়াজ মুখস্থ করে রেখেছেন। ওগুলো বিভিন্ন জায়গাতে বর্ণনা করেন। এছাড়া কোন তথ্যভিত্তিক আলোচনা যেন তাদের জানা নেই।

এভাবে সারাদেশের ওয়াজ মাহফিলগুলোর বেহালদশা। রুহানিয়্যাত, লিল্লাহিয়্যাত যেন হারিয়ে গেছে। বক্তাদের মাঝে কোন লিল্লাহিয়্যাত নেই তেমনি আয়োজকদের মাঝেও লিল্লাহিয়্যাতের ঘাটতি। আয়োজকগণ চান নাম ফুটানো বা বিনোদন। আর বক্তারা চান টাকা আর টাকা। এমনি দুর্গতি এখন ওয়াজ মাহফিলে। মানুষের কোন ফায়দা নেই।

আবার কন্ট্রাক্টি বক্তারা ওয়াজ করেন শ্রোতাদের আকর্ষণ অর্জনের জন্য। যেন তার ওয়াজ ভাইরাল হয়। তার জন্য যত আজগুবি কেচ্ছা, চুটকি, জারিজুরি, হুমকি-ধমকি, যা কিছু আছে সব তারা করে থাকেন। কখনো বক্তারা বেফাঁস কথা বার্তা, নাটক- সিনেমার গানও তারা মঞ্চে পরিবেশন করেন। কেউ কেউ হিন্দি-বাংলা সিনেমার গানের সুড়সুড়ি দিয়ে থাকেন। মানে ওয়াজ মাহফিল যেন বিনোদনে পরিণত হয়েছে।

প্রিয় ভাই, ওয়াজ মাহফিল একটা বরকতময় অনুষ্ঠান। যেখানে আল্লাহর রহমত নাজিলের জায়গা। সহীহ নিয়্যাতে দ্বীনি কাজ হলে সেখানে বরকতে পরিপূর্ণ হবে। মানুষ কোরআন- হাদীসের মর্মবানী থেকে ছিরাতে মুস্তাকিমের পথ খুঁজে পাবে। কিন্তু ওয়াজ মাহফিল যদি লিল্লাহিয়্যাত না হয়ে, দ্বীনি উদ্দেশ্যে না হয়ে দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে হয়। তাহলে সেখানে কোন বরকত থাকে না। সেটার দ্বারা জাতি কোন ফায়দা হাসিল করতে পারেনা।

আল্লাহ আমাদের সহীহ বুঝ দান করুন। আমিন।

 

লেখক, শিক্ষক ও কলামিস্ট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *