কুরআনুম মাজীদ : তরজমা ও তাফসীর

কুরআনুম মাজীদ : তরজমা ও তাফসীর

কুরআনের আলো ● সূরা আল বাকারা ● মাদানী, আয়াত : ২৮৬ ● মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ

ওয়ায কুরু মা ফিহি লাআল্লাকুম তাত্তাকুন : আর স্মরণ করো যা আছে তাতে। যেন তোমরা তাকওয়ার অঙ্গীকারী হতে পারো।
৬৪. সুম্মা তাওয়াল্লাইতুম মিম বা’দি যালিকা : আবার মুখ ফিরালে তোমরা এরপরও। সুম্মা : অনন্তর, আবার, তাওয়াল্লাইতুম : তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে। বহুবচন, দ্বিতীয় পুরুষ, অতীতবাচক ক্রিয়া, বাবে তাফাউউল ক্রিয়া মূল ‘তাওলিইউন’ পেছন ফেরা, পলায়ন করা, মিম বা’দি যালিকা : এরপরও। যালিকা বলে মি’সাক ও অঙ্গীকাসহ উপরের আয়াতে বর্ণিত ঘটনাটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

ফালাওলা ফাদলুল্লাহি আলাইকুম ওয়ারাহমাহ : অনন্তর যদি না হতো আল্লাহর অনুগ্রহ তোমাদের উপর এবং তাঁর ও রহমত। লাওলা : যদি না হত। এর সঙ্গে নফীবাচক ‘লা’ সংযুক্ত শব্দ। ফাদল : অনুগ্রহ, ব্যবহারের পর বেঁচে থাকা। ক্রিয়ামূল। ফাদল-এর বহুবচন ফুযুলুন।

লাকুনতুম মিনাল খাছিরীন : তবে তোমরা অবশ্যই হতে ক্ষতিগ্রস্তদের শামিল। আল খাছিরীন : ক্ষতিগ্রস্তগণ। বহুবচন, কর্তাবাচক বিশেষ্য, ইসমে ফায়েল। বহুবচন, মূলত আল খাছিরী-এর পূর্বে জার বাচক শব্দ আসায় ‘আল খাছিরীন’ রূপ পরিগ্রহ করেছে। একবচন ‘আল খাছের’।

সারমর্ম
এখানে ইয়াহুদী বনূ ইসরাইলের আরেকটি দুষ্কর্মের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইয়াহুদীরা হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে বারবার অনুরোধ করছিল যে, আল্লাহর বিধান-কিতাব কোনো কিছু প্রাপ্ত হলে তদনুযায়ী তারা আমল করবে, নিজেদের জীবন গঠন করবে। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তখন তাদের শক্ত অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, মনের অনুকূল হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় তারা এর উপর আমল করবে, অন্যথা করবে না। কিন্তু যখন তওরাত নাযিল হলো, এর কঠোর কিছু হুকুম আহকাম ও বিধিমালা এলো তা তারা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। অঙ্গীকার ভঙের শাস্তি হিসেবে আল্লাহ পাক তাদের মাথার উপর তূর পাহাড় এনে তুলে ধরলেন এবং দৃঢ়ভাবে তা ধারণ করতে কঠিন নির্দেশ দিলেন। এতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তারা তা মেনে নিয়ে এবং পুনঃ অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়।

এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে যে, ইসলামের মূলনীতি হলো ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি নেই। একটি আয়াতে সুস্পষ্ট ঘোষিত হয়েছে যে, ‘লা ইকরাহা ফিদ দীন’ দ্বীনের ক্ষেত্রে জবরদস্তি নেই। [সূরা বাকারা : আয়াত ২৫৫]

অথচ এখানে মাথার উপর পাহাড় তুলে ধরে বনী ইসরাঈলকে জবরদস্তি তওরাতের হুকুম আহকাম মেনে চলতে বাধ্য করা হচ্ছে। এর জবাবে বলা হয়ে থাকে যে, ইসলাম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে জোর জবরদস্তি নেই। এই ক্ষেত্রে সবারই ইচ্ছর স্বাধীনতা রয়েছে কিন্তু স্বেচ্ছায়, স্বপ্রণোদিতভাবে ইসলামগ্রহণের এর বিধিবিধান সমূহ না মানলে শাস্তির বিধান রয়েছে। শাস্তির উদ্দেশ্য হলো ভয়প্রদর্শন। এখানেও তওরাতের হুকুম আহকাম মেনে চলার অঙ্গীকার সত্ত্বেও পরবর্তীতে তা মানতে অস্বীকার করার অঙ্গীকার ভঙের শাস্তিস্বরূপ তাদের সঙ্গে এই আচরণ করা হয়েছিল। তওরাতের বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।

বানূ ইসরাইল তথা ইয়াহুদীদের পুনঃপুনঃ অবাধ্যতার কাহিনী সুবিদিত। এরা নফস ও শয়তানের ধোঁকায় আবারও অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়। আল্লাহর দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু আল্লাহ পাক অসীম রহমত ও মাগফিরাতের মালিক দয়ার সাগর। অন্তহীন সহনশীলতার অধিকারী। তাই অবাধ্যতার কারণে এদের সবাইকে ধ্বংস না করে নবীগণের ওসীলায় এদের ক্ষমা করে দেন। নইলে তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়তো।

বিষয়টি সকল ঈমান ওয়ালার জন্য সুসংবাদস্বরূপ। হাজারও গোনাহের পরও নিরাশার কিছু নেই। কায়মনোবাক্যে অনুশোচিত হয়ে তওবা করলে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ার সাগর। তিনি তো গাফুরুর রাহীম।

৬৫. আর অবশ্যই তোমরা জানো যারা সীমা লঙ্ঘন করেছিল তোমাদের থেকে শনিবারের ক্ষেত্রে। পরিণামে বলেছিলাম তাদের, হয়ে যাও তোমরা ঘৃণিত বানর।
৬৬. অনন্তর আমি করলাম এটিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তাদের জন্য যারা ছিল সমকালে আর যারা আসছে পরবর্তী কালে। এবং উপদেশ স্বরূপ মুত্তাকী পরহেজগারদের জন্য।

শব্দ বিশ্লেষণ
ওয়ালাকাদ আলিমতুম : আর অবশ্যই তোমরা জানো। লাকাদ : অবশ্য অবশ্যই। ‘লাম’ একটি তাকিদ বাচক শব্দ। কাদ ও একটি তাকিদবাচক শব্দ। দুটো যুক্ত হয়ে ‘লাকাদ’ রূপ ধারণ করেছে। তাকিদের উপর তাকিদ। ‘আলিমতুম’ তোমরা জানো, দ্বিতীয় পুরুষ, বহুবচন, অতীতকাল ক্রিয়া। ক্রিয়ামূল ‘আল ইলমু’ জানা। বিষয়টি বনূ ইসরাইলীদের মাঝে খুবই প্রসিদ্ধ ও অতি জ্ঞাত ছিল।

আল্লাযি না’তাদাও মিনকুম ফিস সাবতি : যারা সীমা লঙ্ঘন করেছিল তোমাদের থেকে শনিবারের ক্ষেত্রে। ‘ই’তাদাও’ সীমালঙ্ঘন করেছিল, বহুবচন, তৃতীয় পুরুষ। অতীতকালবাচক ক্রিয়া। ক্রিয়ামূল ‘আল ই’তিদাউ’ সীমালঙ্ঘন করা। ‘মিনকুম’ তোমাদের থেকে অর্থাৎ তোমাদের পূর্ব পুরুষদের থেকে। ‘আস সাবত’ শনিবার। বনূ ইসরাইল তথা ইয়াহুদীদের ধর্মে শনিবার ছিল সাপ্তাহিক পবিত্র দিন। এই ছিল তাদের ধর্মমতে সব ধরনের জাগতিক কাজ, ব্যবসাবাণিজ্য, রোজীরোজগার বন্ধ করে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করার নির্দেশ ছিল। আরব উপসাগরের পূর্বতীরবর্তী ইলাত [ঊষধঃয] নামক স্থানের ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা ছিল মৎসজীবী। এরা আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। শনিবারের আগেই মাছ বন্দী করে, শনিবার অতিবাহিত হলে তা শিকার করার জঘন্য কৌশল অবলম্বন করে। এবং আল্লহকে ফাঁকি দিল বলে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। আল্লাহর হুকুমকে বদলে ফেলার এই ঘৃণ্য কৌশলের পরিণামে শাস্তি হিসাবে আল্লাহ পাকও তাদের মানবীয় আকৃৃতি বদলে দেন। এরা ঘৃণিত বানর হিসাবে রূপান্তরিত হয় এবং তিন দিনের ভেতরই সব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

ফাকুলনালাহুম : পরিণামে বলেছিলাম তাদের। ‘ফা’ শব্দটি এখানে এদের ‘নাতিজা’ বা পরিণাম বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

কূনূ কিরাদাতান খাছিয়ীন : হয়ে যাও তোমরা ঘৃণিত লাঞ্ছিত বানর। কূনূ : হয়ে যাও তোমরা, বহুবচন। ‘আমর’ বা অজ্ঞাবাচক শব্দ। ক্রিয়ামূল ‘আল কাউনু’ হওয়া। কিরাদাতান : বানর, বহুবচন। আল কিরদু, একবচন। খাছিয়ীন : ঘৃণিত, বহুবচন। কূনূ -এর খবর। একবচন, খাছিউন, ঘৃণিত কুকুর বা শুকর। যাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়, কাছে ঘেঁষতে দেয়া হয় না। ক্রিয়ামূল বা মাসদার হলো ‘আল খাসউ’ দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া।

নোট : আয়াতের তরজমা কুরআনের মূল টেক্সট দেখে পড়ন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *