এন.এস.এম মোজাম্মেল হক : একটি শিশু যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পথে এগিয়ে যায় এবং তার মাঝে কিছু শারীরিক ও মনস্তাত্মিক উন্নয়ন ও পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়, তখন তাকে কৈশোর বা বয়সন্ধিকাল বলা হয়। বয়সন্ধিকালীন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটি শিশুর মধ্যে কিছু হরমোনজনিত পরিবর্তন সাধিত হয় যা তার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এসময়ে তাদের শিশু ও বলা যায় না, আবার অনেক প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবেও গণ্য করা হয় না। এটিই বয়সন্ধিকাল। এসময় মানুষের মস্তিস্কে কিছু হরমোন তৈরি হয় যা রক্তের সাথে মিলে এ পরিবর্তন ঘটায়। ১০ থেকে ১৮-২০ বৎসর সময়কে বয়সন্ধিকাল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আর প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর এই বয়সন্ধিকালের সমাপ্তি ঘটে।
মানুষের বয়সন্ধিকাল এবং মস্তিষ্কের পরিবর্তন (Neural Development) সম্পর্কে খুব কমই আলোচনা হয়। বয়সন্ধিকালের হরমোনের পরিবর্তন মস্তিষ্কের পরিপক্কতা এবং আচরণের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। এই পরিবর্তন ব্যক্তির চিন্তার ক্ষেত্র, ধ্যান-ধারণা, উদ্বুদ্ধকরণ এবং আচরণগত পরিবর্তন ঘটায়, যা তার প্রজনন প্রক্রিয়াকে সক্রিয় ও গতিশীল করে। এই বয়সন্ধিকাল মানুষের হরমোনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তার শরীরে গঠন কাঠামো এবং বুদ্ধির বিকাশকে প্রভাবিত করে।
বয়সন্ধিকাল এবং প্রজনন স্বাস্থ্য পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে পরিপূর্ণ দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণের একটি অবস্থাই হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য। এটা শারীরিক গঠন প্রণালী, কার্যক্রম প্রণালী এবং প্রক্রিয়ায় কোনো রোগের প্রভাব বা অক্ষমতা নয়।
বয়সন্ধিকালীন ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের আচরণগত পরিবর্তনও লক্ষণীয়। এই পরিবর্তনগুলি কখনও কখনও অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। ছেলে-মেয়েদের পরিবর্তনের মধ্যে দ্রুত উচ্চতা ও ওজন বাড়া, স্কিনে পরিবর্তন, সব স্থায়ী দাঁত উঠে যাওয়া, ঘাম বেশি হওয়া, কোমর সরু হয়ে যাওয়া, বড় হাড় বৃদ্ধি পাওয়া, প্রজনন সংশ্লিষ্ট অংগসমূহ পরিবর্তিত হওয়া, স্বর ভেঙ্গে যাওয়া ও ভারি হয়ে যাওয়া, বুক ও কাঁধ চওড়া হওয়া ইত্যাদি লক্ষণীয়।
মূলত: বয়সন্ধিকালকে ইংরেজিতে সেন্ট্রাল পিউবার্টি বা কেন্দ্রীয় বয়সন্ধি হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে এই পরিবর্তন শুরু হয়। বয়সন্ধিকালে মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাস অংশ জিন এনআরএইচ হরমোনক্ষরণ শুরু হয়। পিটুইটারি গ্রন্থির বাইরের অংশ কাজ শুরু করে এবং এলএইচ ও এফএসএইচ হরমোনক্ষরণ শুরু হয় ও রক্তের মাধ্যমে তা প্রবাহিত হয়। এলএইচ ও এফএসএইচ হরমোনের প্রভাবে যথাক্রমে ডিম্বাশয় শুক্রাশয় কাজ করা শুরু করে। সে সাথে এরা যথাক্রমে এস্ট্রাডিওল ও টেস্টোস্টেরল উৎপন্ন শুরু করে। শরীরে এস্ট্রাডিওল ও টেস্টোস্টেরলের বৃদ্ধির ফলে মেয়ে ও ছেলেদের বয়সন্ধিকালীন বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।
বয়সন্ধিকালে একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় একটি শিশুর শরীর একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে রূপান্তরিত হয় এবং প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। এ পরিবর্তনের সাথে মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটার ফলে এসময়ে কিশোর কিশোরীরা সামাজিক কর্মকা-ের সাথে যুক্ত হয়। আন্ত:ব্যক্তিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। এসময় ছেলে মেয়ে উভয়ই পরিণত আচরণ করতে শুরু করে। শৈশবের নির্ভরশীলতা কাটিয়ে তারা আত্মনির্ভরশীলতার দিকে ধাবিত হয়। তারা বাবা-মা’র বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর নির্ভর করতে পছন্দ করে। নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতার উপর নির্ভর করে। অন্যের প্রতি আগ্রহী হয় এবং পড়াশুনার ধারা নির্বাচন করে এগিয়ে যেতে চায়। এসময়ে তারা সামাজিক দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করতে চায়। এছাড়া এসময়ে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়-অর্থাৎ নৈতিকতার স্ফুরণ ঘটে।
দেখা যাচ্ছে বয়সন্ধিকালে শিশু-কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে একটি ব্যাপক দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তাদের স্বাভাবিক কৌতুহল তীব্র হয়ে নতুন নতুন জ্ঞান লাভের প্রতি আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন বিষয়ে তারা সুস্পষ্ট ধারণা লাভে আগ্রহী হয় এবং তাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক চিন্তা চেতনার উন্নয়ন ও স্বাধীনতার চেতনার বিকাশ ঘটে। বয়সন্ধিকালে রাগ, ভয় দুশ্চিন্তা, স্নেহ, ভালবাসা, ঘৃণা ঈর্ষা ইত্যাদি আবেগ প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ সময়ে আবেগ প্রকাশে তীব্রতা দেখা দেয়। কোনো কোনো সময় আবেগ একেবারেই থাকে না।
এ বয়সে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব, রাগ, ভয়, আশংকা ও অন্তর্দ্বন্ধ, বিমূর্ত ধারণাকেন্দ্রিক আচরণ, অন্তর্মূখিতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা, আদর্শ গঠন, প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা, যৌন আবেগ, আবেগের অবদমন ও আনন্দ ইত্যাদি আবেগীয় বিষয়গুলো প্রকাশ পায়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিশু কিশোর-কিশোরীরা বয়সন্ধিকাল পেরিয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় প্রক্রিয়ায় একটি ব্যাপক মনোদৈহিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়।
এক্ষেত্রে প্রতিটি পরিবার, শিক্ষাক্ষেত্র এবং কর্মক্ষেত্রকেও তাদের এই পরিবর্তন ও আচরণগুলোকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে দেখতে হবে এবং তাদের সাথে সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে, যেন তারা বাবা-মা বা নিকট আত্মীয়কে বন্ধু ভেবে মন খুলে তাদের দ্বন্ধ বা নতুন অনুভূতিগুলো শেয়ার করতে পারে। পাশাপাশি তাদের বুদ্ধির বিকাশের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান তাদের যথাযথ বেড়ে উঠতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। পুষ্টিবিদদের মতে বয়সন্ধিকালে সুষম খাবরের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাবারের তালিকায় ভিটামিন শর্করা, আমিষ, চর্বি, লবণ ও পানি-এই ৬টি উপাদান অত্যাবশ্যক। কিশোর-কিশোরীদের প্রতিবেদনের খাবারে ২২০০ ক্যালরি থাকতে হবে। তাদের জন্য ফ্যাটি এ্যাসিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন ২/৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। ডাবের পানি উপকারি। কোমল পানীয় পরিহারযোগ্য এবং চা-কফি পরিমাণমত পান করা উচিত।
আজকের কিশোর-কিশোরীরা আমাদের আগামী প্রজন্ম। তাদের দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি এবং বুদ্ধির বিকাশ আমাদের উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত। প্রজনন স্বাস্থ্য এবং বয়সন্ধিকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এর মনোদৈহিক পর্যায়। এ সময়ে যে সমস্ত মানসিক সমস্যা দেখা দেয় সেগুলোকে মোকাবিলা করার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। দৈহিক পরিবর্তনগুলোকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ প্রজনন প্রক্রিয়ায় নারী পুরুষ উভয়েরই দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রেও তাদের সচেতন হতে হবে। এসময় পুষ্টির চাহিদা মেটাবার জন্য গণসচেতনতা বাড়াতে হবে।
তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একজন স্বাস্থ্যবতী মা ও স্বাস্থ্যবান বাবা পাবে। আচরণগত সমস্যার ক্ষেত্রে অনেকসময় পরামর্শ বই পড়া, মনো চিকিৎসকদের মতামত গ্রহণ করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে বয়সন্ধিকালে বুদ্ধির বিকাশ সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে। অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে সন্তানের বিকাশ যেন বাধাগ্রস্ত না হয় অথবা তারা যেন বিপথে ধাবিত না হয়। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এসময় পিতামাতাকে সতর্ক থাকতে হবে। সুস্থ প্রজনন স্বাস্থ্য এবং বয়সন্ধিকালীন সৃজনশীল বৃদ্ধির বিকাশ আমাদের উন্নত জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করবে। আর এজন্য শুধু প্রয়োজন আমাদের সচেতনতা, মনোযোগ, তাদের প্রতি যত্ন ও সহনশীল মনোভাব।
লেখক : কলামিস্ট ও স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ।