করোনা থেকে বাঁচতে শায়খ সুদাইসি শরয়ী দিক-নির্দেশনা

করোনা থেকে বাঁচতে শায়খ সুদাইসি শরয়ী দিক-নির্দেশনা

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম : করোনাভাইরাস বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এক মহা আতঙ্কের নাম। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে মানুষ দিশেহারা প্রায়। কাবা শরিফ ও মসজিদে নববির প্রধান ইমাম শায়খ আব্দুল রহমান ইবন আব্দুল আজিজ আস-সুদাইসি এ ভাইরাসে আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ও আল্লাহর সাহায্য লাভের শরয়ী দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।

মক্কার মসজিদে হারামে বয়ানে করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে তিনি মুসলিম উম্মাহর প্রতি নসিহত পেশ করতে গিয়ে কুরআনের একাধিক উদ্ধৃতি তুলে ধরেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে ধৈর্যধারণকারীদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৫)

– ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমাদের কাছে কিছুই পৌঁছবে না। কিন্তু যা আল্লাহ আমাদের জন্য রেখেছেন; তিনি আমাদের কার্যনির্বাহক। আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।’ (সুরা তাওবা : আয়াত ৫১)

অতপর তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মানুষকে নানা মুসিবত দিয়ে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন। এটি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের বিপরীত কিছু নয়। একজন মুসলিম সব সময় আল্লাহর সিদ্ধান্ত এবং ফয়সালার প্রতি ঈমান রাখে।

তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ এ করোনাভাইরাসে অধিকাংশ মানুষ ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের অবস্থা এমন-
– একটি পক্ষ করোনাভাইরাস থেকে সতর্কতায় অসংখ্য পরিকল্পনা করে ঠিকই কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা করে না। এটি মানুষের বাড়াবাড়ি।
– একটি পক্ষ কোনো পদক্ষেপ বা পরিকল্পনা গ্রহণ করে না, শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করে বসে থাকে। এটি একেবারেই ছাড়াছাড়ি। বাস্তবে এটি সুন্নাহ বিরোধী কাজও বটে।
– একটি পক্ষ মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে। তাদের বৈশিষ্ট্য হলো- ‘তারা আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস রাখে। পাশাপাশি করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার নিমিত্তে পূর্ণ সতর্কতা নিয়ে নানা উপায়ও অবলম্বন করে।’- এ ব্যাধিটি যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনে সৌদি সরকার পরিচালিত নীতিও এটি।

শায়খ সুদাইসি মধ্যমপন্থা নীতির অবলম্বনে এবং করোনা ভাইরাস থেকে সতর্ক থাকতে হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত একটি হাদিস তুলে ধরেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ‘যদি তোমরা মহামারীর (নতুন নতুন রোগ-ব্যাধির) কোনো সংবাদ শোন, তো সেখানে (আক্রান্ত অঞ্চলে) তোমরা প্রবেশ থেকে বিরত থাক। আর যদি কোনো শহরে বা নগরে কেউ সে মহামারীতে আক্রান্ত হয়, তো সেখান থেকে তোমরা বের হয়ে (অন্য কোনো অঞ্চলে) যেয়ো না।’ (বুখারি)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদিসটি বর্ণনার মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে সংক্রামক কোনো ব্যাধি ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং সতর্কতা অবলম্বন করা। এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মাঝে যেন সংক্রামক এ ব্যাধি না ছড়িয়ে পড়ে সেদিকেও সতর্ক থাকা।

যেহেতু প্রিয় নবি বলেছেন, ‘সংক্রামক ব্যাধি কুলক্ষণ নয়।’ বরং এটি থেকে সতর্ক থাকতে হবে। হাদিসের এ বর্ণনা মানুষের নানা অজ্ঞতাকে প্রত্যাখ্যান করে। জাহেলি যুগের একটি অজ্ঞতা ছিল এমন যে- ‘তারা সংক্রামণ ব্যাধির ব্যাপারে নিজেদের মানুষ বা রোগীকে দায়ী করত। ব্যাপারটি আসলে এমন নয়, এ সবকিছু আল্লাহর হুকুমেই সম্পাদিত হয়।’

এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সিংহের কাছ থেকে পলায়নের ন্যায় তুমি কুষ্ঠ রোগী থেকে পলায়ন কর।’ (মুসনাদে আহমদ)

প্রিয় নবির এ হাদিস বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো- যে কোনো মহামারীতে (নতুন নতুন রোগ-ব্যাধিতে) যাতে মানুষ সতর্কতা বা সুস্থতার উপায় অবলম্বন করে।

শায়খ সুদাইসি বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন স্থানে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, ‘এই ভাইরাস মোকাবেলায় কিছু মানুষ মসজিদ থেকে পলায়ন করছে। এটি মানুষের মানবিক দুর্বলতা। তবে মানুষদের মনে রাখতে হবে যে- ‘আল্লাহর আশ্রয় থেকে এক মুহূর্ত পলায়ন করার বা তার অমুখাপেক্ষী হওয়ার সুযোগ নেই।’

যেমনি ভাবে আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের উদ্ধৃতি দিয়ে কুরআনে ঘোষণা করেন- ‘আর যখন আমি অসুস্থ হই, তখন তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন।’ (সুরা শুআরা : আয়াত ৮০)

কুরআনের এ আয়াত প্রমাণ করে যে, মানুষ সুস্থতা লাভে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাআলা তাকে অসুস্থতা থেকে পূর্ণ সুস্থতা দান করবেন।

মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে শায়খ সুদাইসি বলেন- সবকিছু আল্লাহর হুকুমেই হয়। যদি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে পুরো মানবগোষ্ঠী একত্রিত হয়, আর তাতে আল্লাহর আদেশ, সিদ্ধান্ত ও ফয়সালা না থাকে তবে তা থেকে বাঁচা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই বান্দাহর জন্য অবশ্য করণীয় হল- ‘কারোনাভাইরাস মোকাবেলায় হাদিসের নির্দেশনা অনুসারে সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি আল্লাহর সমীপে ধাবিত হওয়া এবং একমাত্র তাঁর প্রতি ভরসা রাখা।’

শায়খ সুদাইসি ব্যাহিক উপায় অবলম্বন করতে কিছু স্বাস্থ্যবিষয়ক সতর্কতার উপদেশ দেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের ভয়-ভীতি, শংকা বা আতঙ্কের ফলে একে অপরের সঙ্গে মুসাফাহা করা, মসজিদে আসা বন্ধ করে দিতে চলেছে। বরং তা না করে করোনা সতর্কতায় বাহ্যিকভাবে এ উপায়গুলো অবলম্বন করতে পারে-
– নিজেদের জীবাণুমুক্ত রাখা।
– দুই হাত ধোয়া
– অপরিচ্ছন্নতা ও আবর্জনার মাধ্যমে যাতে সংক্রামক ব্যাধি আপনার দিকে না আসতে পারে সে বিষয়ে পরিচ্ছন্ন থাকা এবং এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা।

সতর্কতামূলক এ সব ব্যবস্থাপনা অবলম্বন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর একটি অংশ। এটি আল্লাহর ওপর ভরসার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক নয়।

তাই করোনাসহ নতুন নতুন সংক্রামক রোগ-ব্যাধি ও মহামারী দেখা দিলে তা থেকে আশ্রয় লাভে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা এবং ধৈর্যধারণ করা।
বিশেষ করে দুটি দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে বলেছেন বিশ্বনবি-
>> اَللَّهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَ الْجُنُوْنِ وَ الْجُذَامِ وَمِنْ سَىِّءِ الْاَسْقَامِ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাচি ওয়াল জুনুন ওয়াল ঝুজাম ওয়া মিন সায়্যিয়িল আসক্বাম।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনার কাছে আমি শ্বেত রোগ থেকে আশ্রয় চাই। মাতাল হয়ে যাওয়া থেকে আশ্রয় চাই। কুষ্ঠু রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আশ্রয় চাই। আর দুরারোগ্য ব্যাধি (যেগুলোর নাম জানিনা) থেকে আপনার আশ্রয় চাই।

>> اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ وَ الْاَدْوَاءِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি, ওয়াল আদওয়ায়ি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ (নষ্ট-বাজে) চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা এবং বাজে অসুস্থতা ও নতুন সৃষ্ট রোগ বালাই থেকে আশ্রয় চাই।’ (তিরমিজি)

সকাল-সন্ধ্যার বিশেষ দোয়া : হজরত উসমান ইবনে আফ্‌ফান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘প্রতিদিন ভোরে ও প্রতি রাতের সন্ধ্যায় যে কোনো বান্দা এ দোয়াটি ৩ বার পাঠ করবে, কোনো কিছুই তার অনিষ্ট/ক্ষতি করতে পারবে না-
بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইয়্যুন ফিল আরদ্বি ওয়ালা ফিস্সামায়ি ওয়া হুয়াস্‌সামিউল আলিম।’ (তিরমিজি)
অর্থ : ‘ওই আল্লাহ তাআলার নামে, যাঁর নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো কিছুই কোনো অনিষ্ট করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।’

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত না হয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সূত্র : দি ডিপ্লোম্যাট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *