কেন চীনের দুর্দশা নিয়ে বাকি বিশ্বের এত মাথাব্যথা

কেন চীনের দুর্দশা নিয়ে বাকি বিশ্বের এত মাথাব্যথা

পাথেয় টোয়েন্টিফোর ডটকম: একটা কথা প্রচলিত আছে, যুক্তরাষ্ট্র যখন হাঁচি দেয়, তখন বিশ্বের বাকি দেশগুলোরও ঠান্ডা লাগে। এখন প্রশ্ন হলো, চীন যখন অসুস্থ হয়, তখন কী হয়।

চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। বর্তমানে ১৪০ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস এই দেশে। বিবিসি জানাচ্ছে, চীন বর্তমানে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন, যার মধ্যে আছে অর্থনীতির ধীরগতি, বেকারত্ব ও অস্থিতিশীল আবাসন বাজার।

সম্প্রতি দেশটির আবাসন কোম্পানি এভারগ্র্যান্ডের চেয়ারম্যানকেও পুলিশের নজরদারিতে আনা হয়েছে, শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির শেয়ার বেচাকেনাও স্থগিত করা হয়েছে। এসব সমস্যা চীনের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য তা আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

বিশ্লেষকেরা বিশ্বাস করেন, বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা বলা হচ্ছে, তা অতিরঞ্জিত। তবে বহুজাতিক করপোরেশন, তাদের কর্মী ও চীনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগহীন মানুষও এর প্রভাব কিছুটা অনুভব করবে, যদিও শেষমেশ বিষয়টি নির্ভর করবে আপনি কে, তার ওপর।

জয়ী ও পরাজিত

সিঙ্গাপুরের এশিয়ান ট্রেড সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ডেবোরাহ এলমস প্রশ্ন রাখেন, চীনের মানুষ যদি বাইরে খাওয়া—যেমন দুপুরের খাবার—কমায়, তাতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব পড়বে। উত্তরে তিনি নিজেই বলেন, মানুষ যতটা ভাবে প্রভাব হয়তো ততটা পড়বে না; তবে যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি চীনের অভ্যন্তরীণ ভোগের ওপর নির্ভরশীল, তারা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

অ্যাপল, ভক্সওয়াগন ও বারবেরির মতো শত শত বড় বৈশ্বিক কোম্পানি চীনের বিশাল ভোক্তা বাজার থেকে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব আয় করে। চীনের নাগরিকদের ভোগব্যয় কমালে এসব কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনটি হলে বিশ্বজুড়ে এদের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার সরবরাহকারী ও শ্রমিকের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক-তৃতীয়াংশই আসে চীন থেকে, এ পরিস্থিতিতে সে দেশের অর্থনীতি গতি হারালে তার প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য দেশেও পড়বে।

মার্কিন রেটিং এজেন্সি বা ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা ফিচ গত মাসে বলেছে, চীনের অর্থনৈতিক মন্থর গতির প্রভাব বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনায় ছায়া ফেলেছে এবং সে কারণে ২০২৪ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসও হ্রাস করেছে তারা। যদিও কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চীনকে যেভাবে বৈশ্বিক সমৃদ্ধির চালিকা শক্তি হিসেবে দেখানো হয়, তা অতিরঞ্জিত।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়না সেন্টারের অর্থনীতিবিদ জর্জ ম্যাগনাস বলেন, গাণিতিকভাবে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রায় ৪০ শতাংশের জন্য বিশ্ব চীনের ওপর নির্ভরশীল, এটা ঠিক। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি থেকে কারা উপকৃত হচ্ছে? চীন আমদানির থেকে অনেক বেশি রপ্তানি করে। তাই চীনের প্রবৃদ্ধি কতটা হলো বা না হলো, তা মূলত চীনের ব্যাপার, এর সঙ্গে বাকি বিশ্বের বিশেষ যোগ নেই।

তা সত্ত্বেও চীনের মানুষ পণ্য ও সেবায় বা গৃহ নির্মাণে কম অর্থ ব্যয় করলে কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমে। চলতি বছরের আগস্ট মাসে দেশটিতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ কম আমদানি হয়েছে। সিডনিতে লোয়ি ইনস্টিটিউটের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক রোল্যান্ড রাজা বলেন, চীনের আমদানি কমে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল ও আফ্রিকার কিছু কিছু দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

চীনের মানুষের চাহিদা কমার অর্থ হলো, সেখানে পণ্যের দামও কম থাকবে, যদিও পশ্চিমা গ্রাহকের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ভালো। এমনিতেই তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সমস্যায় রয়েছে। এখন চীনা পণ্যের দাম কম থাকলে তাদের ওপর চাপ কমবে, ফেডও নীতি সুদহার বৃদ্ধির ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

রোল্যান্ড রাজা আরও বলেন, এ পরিস্থিতি উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করা সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো খবর। চীনের এই অর্থনৈতিক মন্থরতা থেকে সাধারণ ভোক্তারা স্বল্প মেয়াদে উপকৃত হলেও উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষের জীবনে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নামের বিশাল প্রকল্পে চীন ১০ বছর সময় ধরে ১ লাখ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সড়ক, বিমান, সমুদ্রবন্দর ও সেতু নির্মাণের জন্য চীন থেকে অর্থ ও প্রযুক্তি পেয়েছে ১৫০টির বেশি দেশ। রোল্যান্ড রাজার মতে, চীনের অর্থনৈতিক সমস্যা অব্যাহত থাকলে এসব প্রকল্পেও প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, এ পরিস্থিতিতে চীনের সংস্থা ও ব্যাংকগুলো অন্যান্য দেশকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আগের মতো উদারতা দেখাবে না।

পুরো বিশ্বের কাছে চীন

চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় দেশটির বিদেশি বিনিয়োগ কমবে, এমন সম্ভাবনাও আছে। তবে এর ফলে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে কী প্রভাব পড়বে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

কেউ কেউ যুক্তি দেন, এ পরিস্থিতিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করতে পারে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি ২৫ শতাংশ কমে যাওয়ার আংশিক কারণ হলো, চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী জিনা রাইমন্ডো সম্প্রতি বলেছেন, কিছু কিছু মার্কিন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির জন্য চীন বিনিয়োগযোগ্য নয়।

কিন্তু চীন কঠিন অবস্থান থেকে সরে আসছে, এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। চীন এখনো প্রতিশোধমূলক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে এবং একই সঙ্গে প্রায়ই পশ্চিমা দেশগুলোর ‘স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতার’ সমালোচনা করছে। পাশাপাশি রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন এবং সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের মতো পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া নেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে চীন।

একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করতে প্রতি মাসেই চীনে ভ্রমণ করছেন। তবে চীনের বক্তব্য ও নীতির মাঝখানে কী নিহিত আছে, তা খুব কম মানুষই জানেন। সম্প্রতি প্রতিনিধি পরিষদের চীনবিষয়ক বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান ও রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান মাইক গ্যালাগার বলেন, বর্তমানে চীনের অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবিলায় ব্যস্ত।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *