কওমি মাদরাসা ছুটে চলেছে কোথায়

কওমি মাদরাসা ছুটে চলেছে কোথায়

কওমি মাদরাসা ছুটে চলেছে কোথায়

আমিনুল ইসলাম কাসেমী :: কোথায় ছুটে চলেছি আমরা? এ যাত্রার শেষ কোথায়? আমাদের গন্তব্য কোথায়? দু-চারটে ফেসবুকের লিখনীতে আমরা দল বেঁধে ছুটে চলেছি। কোন প্রকার তাহকিক নেই, কোন বাছ – বিছার নেই। আগে পরে দেখাদেখি নেই। বেকুফের মত কেউ একটা আওয়াজ উঠালে সেদিকে সব দৌড় শুরু করে দিলাম। অনেক বুঝমান লোককে দেখছি ঐ মিছিলে শরীক হতে। জ্ঞানী- বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ যেন তাদের সমঝ হারিয়ে ওদের সাথে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন।

বড় আফসোস! এরকই হয় সব সময়। বিভিন্ন সময়ে আমাদের কওমী পরিবার সম্পর্কে এক শ্রেণির লোকেরা স্লোগান উঠায়ে দেয়, আর তাতে সকলেই এক যোগে সুর তুলি।

কয়েকবছর আগে ফরীদ উদ্দীন মাসউদ সাহেব সম্পর্কে এক জালিয়াত চক্র বানোয়াট- কিচ্ছাকাহিনী ছেড়ে দিয়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। আর ফেসবুকে একচেটিয়া ভাবে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সাহেবকে যেভাবে গালিগালাজ, অকথ্য ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলো বর্ণনার ভাষা আমার নেই। কোন একটা আইডি তখন বাকি ছিল না ফরীদ সাহেবকে হেনেস্তা করে নেই। একদম দুর্বল ব্যক্তি, যারা কোনদিন কাউকে কিছু বলে না। তারাও তখন দেখেছি, সেই মিথ্যার দলে যোগ দিতে। এরপর আরো কত ছারে তাজ উলামা সম্পর্কে ট্রল করতে দেখলাম। কে বাদ আছে? কেউ আর বাকি নেই।

ঠিক, বর্তমান পজিশনটা আমার কাছে সেরকম মনে হচ্ছে। কে বা কারা, তাদের ঠিকানা নেই, পরিচয় নেই, এরকম আইডি থেকে আমাদের ছারে তাজ মুরুব্বীদের ব্যাপারে আওয়াজ তুলে দিল, ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে আমরা নির্বোধের মত ছুটে চলেছি। যা – ইচ্ছে তাই ব্যবহার করছি। সবই তো কারসাজি মনে হচ্ছে।

জানিনা কে সেই উসামা মোহাম্মাদ সাহেব। তিনি এভাবে আওয়াজ তুললেন। তবে আমার মনে হচ্ছে, কোন সংঘবদ্ধ চক্র হতে পারে। আল্লাহ মালুম।

তবে যেটাই হোক, কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোনদিকে? এর শেষ কোথায়?

কাউকে তো তারা ছাড়ছে না। যাকে পাচ্ছে তার ব্যাপারেই কথা উঠাচ্ছে। আমাদের ছারে তাজ মুরুব্বী সকলকে নিয়ে তাদের ইশকাল। কোন একজন মুরুব্বী মনে হয় নিস্কৃতি পাবেনা তাদের কলম থেকে। বাংলাদেশের শীর্ষ মুরুব্বী আল্লামা আহমাদ শফি সাহেব থেকে নিয়ে যত আছেন, সবাইকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যাচ্ছে তারা। একেরপর এক আপত্তি তুলছে। তাহলে ফ্রেশ থাকলেন কে? কে তিনি যার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই।

অনেক আগে থেকে আপত্তি উঠেছিল,বেফাককে রাজনীতি মুক্ত করা হোক। বেফাকের শীর্ষ পদে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকতে পারবে না। ভাল কথা। এটা সমর্থন যোগ্য। তাহলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাদ দিলে তাহলে ইমেজ ওয়ালা মানুষটা কে? কে তিনি যাকে সবাই মনে প্রাণে মেনে নিবেন?

ফেসবুকাররা যত থিওরি দিচ্ছেন, এতে ফ্রেশ ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া বড় দায়। দু’একজন ইয়ং জেনারেশনের নেতা আছেন, যারা কিনা নানান অপবাদে জর্জরিত। তাদেরকে দিয়ে তো আর বেফাক এর মত এত্ত বড় এক প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়।

দেখুন! আজকের বেফাক এমনি এমনি হয়নি। এর মধ্যে কিছু মানুষের সীমাহীন কোরবানী রয়েছে। শত শত মুরুব্বীদের মুজাহাদা- মেহনত করতে হয়েছে। বিশেষ করে বেফাকের দীর্ঘদিনের মহাসচিব আব্দুল জব্বার জাহানাবাদী রহ, সাহেব তো বেফাকের জন্য জীবন দিয়ে দিছেন। নিজের পরিবার- পরিবার, সংসার- ধর্ম ত্যাগ করে বেফাককে দাঁড় করেছিলেন তিনি।

আব্দুল জব্বার সাহেবের মত আরো কিছু ব্যক্তিত্বের জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে কিন্তু আমাদের সামনে বেফাক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কোরবানী আর মেহনতের বদলা কোনদিন আমরা দিতে পারবনা।

সেই আশির দশকের শেষের দিকের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ফরিদাবাদ মাদ্রাসার একটা রুমের মধ্যে ভাঙ্গা একটা বাক্স নিয়ে আব্দুল জব্বার সাহেব বসে থাকতেন। কত কোরবানী, কত ঝড়- তুফান বেচারার উপর দিয়ে গিয়েছে তার হিসেব নেই। অর্ধাহারে- অনাহারে কাটিয়েছেন তিনি। তারপরেও পিছপা হননি।

এখন তো বেফাক “রসগোল্লার ” মত হয়ে গেছে। মুখে তুলে সহজেই গলাধঃকরণ সম্ভব। কিন্তু এই পর্যন্ত আসতে বেফাকের মুরুব্বীদের কথা কেউ চিন্তা করেছি? আগে কয়টা মাদ্রাসা ছিল বেফাকে? হাতে গোনা কয়েকটি মাদ্রাসা। ঢাকা শহরেই তো অধিকাংশ মাদ্রাসা বেফাকভুক্ত ছিল না। কিন্তু আমাদের মুরুব্বীদের যে কি কোরবানী করতে হয়েছে। তা বলে শেষ করা যাবে না।

এক কথায় মুরুব্বীদের জীবন উৎসর্গ করেছেন বেফাকের জন্য। সব মাদ্রাসাগুলো এক ফ্লাট- ফরমে আনতে ঘামের নদী পাড়ি দিতে হয়েছে। শত – সহস্র কোরবানী তাদের।

সেই কোরবানীর বিনিময়ে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে বেফাক। এখন গর্বের। এখন বেফাকের ঐতিহ্য – অবদান নিয়ে আমরা বুক ফুলিয়ে কথা বলতে পারি। মানুষের হৃদয় মাঝে স্থান করে নিয়েছে বেফাক। এক ডাকে, এক নামে এখন বেফাকের পরিচিতি।

সেই বেফাকের কোন ক্ষতি হোক আমি চাই না। বেফাকে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি হোক সেটাও আমরা কামনা করিনা। বেফাকে কোন বিতর্কিত লোক জমে বসে থাকুক, সেটাও আমাদের মনস্কামনা নয়। তবে একটু তাহকিকের প্রয়োজন। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে চাই না।

একজন আওয়াজ তুলবে আর আমরা সকলে হ্যাঁ বলব? না বুঝে দৌড় দিব সেদিকে?

আমি আবারও বলছি, আমি কোন দুর্নীতিবাজকে সমর্থন করিনা। ভবিষ্যতেও করবনা। তবে হিসাব করে, তাহকীক করে সেদিকে দৌড়ানো উচিত। একেক সময় একেকজন মুরুব্বীকে নিয়ে ট্রল করবে, আর আমরা সাড়া দিব কেন?

এভাবে কম্বলের পশম বাছতে বাছতে তারপরে কাকে নিয়ে চালাব বেফাক? বুঝতেছিনা তাদের কুটকৌশল। শেষমেষ কি বেফাক মুখথুবড়ে পড়বে?

দেখুন চারমাস ধরে কওমী মাদ্রাসাগুলো বন্ধ। শিক্ষকগণ বেতন পাচ্ছেন না। কত শিক্ষকের ঘরে চুলা জ্বলে না। সে বিষয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। কওমী মাদ্রাসাগুলোর তালীম বন্ধ,সেটা নিয়েও কোন কথা নেই। পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছি আমরা কায়দামত। তবে কোথায় গিয়ে শেষ হবে? থামবে কোথায় গিয়ে?

বেফাকের নেতৃত্বে কাদের আনব আমরা? কারা যাবেন সেখানে? কে হবেন সভাপতি? আমরা স্লোগান তুলে দিচ্ছি। বেফাকের যদি কোন ক্ষতি হয়, বেফাক যদি ছিন্নভিন্ন হয়, তাহলে কি সেই অতিউৎসাহীরা খুশি হবেন?

নাকি বেফাকের উন্নতি- অগ্রগতি কেউ সহ্য করতে পারছেন না। কওমীর আলেমদের এক মঞ্চে বসা ওদের সহ্য হচ্ছে না। সনদের স্বীকৃতি নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়াকে বেফাকের জন্য, ওলামাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনেকে প্রশ্ন তুলবেন, আমাদের কাছে ভিডিও ক্লিপ আছে। আরো অনেক তথ্য আছে। দেখুন! ভিডিও ক্লিপ, টেলিফোন সংলাপ অনেকের ব্যাপারে আছে, সবগুলো কি গ্রহণযোগ্য? সব কিছুকে কি বিস্বাস করা যায়?

কদিন আগে মাহফুজুল হক সাহেবের ব্যাপারে টেলিফোন সংলাপ ভাইরাল হয়েছিল, সেটা কি সত্য বলবেন? আমি নিজেও তখন প্রতিবাদ করেছি, এটা বানোয়াট, মিথ্যা। বিস্বাস যোগ্য নয়। ঠিক সব টেলিসংলাপ বিস্বাস যোগ্য নয়।

যদি সত্য হয়ে থাকে, তার জন্য আমাদের বেফাকের নীতি নির্ধারক আছেন তারা ব্যবস্হা নিবেন। আমাদের ছারে তাজ মুরুব্বীগণ রয়েছেন, সেটা দেখবেন। কিন্তু আমরা আজ পোলাপাইন হয়ে যেভাবে মিথ্যার জাল বুনে চলেছি সেটা বড় দুঃখজনক।

বেফাকের মহাসচিব পদত্যাগ করবেন কি উসামা মোহাস্মাদের কথায়। এত্ত সহজ। ফেসবুক কি সব কিছু হয়ে গেল? মনে হচ্ছে তিনি ইমরান এইচ সরকার! একদম সারাদেশে যা ফর্মুলা দেবেন তাই হবে।

বেফাকের মহাসচিবের যদি পদত্যাগ করতে হয়, সেটা করবেন, কমিটির পরামর্শে। যারা তাঁকে বানিয়েছেন, তাদের মাধ্যমে। উসামা মোহাম্মাদের মত মানুষের হুমকিতে তো বেফাকের মহাসচিব পদত্যাগ করতে পারেন না!

আব্দুল কুদ্দুস সাহেব বেফাকের মহাসচিবের পদ চেয়ে নেন নি। তাকে জোরপূর্বক দেওয়া হয়েছে। বড় দুঃসময়ে তিনি বেফাকের মত প্রতিষ্ঠানকে আগলে রেখেছেন। হ্যাঁ, ভুল- ত্রুটি থাকতে পারে। ভুলের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। তাই বলে লাগামহীন ভাবে তাঁকে অপমানের খড়্গ চাপিয়ে দেওয়া সমীচিন নয়।

তাঁর ভুলের জন্য, তাঁর অন্যায়ের জন্য অবশ্যই তাঁকে জবাবদিহী করতে হবে। তবে সেটা কার কাছে? ফেসবুক ওয়ালাদের কাছে? কিছু নবীন আলেম আর তালেবুল ইলমদের কাছে? নাকি মুরুব্বী দের কাছে?

তিনি জবাবদিহী করবেন বেফাকের কমিটির কাছে। মুরুব্বীদের কাছে। আমার আপনার কাছে নয়।

এজন্য সাবধান হোন, সচেতন হোন, ট্রলবাজদের খপ্পরে কেউ পড়বেন না। ওদের মতলব বোঝা বড় দায়। আমার কাছে কেমন যেন মনে হচ্ছে। আজ হয়ত লাফালাফি করছেন, ওদের সাথে। দেখবেন, হঠাৎ ওদের রুপ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওরা যে কোন সময় রুপ বদলাতে পারে। আবার ওদের কলম ঘুরে যাবে আপনার প্রিয় ব্যক্তি সম্পর্কে। তাই মুরুব্বীদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা কাম্য নয়। নিজেকে সংযত রাখুন। আল্লাহ আমাদের সকলের উপর রহম করুন। আমিন।

লেখক : মাদরাসা শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *