করোনা; থমকে দিল শোলাকিয়ার ১৯৩ বছরের পথ যাত্রা

করোনা; থমকে দিল শোলাকিয়ার ১৯৩ বছরের পথ যাত্রা

ইয়াছিন নিজামী ইয়ামিন ❑ কাল পরশু, দু’দিন পরই ঈদ। সারাদেশে ঈদের আমেজ তুঙ্গে উঠে যাওয়ার কথা। কিন্তু সারাদেশ এখন নিস্তব্ধ, কোন কোলাহল নেই, পৃথিবীজুড়ে মানুষের যে বিশাল কর্মযজ্ঞের বিস্তৃতি ঘটেছিল তাও পুরোটা থমকে গেছে। রূপ নিয়েছে এক মৃত্যুপুরীর। সব জায়গায় এক মন্ত্র: ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন’। এই এক অবস্থায়-ই কেটে গেল রমজানের আদ্যোপান্ত।

ঈদ মুসলিম বিশ্বের এক সর্বজনীন পুন্যোৎসব। ভ্রাতৃত্ব সহমর্মিতা সংহতি ও অসীম পুণ্যের বার্তাবাহক এই উৎসব, সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে শান্তি শৃঙ্খলা সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি ছড়িয়ে দেয়। নিবিড় দীপ্তিময় এই উৎসব আমাদেরকে দেড় হাজার বছর ধরে আবেগে বিশ্বাসে ভালোবাসা সমাহিত করে রেখেছে এক মোহনায়। দীর্ঘ এক মাসের আত্মশুদ্ধি সংযম ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়াস এদিনটাকে আরো পুণ্যময় করে তোলে। তাই নির্মল বাতাসে শ্বাস-প্রশ্বাসে উপলব্ধি হয় এক অপার্থিব পুলকের।

ঈদের মৌলিক কার্য বা প্রধান আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে ঈদগাহে ঈদজামাত। ধনী-গরিব ভেদাভেদহীন এক কাতারে শামিল সকলেই। নামায সমাপ্তে মুসাফাহা আর মুয়ানাকার মাধ্যমে যে আনন্দ প্রকাশ করা হয়, তা আমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলে।

দুর্যোগ না হলে মাঠে এবার ১৯৩তম ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হতো।

সপ্তাহখানেক আগে যখন জানানো হল, এবারে কোন ঈদগাহে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হবে না, তখন মনটা বিষাদে ভরে গেল। ঈদজামাতে ঈদের আনন্দ তো আছেই এবং সেই আনন্দটা আরো বৃদ্ধি করে দেয় মাঠের পরিসর। যত বড় মাঠ তার আনন্দ ততবেশি। তাছাড়া হাদিস শরিফের ভাষ্যও আমাদের বড় জামাতে শরিক হতে উদ্বুদ্ধ করে। দ্বীনের কোন আমলের ক্ষেত্রে জামাত যত বড় হবে, কবুলিয়াতের দিক থেকে সেটা হবে অগ্রগামী। তাই বৃহৎ ঈদজামাত হিসেবে প্রতি ঈদের সময় সবার ভিন্ন একটা নজর থাকে দেশের সর্ববৃহৎ ঈদগাহ শোলাকিয়া ময়দানের উপর। দুর্যোগ না হলে মাঠে এবার ১৯৩তম ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু এক অকোষীয় প্রাণঘাতী ভাইরাস সবকিছুকে যেন ওলট-পালট করে দিয়েছে।

শোলাকিয়ায় এদেশের গৌরবময় একটি ঐতিহাসিক স্থান। এর অবস্থান কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় নরসুন্দা নদীর তীরে। তার মৌলিক গোড়াপত্তন হয় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে। জনশ্রুতি আছে যে, ইসলামের ঐশী বাণী প্রচারার্থে সুদূর ইয়েমেন থেকে আগমন করেছিলেন শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ। তিনি তার সম্পত্তি ঈদগাহের জন্য ওয়াকফ করে দেন এবং তার ইমামতিতে এই মাঠে সোয়া লক্ষ মানুষের প্রথম ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে এর নামকরণ করা হয় “সোয়ালাখিয়া”। তবে কালের পরিক্রমায় সোয়ালাখিয়া বিবর্তন হয়ে হয়ে যায় শোলাকিয়া। সেই থেকে এই শোলাকিয়ার মহাযাত্রা শুরু। লোকের উপস্থিতি কম হলেও দিনে দিনে স্রোতঃস্বিনী মতো বয়ে চলেছে ঠিকই। কোনদিন থমকে দাঁড়ায়নি মুহূর্তের জন্য। হ্যাঁ, তবে ভাটা তো ছিল-ই। এখনকার মতো এত ভরপুর যৌবনের উচ্ছ্বাস ছিল না। ছিল না এত প্রাণবন্ত পরিবেশ। ছিল শুধু ম্রিয়মাণ এক অবস্থা। কালের প্রবাহে কত মাঠ-ই তো দালানকোঠার নিচে চাপা হারিয়ে যায় চিরতরে কিংবা খাল-পুকুর হয়ে অপমৃত্যু ঘটে, কিন্তু কে রাখে তার খবর! এমন পরিণতি যে শোলাকিয়ার বেলাও হতে পারতো না, তার নিশ্চয়তা কে দিবে! তখন কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া একটি নাম থাকতো মাত্র।

আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। সূর্যের যেমন পরিচয়ের প্রয়োজন পড়েনা, তারও পরিচয় দেয়ার কিছু নেই।

কথায় আছে আলোকিত মানুষ যেখানেই থাকুক না কেন, তার চারপাশ আলোকিত হবেই। যারা আলোকিত হতে চায়, তারা এ থেকে ঋদ্ধ হতে পারে। আর যারা এই বাতিকে নিভিয়ে দিতে উইপোকার মতো উড়াউড়ি করে তারা নিজেরাই ঝলসে যাবে। এমন তিমিরপ্রেমীদের জন্য আমাদের করুণা আর সহিষ্ণু হওয়া ব্যাতিরেকে কিছুই করার নেই! শোলাকিয়ার পূণ্যময় মহাযাত্রায় দীপ্তি স্ফীতি ও মান অভ্রভেদিতে এক আলোকবর্তিকা হাতে শোলাকিয়ার গ্র্যান্ড ইমামের দায়িত্ব নিলেন আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। সূর্যের যেমন পরিচয়ের প্রয়োজন পড়েনা, তারও পরিচয় দেয়ার কিছু নেই।

পরিমিতিবোধ, ঋজুতা,অগাধ পাণ্ডিত্য, ঔচিত্যবোধ আর প্রচার বিমুখতাই এই জ্ঞান তাপস্যীকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।তাই তিনি শোলাকিয়ার গ্র‍্যান্ড ইমামের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে এই ঈদগাহের চিত্র। যেখানে সোয়া লক্ষ মুসল্লী নামাজ আদায় করার কারণে শোলাকিয়া নাম হয়েছে, সেখানে এখন তিন লাখেরও বেশি মানুষ নামাজ আদায় করে। ঈদের বেশ কিছুদিন পূর্বেই সম্পন্ন হয়ে যায় ঈদগাহের প্রস্তুতি। সকলের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠে নিয়োজিত থাকে বিভিন্ন বাহিনীর সহস্র সদস্য। ঈদের জামাত, খুতবা, ও মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচার করে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল।

কুষ্টিয়া, খুলনা, কুড়িগ্রাম প্রভৃতি প্রত্যন্ত অঞ্চলের ও বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন চলে আসে আগের দিনই। ভোরের আলো ফোটার আগেই পূর্ণ হয়ে যায় অর্ধমাঠ। তবে ২০১৬ সালের সেই অনভিপ্রেত ঘটনার পর থেকে সাম্প্রতি সময়ে আগের দিন কেউ প্রবেশ করতে পারেনা—তবে এতে করে কারো কিছু না হলেও পামর ইতর শ্রেণীর কিছু মানুষের হিংসা ও পরশ্রীকাতরতার অনলে ভস্মীভূত হলো অনেক ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের অভিসঙ্গ—ঈদের দিন সকাল থেকেই চতুর্মুখী ঢল নামে বিভিন্ন জেলার মুসল্লিদের। জামাত শুরু হওয়ার আগে শোলাকিয়া পরিণত হয় জনসমুদ্রে। ঠাঁয় থাকেনা তিল ধারণেরও। মাঠে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় আশেপাশে বাড়ি-ঘরের উঠোনে, যানবাহনের ছাদে, এবং সড়কেও মুসুল্লীদের নামাজ আদায় পরিলক্ষিত হয়।

ঈদের জামাত শেষে আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ (দাঃ বাঃ) সকল মুসল্লীদের নিয়ে পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ, শান্তি, সমৃদ্ধি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা কামনা করে প্রার্থনা করেন। সেই সময় মানুষের আহাজারি ও আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে শোলাকিয়ার আকাশ-বাতাস। এমনকি এটাও জানা যায়, অনেক মা-বোনেরা ঘরে থেকে টিভি-রেডিওয়ের সামনে বসেও এই মোনাজাতে শরীক হোন। এখানে এই মোনাজাত নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও আমাদের মূখ্য বিষয় এটা নয়, ধর্মীয় আবেগটাই এখানে মূল্যায়িত। এভাবেই সমস্ত জায়গায় আলো ছড়িয়ে চলেছেন এই মহান মনীষা।

তারপরও তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য হেদায়াতের প্রার্থনা করে চলেছেন।

কিছু স্থানে মানুষ তার জন্ম নিয়ে গর্ববোধ করে, কিন্তু কিছু মানুষকে জন্ম দিয়ে বরং সেই ভূমিই গর্ববোধ করে। একথা এ প্রজন্মের কাছে শুধু ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকত, তার যথার্থ স্ফূটন ঘটতো না, যদি না এই এক ফরীদ মাসঊদের জন্ম না হতো। দীর্ঘ সময় শোলাকিয়ার গ্র্যান্ড ইমামের দায়িত্বে থেকে আলোচনা-সমালোচনা এমনকি জীবননাশের হুমকি সহ আরো অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। এই পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তিনি যেন শোলাকিয়ার ইমামের দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, সেজন্য নানা ঘোট পাকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল জামাত শিবিরের নেতৃবৃন্দ ও তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গরা। হেন ষড়যন্ত্র নেই, যা তারা করেনি। কিন্তু তিনি আপন দার্ঢ্যতায় অবিচল; নিজ বিভায় শোভমান। তার সাহস, দৃঢ়তা ও পরম করুণাময়ের উপর অগাধ বিশ্বাসের কাছে পরাভূত হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের যতসব কুটিল চক্রান্ত। তারপরও তিনি ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য হেদায়াতের প্রার্থনা করে চলেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার পবিত্র গ্রন্থে বলেন “ওয়ামাকারু ওয়া মাকারাল্লাহ, ওয়াল্লাহু খাইরুল মাকিরিন”। [সূরা আল-ইমরান:৫৪] ষড়যন্ত্রকারীরা কোন সময় সফল হবে না, এটাই সর্বচিরন্তন সত্যবাণী।

এই শোলাকিয়া এখন শুধু কিশোরগঞ্জ জেলার নয় বরং পুরো বাংলাদেশের এক গৌরবময় ঐতিহাসিক স্থান। প্রতিটি ঈদে এই ময়দানে থাকে বিশ্ববাসীর স্থিরনেত্র। তাদের সামনে প্রষ্ফুটিত হয় মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের এক বিরল ঐক্য।এই চিত্র সাম্যতাপূর্ণ এক স্বর্গীয় পৃথিবীর আবাস দেয়।করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার পুন্যময় লাখো মানুষের পদচারণায় এবং আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠবে না শোলাকিয়া ময়দান। ঐ রহমত ও বারাকাত বর্ষিত হবেনা, যার মাধ্যমে এইদিন সিঞ্চিত হত এদেশের ছাপ্পান্নহাজার বর্গমাইলের মাটি ও মানুষ। সৃষ্টিও হবেনা সেই সুখময় দৃশ্য অবলোকনের সুযোগ। পুরো মনুষ্যজাতি প্রতিক্ষায় আছে কবে ফিরবে তারা সেই হারানো সু-দিনে। আর কতদিন এভাবে ঘরবন্দী কাল যাপন করবে? কবে ফিরবে সেই চিরচেনা দৃশ্য? আর যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের কথা না বলাই বাহুল্য। সেই নতুন পৃথিবীতে ক’জন আপন মানুষের সান্নিধ্য মিলবে, আর ক’জনকে হারানোর ব্যথায় শোকাহত হবো,আমরা কেউ-ই তা জানিনা। তবে কালের গর্ভে কি লুকিয়ে আছে সময়-ই তা বলে দেবে। তবে আসুন! আমরা আমাদের কাজটুকু করে যাই ; এই মহামারী থেকে উদ্ধারের প্রত্যাশায় সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রার্থনা করি বিশ্বজগতের প্রতিপালকের নিকট। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা তুহিব্বুল আফ’ওয়া, ফা’ফু আন্নি”।

লেখক: মাদরাসা শিক্ষার্থী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *