- আদিল মাহমুদ
যতোসব আকাশ কুসুম ভাবনায়—এমন তুমুল জ্যোৎস্না রাতে আমার ঘুম আসে না। উপভোগ করি স্নিগ্ধতায় প্লাবিত সবুজের প্রাচীরে সারি সারি গাছের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। প্রকৃতির জয়গানে গভীর অরণ্যে একটি কাওয়ালির সুর ভেসে আসা।
নদীর পাড়ের রুপো চূর্ণের মত ঝিকমিক করা বালি ও দূর নক্ষত্রবীথির দিকে তাকিয়ে—আমি এক কিশোরীর বন্দনা শুরু করি দুলে দুলে ঘাসের মোজাইকে বসে। আর পালাতে চাই জীবনের দায় থেকে। নীরব ধ্যানের স্তম্ভে অর্জুনপথে ধুলো উড়িয়ে—কেবল দুঃখের পাথর চুম্বন করে।
আত্মদহনে দগ্ধ আমার হৃদয় একা একা হাঁটে। জানো, কোথাও কেউ অপেক্ষায় নেই তার জন্য। হিমশীতল নীরবতায় যে শুনবে—মহাসমুদ্রের জলরাশির মতো জমে থাকা অজস্র প্রেমআলাপ। খোঁপায় বুনোফুল গোঁজা অজপাড়া গাঁয়ের এক কিশোরী বৃত্তান্ত। যার জীবন মুক্তবিহঙ্গ—প্রজাপতির মতো উড়ো।
যাকে দেখলেই মনের অফুরান স্পন্দনের শব্দ বেজে ওঠে চোখে মুখে। মুগ্ধ নয়ন উথালপাথাল ঢেউয়ের নাগরদোলায় দুলতে থাকে আলোকবর্ষে। যেন তাকে দেখলেই আমি নোনাধরা দেয়ালে খুঁজতে থাকি—হারিয়ে যাওয়া কোনো প্রিয় প্রতিচ্ছবি।
বাতাসের মীড়ে মীড়ে তৈরি করা হাহাকারের নবতরে লেখা আমার গানে সুর ধরে, শুকনো ভাঙা ডালকে একা ফেলে—একটি গায়িকা পাখি উড়ে যায় শূন্যে। নিঃসঙ্গ অরণ্যের ভেজা চারুলতার পানে। আমি তার সুরে খুঁজি কিশোরীর নগ্নতার সৌন্দর্য। অস্থির হয়ে ওঠি সৌরভের যুগলঘরে ভেজা পাঁপড়ির জলরঙে।
কিশোরীর গভীরতর মায়াবী চুম্বনের আকুল অনুভবে—গা ঘেঁষে ঘেঁষে ভারসাম্যহীন হয়ে যাই। তবুও নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় তার চুম্বনে। এরপর স্বপ্নগুলো ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যায় দিগন্তে পশ্চিমের জ্যোৎস্নার আভার—পটভূমে বিমূর্ত সব ছায়াতরে। আমি পড়ে থাকি চন্দ্রাহতে একা হয়ে।
এই সবুজ নৈরাজ্যময় জ্যোৎস্নায় আমার একাকিত্ব দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে—আতঙ্কে রূপান্তরিত হয়। সেই সাথে নির্জনতায়, নৈঃশব্দ্যের নিঃসীম ঝর্ণাধারায় থেমে যায় স্নায়ু ও রক্তের নিরাশ কম্পন। যেন তা শরীর ভেদ করে—মনের মূর্ধা পর্যন্ত ছুঁয়ে আছে ঢলে পড়া নহলী যৌবনে। আমি নিজেই ধরতে পারি না, কিশোরীর হারিয়ে যাবার পর ঠিক কোন দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধন করে বেঁচে আছি।
টলটলে চোখের জলের স্বচ্ছনদীর পানকৌড়ি ডুবসাঁতার দেখতে—নাকি কবিতার শব্দের ভেতরের রূহ উড়ে গিয়ে শৈশবের সাইকেলে বসার দৃশ্য দেখতে। দুচোখের পাতা এক হলেই শিল্পকলার বিমূর্ত বিস্ময়ে, লিথিয়াম আলোর আভার ম্লানে—চাঁদ হঠাৎ মুখ লুকায় মেঘের আড়ালে। রাত গভীর হতে থাকে গহিন অন্ধকারে।
পৃথিবীতে আমার জন্য কোথাও কেউ অপেক্ষায় নেই! কিন্তু আকাশে একজন ঠিকই আছেন—যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই এখন খুব কাছে নেমে এসেছেন। এজন্য অবুঝ শিশুর মত অশ্রুসিক্ত নয়নে—তাঁর কাছে বাহানা ধরেছি, ‘আল্লা গো, আমার পাপীমনকে ক্ষমা করো। কিশোরীকে সুখে রাখো।’