- শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.) রাজনীতি করেছেন। তবে তিনি ছাত্রদের রাজনীতি করার ব্যাপারে সমর্থন দেননি।
- শিক্ষাবোর্ড কী রাজনীতি করার জন্য?
- জনতার কোন সম্পর্ক নেই। শুধু ছাত্র নির্ভর। আহ, এটা কেমন রাজনীতি?
আমিনুল ইসলাম কাসেমী : একদম সোজাসাপ্টা কথা। আমি কিন্তু রাজনীতির বিরুদ্ধে নই। ইসলামী রাজনীতির অবশ্যই প্রয়োজন। তাছাড়া আমাদের পুর্বসূরী উলামায়ে কেরাম সদর্পে রাজনীতি করেছেন। বিশেষ করে শায়খুল ইসলাম সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী (রহ.) ছিলেন রাজনৈতিক ময়দানের সিংহপুরুষ। একারণে ইসলামী রাজনীতির বিরুদ্ধে আমার বিলকুল অবস্থান নেই, বরং রাজনীতির পক্ষে।
কিন্তু কথা হলো, রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য মাদসারা ছাত্রদের পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া অথবা রাজনৈতিক নেতাদের কথায় এদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাবোর্ড উঠবস করবে, এটা কিন্তু আমি সমর্থন করি না। কওমি মাদরাসাতে দেদারসে রাজনীতি চলছে। সেই ১৯৮১ সনের হাফেজ্জী হুজুরের ইলেকশনের সময় যে কায়দায় হোক ঢুকে গেল। এরপর আর ক্ষান্ত হয়নি। চলছে রাজনীতি।
রাজনীতির এমন খেলা শুরু হলো সেখানে, একদম বিস্ফোরণ ঘটেগেল। লালবাগ মাদরাসাকে তছনছ করার পর এ রাজনীতির হাওয়ায় গড়ে উঠল জামেয়া মুহাম্মাদিয়া, মুহাম্মাদপুর। সেখান থেকে আবার গরম হাওয়া চলে গেল জামেয়া রাহমানিয়া, সাতমসজিদ। সেখানেও রাজনীতির মারপ্যাঁচে বহুকিছু ঘটেছে।শেষমেষ সেই রাজনীতির আছরে একটা বিশাল দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে।
যাই হোক, আমি সেদিকে যেতে চাচ্ছি না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, রাজনীতিকে তার নিজের ধারা মোতাবেক চলতে না দিয়ে নিজের সুবিধা মাফিক ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি হাসিল করার অপকৌশল চলছে। তা না হলে একটা বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কেন হার মানবে কিছু দুষ্ট চক্রের কাছে। এদেশের ছারে তাজ ওলামাদের নিয়ে গঠিত ‘হাইয়াতুল উলইয়া’। কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ শিক্ষাবোর্ড। সেই বোর্ডকে কাবু করা হলো কিছু ডাকসাইডের নেতা, যাদেরকে ভুঁইফোড় বলা যায়।তাদের কথায় পরীক্ষা পিছানো হলো। পরীক্ষা যথা সময়ে না নিয়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মসুচিকে সমর্থন জানিয়ে তাদের কথায় গলে গেল হাইয়াতুল উলইয়া।
রাজনীতির জন্য প্রয়োজনবোধে বায়তুল মোকাররম, পল্টন ময়দান, গুলিস্তান গিয়ে তাঁবু গেঁড়ে বসে থাকেন। তবুও কওমি মাদরাসার অভ্যন্তরে রাজনীতি করবেন না। এই জায়গাটারে মুক্ত রাখেন।
এই একটা পয়েন্ট যথেষ্ট। আর বেশী কিছুর দরকার নেই। শিক্ষাবোর্ড যদি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হতে পারে। কওমি মাদরাসা যদি তার নিজ কারিকুলামে এগোতে না পারে। শিক্ষাবোর্ড যদি নিজের গতিতে চলতে না পারে। তার পথ যদি রুদ্ধ করা হয়। তাহলে বড় দুঃখজনক। এজন্য যারা রাজনীতি করবেন। পুরো দেশব্যাপি দপিয়ে বেড়ান। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সফর করেন। রাজনীতির জন্য প্রয়োজনবোধে বায়তুল মোকাররম, পল্টন ময়দান, গুলিস্তান গিয়ে তাঁবু গেঁড়ে বসে থাকেন। তবুও কওমি মাদরাসার অভ্যন্তরে রাজনীতি করবেন না। এই জায়গাটারে মুক্ত রাখেন। এখানকার তালেবুল ইলমদের আর ব্যবহার করবেন না।
পুর্বসূরী আলেমদের কথা হয়তো অনেকে বলবেন।তারা রাজনীতি করেছেন। আমাদের দোষ কোথায়?
পুর্বসুরী আলেম বিশেষ করে শায়খুল ইসলাম মাদানী (রহ.) রাজনীতি করেছেন। তবে তিনি ছাত্রদের রাজনীতি করার ব্যাপারে সমর্থন দেননি। তিনি রাজনৈতিক কোন প্রোগ্রামে ছাত্রদের ব্যবহার করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাঁর বহু ছাত্র এদেশে ছিল। তাঁরা কেউ ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক কমর্সূচিকে ভালো চোখে দেখেননি। তাহলে কেন আমরা নিরীহ ছাত্রদের ব্যবহার করব।
এর আগে বহুবার আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। শিক্ষাবোর্ডে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকতে পারবে না। কিন্তু ‘যে লাউ সেই কদু’। ঘুরে ফিরে রাজনৈতিক নেতারা গেঁড়ে বসে থাকেন। সভাপতি আর সেক্রেটারির পদ বাদ রেখে বাকি সবগুলো পদে নেতারা বসে পড়েন। উনারাই শেষমেষ রাজনৈতিক প্রছন্নতা নিয়ে আসেন।
এই যে দেখুন! বিভিন্ন মাদরাসার মোহতামিম সাহেব বা শায়খুল হাদীসগণ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা হয়ে আছেন। বা এর আগেও এরকম বহু রথি-মহারথি শায়খুল হাদীস-মোহতামিম এর গোজরান হয়েছে। যারা মাদরাসার আঙিনায় বসবাস করে আবার পল্টন ময়দান এবং বায়তুল মোবাররমসহ রাজপথে সময় দিয়েছেন। উনারা আবার শিক্ষাবোর্ডের অথরিটি। এঁরাই ছাত্রদের ব্যবহার করেছিলেন, করেছেন, করে যাচ্ছেন। এর দ্বারা কী কোন ফায়দা আজো হয়েছে? কোন ফায়দা তো হয়নি, বরং প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।
রাজনীতি তো আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকগণ করেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ করেন। কিন্তু তাদের রাজনীতির কারণে কখনো আলিয়া মাদরাসা, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। কেউ তাদের প্রতিষ্ঠান নিয়ে কথা বলেননি। তাদের বোর্ড নিয়ে কোন সমালোচনা হয়নি আজো। কিন্তু আমাদের কিছু হলে মাদরাসা থেকে মিছিল বের হবে কেন? মিছিলে হামলা হলে বা হরতালে হামলা হলে আমাদের শিক্ষাবোর্ডের তরফ থেকে বিবৃতি আসবে কেন? শিক্ষাবোর্ড কী রাজনীতি করার জন্য? এটা বড় আফসোসের বিষয়!
রাজনীতি হবে তো দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায়। সেখানে জনতা তো থাকবেই। যেখানে সাধারণ জনতার কোন সস্পৃক্ততা নেই, সে রাজনীতি কী ভাবে সম্ভব?
আমরা দাওরায়ে হাদীস ফারেগ হয়ে হাতে চুড়ি পরে বসে থাকি। আর যত মরণ কওমির নিরীহ ছাত্রদের। যতকিছু ঠিকাদারী যেন বেফাক-হাইয়্যার। সত্যিকারার্থে রাজনীতি করতে হলে যারা ফারেগীন আছে তারা করবে। তারা মাদরাসার সাথে কোন সম্পর্ক না রেখে করার চেষ্টা করবে, সাধারণ জনতাকে সম্পৃক্ত করে তারা রাজনীতিতে নামবে। তবুও অবুঝ ও নিরীহ তালেবুল ইলমদের ঢাল বানাবে না। আমাদের কিছু লোক রাজনীতিতে নিরীহ ছাত্রদের মুল চালিকাশক্তি মনে করে। তাদের সাথে সাধারণ জনতার কোন সম্পর্ক নেই। শুধু ছাত্র নির্ভর। আহ, এটা কেমন রাজনীতি? রাজনীতি হবে তো দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায়। সেখানে জনতা তো থাকবেই। যেখানে সাধারণ জনতার কোন সস্পৃক্ততা নেই, সে রাজনীতি কী ভাবে সম্ভব? কোন ভাবে এগোতে পারবে না।
এজন্য মাদরাসা কেন্দ্রীক রাজনীতি হওয়ার কারণে বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে। কোন সফলতা নেই আমাদের। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একজন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হওয়ার যোগ্যতা আমাদের হয়নি।অথচ রাজনীতি করছি আমরা আশির দশক থেকে।শুধু ছাত্র নির্ভর হওয়ার কারণে পিছিয়ে যাচ্ছি বারবার। মাদরাসা বন্ধ তো আমাদের রাজনীতি বন্ধ।
আরো বড় দুঃখজনক হলো, ছাত্রদের আর পড়ার টেবিলে আমরা রাখতে পারিনি। রাজনৈতিক ময়দানে আমোদপূর্ণ জায়গাতে তাদের পড়াপড়িতে বেঁধে রাখা যায় না। দিনে দিনে ছাত্ররা ভোতা হয়ে যাচ্ছে। আবার রাজনৈতিক গোলমালে আহত, নিহত, পুঙ্গত্ব বরণ করছে হাজারো তালেবুল ইলম। বিশেষ করে মায়ের বুক যাদের খালি হচ্ছে, তাদের অভাব কেউ মেটাতে পারছে না।
কওমি অঙ্গনে আর রাজনীতি নয়। কওমি মাদরাসার অভ্যন্তরে, সেখানে অবস্থান করে রাজনীতি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। লেখাপড়ার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা জরুরী। নচেৎ আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির সম্মুখিন হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ আমাদের উপর রহম করুন। আমিন।
লেখক: কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক ও কলামিষ্ট
‘দারুল উলুম দেওবন্দের শুরু থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটি পরিকল্পনা দেখতে পাওয়া যায়। জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ প্রতিষ্ঠারও বহু আগে কাসেম নানুতুবি রহ.-এর জীবদ্দশায় ‘ছামারাতুত্তারবিয়া’ নামে একটি সংগঠন করা হয়। এ সংগঠনে ছাত্র তো দূরের কথা, দেওবন্দের সব উস্তাদদেরও সংযুক্ত করা হয়নি।’
– পড়ুন মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান রচিত ‘দেওবন্দ ও রাজনীতি‘