কবে পাবো কাবাঘরের নিমন্ত্রণপত্র

কবে পাবো কাবাঘরের নিমন্ত্রণপত্র

  • ইয়াছিন নিজামী ইয়ামিন

হজের মাস শুরু হতেই মুসলিম জাহানে একটি পূণ্য পূণ্য আবহ বিরাজ করে। উপলব্ধি হয় এক মহাউৎসবের। এই উৎসব-আনন্দ একান্তই মুসলিম উম্মাহর। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ স্লোগান দিয়ে এই উৎসবে ভাগ বসানোর অধিকার নেই কারো। যারা নামে মুসলিম, অথচ তারা এই ধর্মকে মনে প্রাণে ও আবেগে বিশ্বাসে লালন-ধারণ করে না, তারাও এই আনন্দে ভাগ পাবে কিনা, সেটা ভাবনার বিষয় হতে পারে।

মাঝের দুইবছর করোনার বাঁধা আসলেও প্রতিবারের মতোই এবারও আমাদের দেশ থেকে অনেক বড় একটা সংখ্যার মানুষ আল্লাহর ঘরে মেহমান হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। যাঁরা এবার আল্লাহ পাকের ঘরের জিয়ারত করার সুযোগ পেয়েছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজায় সালাম পেশ করার ফুরসত পেয়েছেন, তাঁরা তো যারপরনাই খুশি! সাথে সাথে আমরাও ভীষণ আনন্দিত। কেননা আমাদের বিশ্বাস, যারা এই মোবারক সফরে যাচ্ছেন তাঁরা তাদের দু’আতে আমাদের মত কাবাপ্রেমিক বান্দাদের বিস্মৃত হবেন না।

আমরা এও বিশ্বাস করি, আল্লাহর ঘরের মেহমানদের দুআ ও হজ্জে মাবরুরের ব্যাকুল প্রত্যাশা আর আকাঙ্ক্ষা, আজন্ম শৈশবে লালিত স্বপ্নের কালো কাপড়ে ঘেরা সৃষ্টিকর্তার ঘর-সৌন্দর্যের বিপুলতায় যে ঘরের গঠন চিত্রিত হয়েছে সমগ্র মানবজাতির হৃদয়ে সেখানে যাওয়ার সুযোগ করে দেবেন সেই ঘরেরই অধিপতি। আমরা যে অপেক্ষায় আছি, কবে পাবো সেই পূণ্যময় কাবাঘরের নিমন্ত্রণপত্র।

হজ একটি স্বতন্ত্র ইবাদত এবং হজের সফর একটি ইবাদতের সফর। এ নিছক ভ্রমণ বা পর্যটন নয়। ইসলামে তো ভ্রমণ-পর্যটনেরও রয়েছে আলাদা নীতি ও বিধান, যা রক্ষা করা ও পালন করা কর্তব্য। সুতরাং ইবাদতের সফরে আদব রক্ষা করা এবং প্রচলিত ভ্রমণ-পর্যটনের স্বেচ্ছাচার থেকে পবিত্র রাখা অতি জরুরী। এরপর যে সময়টুকু ইহরাম অবস্থায় থাকা হয় ঐ সময়ের জন্য তো বিশেষ কুরআনী নির্দেশনা রয়েছে। ‘হজে কামাচার, পাপাচার ও ঝগড়া-বিবাদের অবকাশ নেই।’ (সুরা বাকারা (২) : ১৯৭)।

আর এ নির্দেশ পালনের প্রতিদান কী হতে পারে, তা সহীহ হাদীসে স্পষ্টতই বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ, যে আল্লাহর জন্য হজ করলো, অতপর অশ্লীল কর্ম ও গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকলো, সে ঐ দিনের মতো (নিষ্পাপ) হয়ে যায় যেদিন সে (এই ধরণীতে) ভূমিষ্ট হয়েছিলো।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৫০)

ঐতিহাসিকদের মতে ‘বাইতুল্লাহ’ পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর। এঘর কোনো মানুষের বাসস্থান নয়। সে ঘর কুল-মাখলুক—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তার। সেই ঘরে সকলের সমান অধিকার, সমান মর্যাদা। মানুষ যেমন সেখানে নিরাপদ, যে কোনো নিরীহ প্রাণী তেমনই নিরাপদ। তাই তো এর নাম হয়েছে ‘মাসজিদুল হারাম’। মানুষে মানুষে কোনো বাহ্যিক তারতম্য নেই, পার্থক্য নেই সাদাকালোয়, ধনী-গরিবের, বাদশা-প্রজায়। সকলেই যে এক রবের বান্দা। ভেদাভেদকে দূরে ঠেলে সকলেই কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায় এক কাতারে৷

হজ আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যপালনীয় একটি মহান-ইবাদত। তবে এই ইবাদত সামর্থ্যবানদের জন্য। যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের ওপর এই এবাদতকে আবশ্যক করা হয়নি। তাই কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের উপর আল্লাহর বিধান ওই ঘরের হজ করা। যারা সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে (এই বিধান তাদের জন্য)। আর কেউ যদি হজ করতে অস্বীকার করে, (তাহলে সে জেনে রাখুক) আল্লাহ তা’আলা বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।’ (সূরা আল-ইমরান: আয়াত: ৯৭)

তবে যে ব্যক্তি সেখানে সুযোগ পাওয়ার পরও হজে গেল না, তার মতো দুর্ভাগা আর কে হতে পারে! তাছাড়া এ ব্যাপারে হাদীসে এসেছে কঠিন সতর্কবার্তা। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, হজের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি হজ পালন করলো না, এরপর সে ইহুদি হয়ে মারা গেলো কি নাসারা অবস্থায় মারা গেলো, তার জন্য উভয়ই সমান।’ (তাফসির ইবনে কাসির— ১/৫৭৮)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই ধমকি শোনার পর কোনো মুসলমান তা উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেনা। উপরের আয়াতের অর্থে ‘ আর কেউ যদি হজ করতে অস্বীকার করে…’ কথাটি অতি ভয়াবহ। এতে এই ইঙ্গিতও আছে যে, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ না করা একপ্রকারের কুফর। কর্মগত কুফর তো বটেই, কারণ হজ ইসলামের একটি মূল স্তম্ভ। সুতরাং বিনা কারণে তা পালন না করা কুফরের এক শাখা। নেক আমলগুলো যেমন ইমানের শাখা তেমনি বদ আমল ও গুনাহের কাজগুলো কুফরের শাখা। আর কুফরের শাখা-প্রশাখায় বিচরণকারীর ইমান যে ঝুঁকিগ্রস্ত তা বলা বাহুল্য।

জিলহজ মাস; এবার যারা হজের সুযোগ পেয়েছেন, তাদের জন্য তো বটেই, যারা হজের সুযোগ পায়নি তাদের জন্যও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মোবারক মাস। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমলই উত্তম নয়।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামও এই দশকের আমলের চেয়ে উত্তম নয়? রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ-সংগ্রামও এর চেয়ে উত্তম নয়; তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে তার সর্বস্ব নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করল এবং কিছুই নিয়ে ফিরে এলো না।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং: ২৪৩৮; বুখারি, হাদিস নং: ৯৬৯)

অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে বেশি প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। এ দিনগুলোর এক দিনের রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য এবং এক রাতের ইবাদত শবে-কদরের ইবাদততুল্য।’ (তিরমিজি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৫৮)। জিলহজ মাসের প্রথম দশদিনের মর্যাদা, মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা এ দিনগুলোর কসম করেছেন। তিনি বলেন, ‘শপথ প্রভাতের। শপথ ১০ রাতের।’ (সুরা ফাজর—আয়াত: ১-২) তাফসিরবিদগণ বলেন, এখানে যে ১০ রাতের কথা বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে জিলহজের প্রথম দশ দিনকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫৩৫)। এর থেকে বোঝা যায় জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন কতো গুরুত্বপূর্ণ।

এই মাসটি সকল মুসলমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কেউ স্বপ্নপূরণের আনন্দে ভাসবে কেউ-বা স্বপ্ন পূরণের জন্য আশায় বুক বাঁধবে। কালো চাদরে আবৃত সৌন্দর্য্য ও ভালোবাসার উষ্ণতায় মহিমান্বিত ঘরটি যে এতো দূর থেকেও বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে। ক্ষণে ক্ষণে আলোড়িত করে যায় আমাদের তনুমন। আমরা আনন্দে আন্দোলিত হই। আশা-আশঙ্কায় শিহরিত হই। আমরা প্রার্থনা করি আমাদের স্বপ্ন-আশা যেন খুব শীঘ্রই পূর্ণতার রূপে পরিপূর্ণ হয়। আল্লাহর সকল মেহমানগণের এই হজ যেন কবুল ও মাকবুলিয়্যাত হয় এবং সহিহ-সালামতে ফিরে আসে যার যার পরিবারে, যার যার আপন নীড়ে।

  • ১১৫৮/এ, ইস্পাহান গার্ডেন, চৌধুরীপাড়া, খিলগাঁও, ঢাকা।
  • yasinnizamiyamin123@gmail.com

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *