কওমীতে উগ্রবাদের শ্যেনদৃষ্টি

কওমীতে উগ্রবাদের শ্যেনদৃষ্টি

  • আমিনুল ইসলাম কাসেমী

কওমী মাদ্রাসা হল ইলম- আমলের মহাসাগর। যেমনি ইলম চর্চা হয় তেমনি আমলি মুজাকারা হয়। শত শত বছরের ঐতিহ্য এটা। বিশেষ করে দারুল দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এধারার প্রতিষ্ঠানগুলো ইলমচর্চা এবং আমলি পরিবেশের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। উপমহাদেশে ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের সুতিকাগার দারুল উলুম দেওবন্দ শুধু ইলম চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইলমের পাশাপাশি আমলি যিন্দেগী গঠনের ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো দেওবন্দেরই শাখা। এ কারণে দেওবন্দের অনুকরণ ও অনুসরণেই চলে এদেশের দ্বীনি ইদারাগুলো। দেওবন্দী চিন্তা-চেতনাকে পাশ কাটিয়ে কেউ এদেশে কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে নি। নিজস্ব চিন্তা বা কোন বাতিল ফেরকার দর্শনে কখনো কওমীর শিকড় গোঁজা হয়নি। যা হয়েছে সবই দারুল উলুম দেওবন্দের রীতিনীতি অনুযায়ী হয়েছে।

দারুল দেওবন্দে আমলি ও ইসলাহী যিন্দেগী গঠনের জন্য খানকা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। যেখানে আত্মার সংশোধন করা হত। আদব শিক্ষা দেওয়া হত ছাত্রদের। যেটা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী ( রহ,), কাসেম নানুতবী ( রহ,) শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী ( রহ,) রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহী ( রহ,), শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী ( রহ,), আশরাফ আলী থানভী ( রহ,), এসকল মনিষীগণ তা’লীমের পাশাপাশি তালেবুল ইলম এবং আলেম-উলামাদের ইসলাহ বা সংশোধনের জন্য খানকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যেখানে আত্মশুদ্ধির মেহনত করতেন। ছাত্রদের আমলি মেজাজে গড়ে তুলতেন। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে যেমন বিজ্ঞ আলেম বেরিয়েছে, মুজাহিদ বেরিয়েছে, তেমনি দারুল উলুম থেকে বেরিয়েছে আত্মশুদ্ধির মহান সাধক। আর এসব মহান ব্যক্তি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপি। গোটা দুনিয়ার আনাচে-কানাচে তারা দ্বীনের মশাল জ্বালিয়েছেন। জাতিকে সঠিক পথের নির্দেশ দিয়েছেন।

বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো দেওবন্দেরই শাখা। অন্য কোন দর্শন লালন করে না। বরং দেওবন্দেরই অনুকরণে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো চলে। সেই শত বছর পূর্বে হাটহাজারী, বিবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুছিয়া, চট্রগ্রামের পটিয়া, এরপরে ঢাকার বড় কাটরা, লালবাগ, ফরীদাবাদ, কিশোরগঞ্জের জামেয়া ইমদাদিয়া, তারপর মালিবাগ জামেয়া শাইয়্যাহ, জামেয়া হুসাইনিয়া আরজাবাদ, জামেয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ি, জামেয়া মাদানিয়া বারিধারা এরকম হাজারো প্রতিষ্ঠান এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসবই দেওবন্দী ধারায় তথা দারুল উলুম দেওবন্দের অনুকরনে-অনুসরণে। কেউ কিন্তু নিজের খেয়াল বা নিজের ইচ্ছেমত কোন ইজমে এসব প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করে নি। সকলেই দেওবন্দ তথা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারী জামাতের অনুগামী।

এসব প্রতিষ্ঠানের ফসল কিন্তু মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ( রহ,), হাফেজ্জী হুজুর( রহ,), শায়েখ তাজাম্মুল আলী সিলেটি( রহ,), শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল ( রহ,), মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী ( রহ,), মুফতি আমিনী ( রহ,), আল্লামা কাজি মু’তাসিম বিল্লাহ ( রহ,), মাওলানা আতহার আলী ( রহ,), মুফতি নুরুল্লাহ ( রহ,), মাওলানা আশরাফ আলী ( রহ,) আল্লামা আহমাদ শফি ( রহ,) আল্লামা নুর হোসেন কাসেমী ( রহ,) এরকম হাজারো বাঘা বাঘা আলেম এদেশে তৈরী হয়েছে। ওনারা দেওবন্দেরই সিলেবাস, দেওবন্দের চিন্তাধারা রপ্ত করেই দেশবিখ্যাত ব্যক্তি হিসাবে গড়ে উঠেছেন। তারা কেউ নিজস্ব চিন্তাধারা বা মতামতে নিজের জীবনকে গড়ে তোলেন নি।

বড় পরিতাপের বিষয়, বিগত এক যুগ ধরে কওমী অঙ্গনে ভিন্ন ইজমের শ্যেনদৃষ্টি মনে হচ্ছে। ওরা নামে দেওবন্দী, দেওবন্দের ছদ্মাবারণ তাদের। লেবাসে আকাবির-আছলাফের রূপ। কিন্তু ওদের কর্মকাণ্ডে দেওবন্দীয়্যাত পাওয়া যায় না। ওদের চিন্তাধারাতে আকাবির-আসলাফের মতের মিল পাওয়া যায় না। বরং কিছু বিপথগামী লোকের মতাদর্শে তারা বিশ্বাসী। যে সমস্ত ইজম বা দর্শন প্রত্যাখ্যাত, সেসব দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে যাচ্ছে। ওরা মুষ্টিময় কিছু মানুষ। কেউ অনলাইনকে বেছে নিয়েছে তাদের মতবাদ প্রচারের জন্য। কেউবা ওয়াজের ময়দানের সরলপ্রাণ মানুষদের বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে।

আজকাল ওসব বাতিল দর্শনে বিশ্বাসীদের কাছে আলেম সমাজ অশ্রদ্ধার পাত্র বনে গেছে। পাকিস্তানের আল্লামা তাকি উসমানী দামাতবারাকাতুহুম, ভারতের মাহমুদ মাদানী দামাতবারাকাতুহুম, এদেশের আল্লামা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ দামাতবারাকাতুহুম, মুফতি আব্দুল মালেক দামাতবারাকাতুহুমসহ বড় বড় আলেমগণকে তারা কেয়ার করেন না। বরং ওনাদের প্রতি ক্ষোভ তাদের। এরকম বিজ্ঞ আলেমদের ব্যাপারে তাদের আপত্তি।

ওই সকল ভ্রান্ত দর্শনে বিস্বাসী কিছু মানুষ কওমী অঙ্গনে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ওরা উস্তাদদের ভুল খুঁজে ছাত্রদের লেলিয়ে দিচ্ছে উস্তাদদের প্রতি। যেখানে কওমী মাদ্রাসা আদব-লেহাজের উর্বর জমিন সেখানে কতিপয় কট্টরপন্হীদের যোগসাজশে ছাত্রদের বেয়াদব ও বেপরোয়ার সবক দিচ্ছে তারা।

অথচ এক যুগ আগে এমন দৃশ্য কওমীতে দেখা যায়নি। এই ওদের খপ্পরে পড়ে এখন সব হারাচ্ছে কওমীর তলাবাগণ। ওদের টার্গেট মুলত মেধাবীছাত্ররা। মাদ্রাসার মেধাবী ছাত্রদের কোরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যা দিয়ে এবং সরল উস্তাদদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে তারা।

ওদের দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে এদেশের দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোতে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটাচ্ছে। যেমন তার প্রতিফলন আমরা হাটহাজারীতে দেখেছি। ওস্তাদদের প্রতি ছাত্ররা মারমুখো। যেসকল উস্তাদগণের নিকট ছাত্রগণ ইলম শিখল। নিজে সঠিক রাস্তায় চলার পথ খুঁজে পেল। সেসব আসাতিযায়ে কেরামের প্রতি ছাত্ররা রুখে যাচ্ছে! তাঁদের দরজায় লাথি মারছে। শিক্ষকের কামরার আসবাবপত্র ভাঙচুর করছে। আবার শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল তারা।

হাটহাজারির পরে পটিয়া। এ যেন একই সুত্রে গাঁথা। একদম পরিকল্পিত ভাবে সেখানে হামলা চালাল। একদম রণ সাজে সজ্জিত হয়ে এদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানের উস্তাদদের জিম্মি করে ফেলল তারা। শুধু তাই নয় মাদ্রাসার মহাপরিচালককে জিম্মি করে জোরপূর্বক ইস্তিফানামা নেওয়া হল।

বড় আফসোসের বিষয়। দেওবন্দীধারার কতখানি ছাত্রদের এমন ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচারণ এই মনে হয় প্রথম দেখলাম। পুরো দেশের আলেম সমাজ এবং সাধারণ মানুষ হতবাক হয়েছে। আলেমগণ যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। যেসব ছাত্রদের তিলে তিলে বড় করা হয়েছে। অন্ধত্ব থেকে আলোর পথ দেখানো হয়েছে। তারাই শেষমেষ উস্তাদদের প্রতি চড়াও হয়ে গেল।

আদর্শে কতখানি বিবর্জিত হলে এমন কাজ করতে পারে ছাত্ররা? মানে কট্টরপন্হী গ্রুপের সোহবাত এমন ভাবে তাদের আসক্ত করেছে যে, এখন নিজের প্রিয় উস্তাদের সাথে বেয়াদবি করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। বড় বড় মহান মনিষীদের বিরুদ্ধচারণ যেন তাদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার।

আসলে ওই নীতি-আদর্শ ভ্রষ্ট সম্প্রদায় সবই পারে। ওরা জনসম্মুখে স্পষ্টভাবে আলেম এবং পীর মাশায়েখদের নিয়ে ঠাট্টা- বিদ্রুপ করতে দেখা যায়। কখনো আলেম-উলামাদের নাম এবং সংগঠনের নাম ব্যঙ্গ করে থাকে। কখনো হক্কানী পীর মাশায়েখদের বিরুদ্ধে বল্গাহীন ভাবে বক্তব্য এবং কলমবাজি করতে দেখা যায়। এজন্য ওদের সাথে যারাই সম্পর্ক রাখে, যারাই তাদের সংস্পর্শে যায়, তারা যেন ওই ধারাতে গড়ে ওঠে। তখন সকল সোহবাতপ্রাপ্ত ছাত্রগণ উস্তাদদের বিরুদ্ধাচারণ এবং বেয়াদবি করতে দ্বিধাবোধ করেনা।

এজন্য কওমী অঙ্গনে ওসব নীতি বিবর্জিত মানুষদের ছাটাই করা জরুরী। সকল দ্বীনি প্রতিষ্ঠান থেকে ওসব বিপথগামী লোকদের শেকড় তুলে ফেলা সময়ের দাবী। যাতে কওমীতে আবার সোনালী দিন ফিরে আসে।

আল্লাহ তায়ালা সকলকে হেফাজত করুন। আমিন।

শিক্ষক ও কলামিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *