কওমের ঈদ; কওমীর ঈদ

কওমের ঈদ; কওমীর ঈদ

কওমের ঈদ; কওমীর ঈদ

মাওলানা আরিফ বিল্লাহ ❑ গেল শুক্রবার আমরা আদায় করলাম ১৩৪১ হি: রামাদানের শেষ জুমা। যাকে বলা হয় বিদায়ী জুমা বা জুমাতুল বিদা। প্রতি বছরই আমরা রামাদান পার করি, জুমাতুল বিদা আদায় করি; তবে এবারের রামাদান ও রামাদানের শেষ জুমা হৃদয়ে দাগ টেনে গেলো। ইনসানিয়াতের বুকে পিঠে জগদ্দল পাথরের চাপা রয়ে গেল।

করোনার বিষাদময়তা যখন উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিমের দেয়াল টপকে পুরো বিশ্বকে নাস্তানাবুদ করে দিল সেই ক্ষণে মাহে রামাদান মুসলিম মিল্লাতের আশির্বাদ হয়ে এসেছিল। যেই করোনা মহামারি মানব বন্ধনকে টুকরো করে দিয়েছে, পারিবারিক মায়ার বাধঁনকে ছিন্ন করেছে। সেই সময়ে মাহে রামাদান এসেছে সম্পর্ককে অঁটুট করতে, পুরনো সম্বন্ধকে জ্বালিয়ে নবরুপে গড়ে তুলতে। রামাদানের শিক্ষা ছিলো- গোলামের সাথে মনিবের সম্পর্ক, মানবের সাথে মানবতার সম্পর্ককে জাগিয়ে দিতে। রামাদান ফুরিয়ে গেল, জুমাতুল বিদাও চলে গেল জানিনা সেই সম্পর্ক কতটুকু নিগুঢ় হলো কিংবা মজবুত হলো।

হালের করোনা মানব সভ্যতার সকল ঘাটেই জোড়ালো আঘাত হেনেছে। পূণ্য কামায়ের অপার রহমতের মাসে রবের সাথে বান্দার রাব্বানিয়্যাতের আমলগুলিকেও বাধা গ্রস্থ করেছে। তার পরেও হক্কানী, রব্বানী খোদার কিছু খাস বান্দাদের রোনাজারিতে কালবৈশাখী ভরা মৌসুমিতে আম্পানের ভয়াবহ তাণ্ডব থেকে করোনায় জরাগ্রস্থ দেশ রক্ষা পেল।

কৃষকের মনে এখন খুশি আছে কিন্তু মুখে হাসি নেই।

আজ ৩০ রামাদান পূর্ণ হলো। আগামিকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর। মুসলমানদের ধর্মীয় সবচেয়ে বড় উৎসব। এবারের ঈদে শহরের মতো গ্রামেও আনন্দ থাকার কথা ছিলো। বৈশাখের ধান গোলায় তুলে কৃষকের হাতে-পকেটে টাকাও ছিলো। কৃষকের মনে এখন খুশি আছে কিন্তু মুখে হাসি নেই। তার ঘরে ভাত থাকলেও পাশের ঘরের ভাই বেতন বোনাস পায় নাই। দেশের মধ্যবিত্তের বড় অংশ চাকরির কারণে তার টাকা শূণ্য। ঢাকার সাইনবোর্ড মাদরাসার একজন কওমী আলেম পাঁচ মাসের বেতন বকেয়ার কথা ফোনে বলছেন তার প্রিন্সিপালের কাছে। আশ্বস্থ ছিলেন রামাদানের কালেকশন তুলে ঈদের পূর্বে মোটা অংকের বেতন বোনাস পাবেন।

কোরআনের এই মন্ত্রেই আমরা কওমী আলেমরা ধাঁতে-জাঁতে কামড় দিয়ে বসে আছি ইমান নিয়ে।

আজ রামাদানের ত্রিশ তারিখ। ফোনেই কষ্টটা তুলে ধরছেন প্রিন্সিপালের কানে। অধিকাংশ নয়, প্রায় সকল কওমী মাদরাসার শিক্ষকদের অবস্থা এই রকম। তিন থেকে পাঁচ মাসের বেতন বকেয়া। করোনা দুর্যোগে মসজিদগুলো মুসল্লিশূণ্য। দোয়া-তোহফা, ঝাড়-ফুঁকের ভিরও অনেকটা ফাঁকা! অত্যাসন্ন ঈদ! বিবিয়ানা বাজার না হয় বাদ দিবেন ছবরের সবক আর পরকালের ছমজ দিয়ে, কন্যার কান্না থামাবেন কি দিয়ে? সন্তানকে ফিরনি না হোক সেমাই খাওয়াবেন কি করে? ‘তোমরা হীনবল হয়োনা, তোমরা দু:খিত হয়োনা, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন থাকো।’ কোরআনের এই মন্ত্রেই আমরা কওমী আলেমরা ধাঁতে-জাঁতে কামড় দিয়ে বসে আছি ইমান নিয়ে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই দূর্যোগ প্রলয়ে কওমী অঙ্গনকেও শামিল রেখেছেন তাঁর ত্রাণ তহবিলে। যদিও তা যৎ সামান্য। রুটি কিনলে ডাল পাইনা, ডাল কিনলে রুটি মিলে না। তারপরেও ধন্যবাদ না দিয়ে অকৃতজ্ঞ হবোনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরজি, কওমী সন্তানরা দেশের বোঝা নয় তারা দেশের কান্ডারী। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে যে কোন যুদ্ধে বা জিহাদে এরা বুক আগলে দিবে সর্বাগ্রে। তাই দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় কয়েকজন আলেমদের পরামর্শ নিয়ে আরেকটু গোছালো ভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলে কওমী অঙ্গনেও আপনার বাবার সোনার বাংলার সৈনিক গড়ে ওঠবে। করোনায় উলামায়ে জমহুর আমাদের অবস্থার খবরদারী করেনি। আমাদের বেদনার ইচ্ছাকেও স্পর্শ করেনি, ফলে তারা আমাদের আস্থার জায়গায় থাকেনি। জমহুর আমাদের দৌড়ানি দিয়েছেন, দাবড়ানি খাইয়েছেন। তাওয়াক্কুলের ফাযায়েল বলে ওয়াসায়েল হিসেবে রশিদ বই ধরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যে করোনায় ব্যবসায়ীর ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, দানের প্রফুল্লতা কি তার হৃদয়ে আছে?

লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *